১.
অফিস যাওয়া আসার পথে, সিঁড়ির মুখে দুবেলাই দেখা হয়, সোম থেকে শুক্র, পান খাওয়া মুখে হেসে, হাত জোড় করে জিজ্ঞাসা - দিদি ভালো আছেন? ফেরার পথেও সেই সৌজন্যসূচক হাসি। মধ্যবয়সী লোকটির এই অযাচিত সৌজন্যে প্রথমদিন হকচকিয়ে গেলেও, এখন সামলে নিয়ে, আমিও ঘাড় নাড়ি, হাসি। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে যায় আর হাসি বিনিময় এক অভ্যাসে পরিণত হয়।
আমি এক সরকারি অফিসের বেসরকারি ঠেকা কর্মী, গালভরা নাম কন্সালটেন্ট, মাইনেপত্র ভালো কিন্তু নেহাতই অনিশ্চিত চাকরি। এই আছে তো এই নেই। সব বড় কর্তাদের মন যুগিয়ে, নিজের জ্ঞানগম্যিকে শিকেয় তুলে, জীবিকার তাগিদে নিত্যকার রোজনামচা। আমাদের মস্ত অফিস, অনেক বড় ক্যাম্পাস, বহু মানুষের আনাগোনা। এরই মাঝে একজন হলেন এই পান খাওয়া দাদা। আমি তার নাম জানার চেষ্টা করিনি কোনদিন, ঘটনাচক্রে জেনেছিলাম, অনেক পরে, যখন তার সাথে আর দেখা হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই আমার
স্মৃতিতে তিনি ওই পান (খাওয়া) দাদা।
২.
একদিন বিকেলে সিঁড়ি দিয়ে নামছি, সামনে পান-দাদা, সেই জোড় হাত, মুখে হাসি। পাশে এক মাঝবয়সী মহিলা, পরনে শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। বলে দিতে হয় না, গ্রাম থেকে সদ্য এসেছেন শহরে, সারা গায়ে এক গ্রামজ সংকোচ জড়িয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে।
- আমার পরিবার, নিয়ে এলাম এখানে, দেশে একা একা থাকে; আলাপ করালেন দাদা।
এরপর থেকে সৌজন্য বিনিময় তালিকায়, যুক্ত হল নতুন আরেক মুখ, যুগল মুর্তি। দাদা - বৌদি। বেশ চলছিল, কিন্তু একদিন ছন্দপতন হল। এক সোমবার অফিসে ঢোকার মুখে দেখি শুধু বৌদি একা বসে, যন্ত্রর মত হাত জোড় করে নমস্কার করলেও, মুখে পরিচিত হাসিটুকু উধাও।
- দাদা কোথায়? এই প্রথম আমি কোন কথা বললাম এঁদের সাথে। হতাশ চোখ তুলে,
উড়িষ্যার টানে বাংলায় বললেন
-বড় বাবু ডাকছিল, দেখা করতে গেছে, খুব জরুরী। এতদিন পড়ে এই প্রথম বুঝলাম, এঁরা উড়িষ্যা থেকে এসেছেন। মহিলার অসহায় মুখ উপেক্ষা করে আজ সিঁড়ি ভেঙে উঠে যেতে পারলাম না। সিঁড়ির ধাপেই কাঁধের ব্যাগটা রেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কোন বড়বাবু? কেন ডেকেছে? উত্তরে দুহাত উলটে বোঝালেন বেশি কিছু জানা নেই, তবে দুশ্চিন্তার ব্যপার সেইটুকু স্বামীর মুখ দেখে আভাস পেয়েছেন।
আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়? দুএক কথায় আলাপ জমানোর চেষ্টা করলাম, কেন জানিনা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মহিলাকে একা ফেলে চলে যেতে মন চাইছিল না, কৌতূহলও কাজ করছিল খানিকটা। - -আমাদের বাড়ি ভদ্রকের কাছে,
আমি : বাড়িতে কেউ নেই?
- না গো গ্রামটাই যে আর নেই, মস্ত মাছের কারখানা হয়েছে সেখানে।
আমি একটু থেমে: তাহলে আপনারা থাকতেন কোথায়? জানালেন ঠাঁই হয়েছিল ভদ্রকে এক গ্রাম সম্পর্কে পরিচিত দিদির বাড়িতে, ওরাও গ্রাম ছেড়ে শহরে বস্তিবাসী, ঠিকা শ্রমিক। কথায় কথায় জানলাম, বৌদির নাম লতা পাত্র। দাদার নাম ওনার মুখে আনতে নেই, তাই আর জানা হল না। দাদা এই অফিসে কিছু একটা চাকরি করেন, তাই তারা দুজনেই এখন কলকাতাবাসী। এসব কথার ফাঁকেই দাদা ফিরে এলেন, মুখে স্বস্তি। যথারীতি হেসে, নমস্কার করলেন। তারপর নিজেদের ভাষায় স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন,
"কিছু চিন্তা কর না, সব ঠিক করে এলাম, তোমায় বলেছিলাম না বড়বাবু আমায় খুব পছন্দ করে। যাও যাও ভাত রাঁধো, আমি ঘুরে আসি।"
হেসে বিদায় নিলেন দাদা। আমিও কাঁধের ব্যাগটা পিঠে ফেলে সিঁড়ি ভাঙার জন্য প্রস্তুত। ওঠার মুখে লতা বৌদির ডাক, 'দিদি একটু প্রসাদ খেয়ে যাও'। আজ সকালের পুজোর সময় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, ঠাকুর আর বাসা ছাড়া কর না। ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন।
৩.
বাসা, এখানে? মাথামুণ্ড কিছু না বুঝেও আমি বৌদির সাথে গেলাম। কি আশ্চর্য, এতদিন চোখেও পড়েনি, আমার প্রতিদিনের যাতায়াতের সিঁড়ির তলার ঘুপচি তেকোনা জায়গায় এদের আশা ভরসার বাসা। পরিপাটি করে পরিষ্কার করা, কোনটুকু, এত বড় সরকারি অফিসের সার্বিক অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের সাথে বড়ই বেমানান। বরং কোন গরীব গৃহস্থর গৃহস্থালির সাথেই মিল বেশি। পরিচ্ছন্ন ভাবে একপাশে গোছানো স্টোভ, দুচারটে বাসনকোসন, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, একপাশে গুটিয়ে রাখা মাদুর, বালিশ বিছানা, ছোট্ট দেয়ালে জগন্নাথদেব বিরাজমান। সেই ছবির ফুল আর সামনে ছোট কাঁসার পাত্রে রাখা গুটি কয়েক বাতাসার একটা আমার হাতে গুঁজে দিলেন বৌদি। আমি তখনো অবাক হয়ে তার সংসার দেখছি, যেন শূন্য থেকে আবির্ভূত একটুকরো স্বপ্ন, নীড়।
অফিসে আর দেরী করা সম্ভব না, আস্তে আস্তে উপরের সিঁড়ি ভাঙতে থাকলাম। মনের কোনায় ঐ বাসা, কেন জানিনা বাসা বাধল।
এরপর যেতে আসতে উঁকি মারতাম, বৌদির বাসায়। টুকিটাকি ঘরের কাজে ব্যস্ত গৃহলক্ষ্মী; দৃশ্যটা আমার ভারি ভালো লাগত। দুর্দ্ধর্ষ গতিতে ধাবমান শহরের অফুরন্ত চাওয়া, পাওয়া ও আরো চাওয়ার মাঝে এক যতি চিনহ। এক সব পেয়েছির মায়া রাজ্য। এই দম্পতির মুখে সেই সব পাওয়ার প্রশান্তি, তাদের ঘরকন্নাতে তারই স্থায়ী ছাপ।
৪.
মাঝে লম্বা পুজোর ছুটি পড়ল, শেষদিন অফিস থেকে বেরুনোর মুখে, দেখি কর্তা গিন্নি, সামনের লনে বসে, -পুজোয় কি কলকাতাতেই থাকবেন? নিয়মমাফিক শিষ্টাচারের কথা জিজ্ঞাসা করলাম, গেটের দিকে এগুতে এগুতে, হ্যাঁ দিদি বাসা ফেলে কোথায় যাব? বৌদির গলা, ফিরে দেখি দাদার মুখে সম্মতির হাসি। সেদিন ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বসে অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক ছিলাম। আমি নিজে নীড় ভাঙা নারী, সে নিয়ে আক্ষেপ তো নেইই বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শাসনের ভ্রুক্ষেপ না করে, ফুরিয়ে যাওয়া সম্পর্ক ছিন্ন করে, একা মাথা উঁচু করে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি, এ এক প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল আমার। সেদিন এক লুকিয়ে রাখা দুর্বলতা, অপূর্ণতাবোধ, শারদ মেঘের থেকে হঠাৎ ঝেঁপে আসা বৃষ্টির মত মনের মধ্যে ঝরতে থাকলো, মনের আকাশ তাতে মেঘমুক্ত হয়ে নির্মল নীল হয়ে উঠলো জেন। অজানা কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল, কোন এক অস্বীকৃত, অমীমাংসিত অধ্যায়কে স্বীকৃতি দিয়ে যেন বন্ধ করতে পারলাম অবশেষে।
৫.
প্রায় মাস দুয়েক পরে আবার অফিসে ঢুকছি, সেই একই ঘর, বাড়ি, বাগান, দারোয়ান। কিন্তু এক সুক্ষ পরিবর্তনের গন্ধ পেলাম। শম্ভু দারোয়ানের পোশাক আজ যেন একটু বেশি ফিটফাট! লনে একটাও আগাছা চোখে পড়ল না। বিল্ডিংএর একদিকে রঙ মিস্ত্রি কাজ করছে। সব মিলিয়ে আজকালকার ভাষায় স্বচ্ছতা অভিযনের জীবন্ত বিজ্ঞাপন। আবর্জনা, বাহুল্য ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হচ্ছে। মনটা ফুর ফুরে হয়ে গেল। যাক অন্তত এতদিনে কেউ পরিচ্ছন্নতার কদর করল।
চারপাশ দেখতে দেখতে কখন সিঁড়ির মুখের কাছে এসে গেছি, অভ্যাসবশত বৌদির বাসায় উঁকি দিলাম, কিন্তু একি, সব ফাঁকা, ঝক ঝক করছে পরিষ্কার। এতক্ষনে খেয়াল হল, তাইতো বাইরে তো দাদা - বৌদি কেউই নেই! মুহূর্তে এক আশংকায় মন আচ্ছন্ন হল। দ্রুত পায়ে অফিসে ঢুকলাম। বেয়ারা রতন জল দিতে এল নিয়মমতো। রতন নীচের ওরা কোথায়? আমার গলায় চাপা উদ্বেগ। রতন সামান্য অবাক হল,
-কারা দিদি? মনোহরদারা?
-আহ ঐ লতা বৌদিরা,বুঝতে পারছো না? ঐ যে সিঁড়ির নীচের বাসা...
- ও মনোহরদা, তা ওরা তো চলে গেল দিদি, যাওয়ার আগে আপনাকে খুঁজছিল মনোহরদা, আপনি তো ছুটিতে ছিলেন।
আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না, সন্দেহমাখা গলায় আবার জিজ্ঞেস করলাম কোথায় গেল ওরা? ওদের তো এখানে আর কেউ নেই!
-সে কি জানি দিদি। সিকিউরিটির নতুন বড় সাহেব এসেছেন, ক্যাম্পাস পরিষ্কার হচ্ছে। সব ঝাঁ চকচকে চাই। প্রথমদিনেই উনি বলে দেন, এসব এখানে ওখানে ঘাঁটি গেড়ে থাকা যাবেনা। এটা অফিস। খুব কড়া লোক। মনোহরদার জন্য খারাপই লাগছিল, হাতে পায়ে ধরেও কিছু করতে পারল না, মাঝখান থেকে ক্যান্টিনে ঠিকের কাজটাও গেল। এই তো তিন সপ্তাহ মত হল, সবাইকে শুভ বিজয়া করে মনোহরদারা চলে গেল।
৬.
সন্ধ্যে হল, অফিস ছুটির সময়, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শূন্য 'বাসাটার' দিকে অভ্যাসবসে চোখ চলে গেল। এক অজানা শূন্যতাবোধে আমায় জড়িয়ে ধরল। দাদার সেই কথা - কোন চিন্তা নেই, বৌদির সেই মানত পূর্ন হওয়া প্রসাদের স্বাদ, স্মৃতিপথে ভিড় করে এল। বাসা যে এত ঠুনকো হয়, সেকি আমি জানিনা? তবু কেন এদের বাসার মধ্যে আমি এক শান্তিময় স্থায়িত্ব খুঁজেছিলাম!
- চেনা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো। রওনা হওয়ার সময় মনে হল শূন্যতা ভেদ করে, দুটি হাসি মুখ জোড় হাতে বিদায় জানাচ্ছে আজো। মনে মনে দুজনের উদ্দেশ্যে বললাম শুভ বিজয়া, তোমরা আবার কোন আস্তাকুঁড়কে হয়ত বাসায় রূপান্তরিত করেছ, তোমাদের বাসার স্বপ্ন অক্ষয় হোক।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:২৫