টিউব লাইটের তীব্র আলো পড়তেই চোখ জ্বালাপোড়া শুরু হল সীমার। ঘর মোছার বুয়া চলে এসেছে। চোখ মেলে সীমা দেখল বাইরে এখনো দিনের আলো ফোটেনি। জানালার কাঁচে এখনো রাতের অন্ধকার লেগে রয়েছে। জমিলা খালা তাদের বাসায় তিন বছর ধরে ঘর মোছার কাজ করে। ঘর মুছেই আবার বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে কাপড় কাচা সব কাজ করতে হয়। তারপর বাড়ি ফিরে নিজেদের রান্না করতে করতে বিকেল হয়ে যায়। তার বিনিময়ে বাড়িওয়ালা বুয়ার ৬ বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে শাবানাকে স্কুলে পড়ার সব খরচ দেয়। সে কোন বেতন নেয়না। তার একটাই ইচ্ছা তার মেয়েটা যেন সুন্দর একটা জীবন পায়।
জমিলা খালা মেয়েকে সরকারী স্কুলে দেয়নি। সেখানে ভালো পড়াশোনা হয়না বলে। এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। পরিবার নিয়ে একটা বস্তিতে থাকে। স্বামী রিকশা চালায়। সেই আয়ে তাদের সংসার মোটামুটি চলে যায়। সে কাজ করে শুধুমাত্র মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য। সীমা অবাক হয় এই ভেবে কাজের বুয়ার মেয়ে এতো বেতন দিয়ে প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। অথচ তাদের মত নিম্নবিত্ত ঘরের অন্য বাচ্চারা হয়তো পড়েইনা নয়তো কোনমতে সরকারী স্কুলে যাওয়া আসা করে। কিন্তু জমিলা খালার মনে যে অনেক স্বপ্ন তার একমাত্র কলিজার ধনকে নিয়ে!
সেদিন সকালে সীমাদের বাসায় কাজ করতে এসেই কাচুমাচু করে বলল,
'আফা, কাইল আইতে ফারুম না। একটু ম্যানেজ কইরা নিয়েন।'
সীমা তো অবাক। এতো বছরে খুব বড় অসুখ বিসুখ ছাড়া খালা একদিনও কাজ কামাই দেয়নি। তাই জিজ্ঞেস করল,
'কি হয়েছে খালা? কোন সমস্যা?'
খালা লজ্জাবনত মুখে বলল,
'কাইল আমার মাইয়ার স্কুলে অনুষ্ঠান। শাবানা নাইচব।'
সীমার চোখ তো কপালে। 'তোমার মেয়ে নাচতে পারে খালা?'
খালা উদ্ভাসিত হাসিতে উত্তর দেয়,
'হ আফা। আফনাগো এইহানে কাম কইরা যেই ট্যাকা ফাই হেই ট্যাকা দিয়া অরে নাচ শিখাই। আফা আফনে আইবেন আমার মাইয়ার অনুষ্ঠানে? আইলে আমি অনেক খুশি হমু।'
জমিলা খালা বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে যায়। সীমা বলে,
'আমার তো ক্লাস থাকে খালা। তবুও চেষ্টা করব….। আর আপনার কাল আসতে হবেনা।'
খালা তৃপ্তির হাসি দিয়ে ঘর মোছা শুরু করে।
সীমা জমিলা খালার মেয়ের অনুষ্ঠানে যেতে পারেনা। কাজের বুয়ার মেয়ের নাচ দেখতে যাওয়া যায়না। যাবার নিয়ম নেই। সীমা কল্পনার চোখে দেখতে পায় স্কুলের বিশাল বড় মঞ্চে শাবানা পরীর মত উড়ে উড়ে নৃত্য পরিবেশন করছে। জমিলা খালা আর তার স্বামী সাজগোজ করে দর্শকের কাতারে বসে আছে। চারপাশে হাততালি পড়ছে। তারা নিজেরাও তাতে যোগ দিয়েছে। খুশিতে তাদের দু'জোড়া চোখ চকচক করছে। চোখের কোনে কি একটু আনন্দাশ্রুও জমা হয়নি? সমাজের এই নিচুস্তরের মানুষের বড় মন দেখে সীমার মন শ্রদ্ধায় ভরে যায়। তাদের সন্তানের প্রতি স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা দেখে ভেতরটা প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। যারা সমাজের উঁচুস্তরের বলে দাবী করে তাদেরই কজন মনের এত উদারতা দেখাতে পারে, এমন গভীর ভালোবাসার নিদর্শন রাখতে পারে!
১০.০১.২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৩১