এক
গেট বন্ধ হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে ছিল উমা। মাটির সাথে কে যেন পা দুটি গেঁথে দিয়েছিল কাবেরীর। শেষবারের মত দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছিল তার প্রাক্তন দত্তক কন্যাকে। সরকারী নিয়ম মেনে, উমাকে আজ সরকারী অনাথাশ্রমে ফিরিয়ে দিয়ে গেল সে। শেষ বিদায়ের কালে, মনে পড়ছে প্রথম দেখার ক্ষণটি। সেদিন আর আজ, মাঝে মাত্র কয়েকমাস কিন্তু কেন মনে হচ্ছে জীবনের এক অধ্যায়কে এখানে রেখে যাচ্ছে কাবেরী।
সারাটা যাত্রাপথেই উদাসীন ছিল ১০ বছরের উমা। তবে সারাটা পথই কাবেরীর হাত ধরেছিল শক্ত করে, ঠিক প্রথম দিনের মত, যেদিন প্রায় অজানা, অচেনা কাবেরীর সাথে হাসিমুখে হাতধরে অনাথাশ্রম ছেড়েছিল উমা। সেদিনের মতই আজো নির্বাক ১০ বছরের মেয়েটি। কিছুটা নিরুত্তাপ। কিছুটা বিষণ্ণ - নাকি সেটা কাবেরীর কল্পনা?
দুই
মধ্য চল্লিশের কাবেরীর ঘর সংসার মূলত নিজেকে ঘিরেই, আর জীবন বলতে, গ্রামে থাকা মা, কাজ ও হাতে গোনা কিছু বন্ধু। প্রায় ১৫ বছর আগে বিবাহবিচ্ছিন্না কাবেরী, কাজকেই জীবনের ধ্যান জ্ঞান করে নিয়েছিল। কোন অবসাদ, কোন আক্ষেপ বা অপূর্ণতাকে সে আমোল দেয়নি কোনদিন। মা, বাবার সাথে, দিব্বি কাটছিল দিন, কিন্তু দিন তো সমান যায় না। হঠাৎ এক রাতে, যেদিন বিলকুল বিনা নোটিশে বাবা বিদায় নিলেন, সেদিন এক নতুন পৃথিবীর সাথে আলাপ হল তার। তবুও হাল ছাড়েনি সে। উত্তাল ঢেউ পার হয়ে তাদের ছোট্ট নৌকোকে শান্ত মাঝ দরিয়াতে নিয়ে এসেছে একা হাতেই। কিন্তু তখন থেকেই মাথায় এক নতুন চিন্তা ঘুরতে শুরু করে। উত্তরাধিকার - কে ধরবে তার সযত্ন লালিত তরণীর হাল? বন্ধুরা অনেকেই দত্তকের কথা বলেছিল, প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে, কথাটা মনে ধরে তার। একদিন অনলাইনে জমা করে দেয় আবেদন। কিছু মাস পরে ডাক আসে, আর সেই প্রথম উমার সাথে দেখা এবং প্রথম দর্শনেই ভালো লাগা। ভারী শান্ত, প্রায় নির্বাক মেয়েটির বিশাল দুই চোখেই যেন ছিল সকল ভাষা। পরের আইনি ধাপ পাড় হতে বেশি সময় লাগেনি। অবশেষে একদিন তার হাত ধরে উমা নির্দ্বিধায় হাঁটা দেয় এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে, তাদের যৌথ ভবিষ্যৎ।
তিন
কিন্তু এবারো বিধি বাম। চার মাসের নিরন্তর চেষ্টাতেও উমা তার অধরাই রয়ে গেল। নতুন পরিবেশকে একরকম মানিয়ে নিলেও, মন থেকে মেনে নিতে পারল না সে নতুন পরিবারকে। নিজের চারধারে এক অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রাখলো উমা। কোন কাউন্সেলিং বা মনোবিদের সাহায্যই কোন কাজে এল না। তাই আবার সরকারি নিয়ম মেনে ফিরিয়ে দেবার পালা। আজ সেই সফর শেষ। অনাথাশ্রমের মস্ত কালো গেটটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
ফেরার বাসে বসে কাবেরী আনমনা। মন ভারাক্রান্ত। যে অপূর্ণতাকে সে সারা জীবন পাত্তা দেয়নি, চারমাসে, উমা তাকে সেই অপূর্ণতা বোধে বিদ্ধ করেছে, অজান্তেই। কাবেরী কি হেরে গেল? কতবার হেরে যাবে সে? কেন সে সম্পর্ক গড়তে গেলেই বারবার ব্যর্থ হয়? তাহলে কি বিবাহবিচ্ছেদের জন্যও সেই দায়ী? সেই দায়ী নিজের মা, বাবার সাথে সুক্ষ মনোমালিন্যর জন্য? সেই দায়ী উমার মানিয়ে নিতে না পারার জন্য? সম্পর্কের শব ব্যবচ্ছেদ করে মনে মনে ক্লান্ত হয়ে পরে সে; সত্যিই অকূলদরিয়া, ভেবে কোন কূল পায় না কাবেরী।
আর ঘন্টাদুয়েক পরে তার এই বাস যাত্রা শেষ হবে, তারপর ট্রেন, তারপরে রোজকার রোজনামচা। এবারো বন্ধুরা বলেছে 'শক্ত হ, দত্তক কি সবসময়ে সাক্সেস্ফুল হয়?' এই সবই সান্ত্বনার কথা। ঠিকই তো যুক্তি দিয়ে ভাবে কাবেরী। উমা যখন মানাতে পারলোই না, ওকে জোর করে ধরে রেখে কি লাভ। শুধু একটাই আক্ষেপ, উমাকে সে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারল না। পারলো না কথা রাখতে।
চার
চলে যাওয়ার তিনদিন আগে, একদিন ভারী সহজ হয়ে উঠেছিল মেয়েটা। অনেক গল্প করেছিল উমা। কোথায় সে যেতে চায়, তার মনের কথা। দুই অসমবয়সী বন্ধু সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছিল ছাদে বসে। উমা বাড়ি ফিরতে চায়, নিজের বাড়ি। যেখানে ওর ঠাম্মা ও দাদু নিশ্চই এখনো ওর পথ চেয়ে অপেক্ষায়; যে মাটির বাড়ির ছোট্ট খুপরিতে বাবার কোল ঘেঁষে সে ঘুমাতো; যে বাড়ির উঠানে, জলে ডুবে মরে যাওয়া উমার মা কে এনে সবাই পায়ে আলতা পড়িয়ে দিয়েছিল; যে বাড়ি থেকে তার বাবা একদিন কাউকে না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়; সেই ঘরে, সেই ঠিকানায় ফিরতে চায় উমা। ঠাম্মার কোলে মুখ গুঁজে স্বপ্ন দেখতে চায়, একদিন তার বাবা ফিরে এসেছে, আবার আগের মত তাকে কোলে নিয়ে আদর করে ঘুম পাড়াচ্ছে। ঘরের এক কোনে হাঁড়িতে ভাত ফোটাচ্ছে ঠাম্মা, সেই সুঘ্রাণ মেখে, সেদিন শুধু সেদিনই শান্তিতে ঘুমাবে সে। বর্তমান তার কাছে দুঃস্বপ্ন। অনাথাশ্রম আর কাবেরীর ফ্ল্যাট দুই সমান। অনাথাশ্রমটা তাদের বাড়ির কাছে এই যা। অভাবের তাড়নায় ঠাম্মা তাকে যেদিন অনাথাশ্রমে রেখে গেল, সেদিন থেকেই চুপ করে গেছে উমা। একান্ত দরকার ছাড়া মুখ খোলেনি, খোলা চোখে চারপাশের বাস্তব নয়, ভবিষ্যৎ এর স্বপ্নই সে দেখতে চেয়েছে, স্বপ্নে তার মাটির ঘরে নেমে আসে সোনালি ভবিষ্যৎ। কাবেরীই প্রথম, যাকে এত কিছু অনর্গল বলে গেল সে। কাবেরী তার বন্ধু যে। হেসেছিল কাবেরী, মনেমনে। সত্যিই তার বন্ধু ভাগ্য ভালো, চিরকাল। এই একটি সম্পর্ক স্থাপনে সে কোনদিন ফেল করলো না, কেন? কে জানে।
সেদিন উমাকে কথা দিয়েছিল, সরকারকে বলে, ওকে ওর ঠাম্মার কাছে ফিরিয়ে দেবে, ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব তার। কথা রাখতে পারেনি কাবেরী। সরকারি নিয়মের জাল কেটে উমার মুক্তি নেই, যতদিননা সে প্রাপ্তবয়স্কা হচ্ছে। কাবেরীর আবেদন পাত্তাই পায়নি সরকারের নিয়মের কাছে। অমোঘ নিয়ম। উমা ফিরে গেছে অনাথাশ্রমে, নিজের অনিচ্ছাতেই। তাই কি শেষ বিদায়ের সময় উমার দুচোখে ছিল অভিমান আর মৃদু অভিযোগ? নীরব দুচোখ যেন বলছিল, তুমিও? তুমিও কথা রাখলে না?
বাসের জানালায় মাথা রাখে কাবেরী, জীবনে বেশীর ভাগ কথাই রাখা যায় না, রাখা হয়ে ওঠে না, সেটা ১০ বছরের উমাকে কে বোঝাবে?
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৫:৩৭