এক
এই বস্তিতে নতুন ঘড় ভাড়া নিয়েছে রমা। স্বামী ছবি, ভ্যান চালায়। একমাত্র মেয়ের শশুড় বাড়ি এখান থেকে কাছেই। জামাই রতন লোকাল রুটে অটো চালায়। পার্টির বাবুদের সাথে খুব চেনা জানা তার। সব মিটিং মিছিলে তার অটো পতাকা লাগিয়ে রেডি থাকে সবার আগে। রমার আগে এসব পছন্দ ছিল না। এই দলাদলি, দলবদল। জামাই একদিন বোঝায়, - মা এ যুগে খেটে খেতে গেলে দলে তো থাকতেই হবে, যখন যে দল রাজা, তাকে তো সেলাম করতেই হবে। রতনই পার্টির দাদাদের বলে এই বস্তিতে তাদের একটা মাথা গোঁজার ঘর খুঁজে দিয়েছে, এত অল্প টাকায় আর কোথাও ঘর মেলেনি। রমার স্বামীর কিডনির অসুখ। এক একবার ডাক্তার দেখানোর খরচই অনেক। তা সেই রতনই সরকারী হাসপাতালে বাঁধা ব্যবস্থা করে দিয়েছে, এমনকি রমার 'আশা কর্মীর' চাকরী পাকা করতেও সে সুপারিশ এনে দিয়েছে। জামাই ভাগ্য ভালো তার। আজকাল নিজের ছেলেও এত করে না।
তাই আর তর্ক করেনি রমা, আবার মেনেও নেয়নি রতনের রাজনীতি বোধ। মধ্যবিত্ত পরিবারের রমা কপালক্রমে আজ গরীব ঘরের ঘরণী। কিন্তু কৈশোরের পারিবারিক শিক্ষা, পরিবেশ এখনো তার মনকে ছেয়ে আছে।
দুই
রমার বাবা ছিল বামপন্থী দলের সক্রিয় কর্মী। মাও কম যেত না। স্থানীয় মহিলাদলে মাকে ছাড়া কোন কাজই হত না। ঘরে-বাইরে শুধু পার্টির গল্প। রাতের বেলা তাদের ভাড়া বাড়ির উঠোনে যখন জোছনা পড়ে নকশিকাঁথা বিছিয়ে দিত, বাবার পিঠে মুখ গুঁজে রমা বসে বসে শুনত মায়ের গলায় দিন বদলের গান - 'পথে এবার নাম সাথী'। বাবার খুব পছন্দের গান, মার কাছে বার বার ঐ গানটা শুনতে শুনতে রমাও গুন গুন করে গাইত। বাবা গলা মেলাত। গায়ে কাঁটা দিত রমার। এখনো সে কথা ভাবলে তার গায়ে কাঁটা দেয়।
বাবার কাছে কত গল্প শুনে বড় হয়েছে রমা। একমাত্র মেয়ে সে বাবার যেন বন্ধু ছিল। কত বিপ্লব, মানুষ, মিছিলের গল্প। তবে যেটা সব থেকে শুনতে ভালো লাগতো সেটা ঠাকুর্দার গল্প। তিনি পার্টির মস্ত নেতা ছিলেন। নিজের হাতে পার্টি তৈরি করেছেন, না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে আর পুলিশের মার খেয়ে। ১২ বছর জেলে ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য। রমা তাকে না দেখলেও, চিরকাল তার হিরো তার ঠাকুর্দাই, রমা তাকে দাদু বলে ডাকে।
- বাবা ইস্কুলে দাদুর ছবিতে স্বাধীনতা দিবসে মালা দেওয়া হয় না কেন?
ছোটবেলায় একবার জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল সে। বাবার চোখে কেমন এক ব্যথা ভেসে উঠেছিল।
-ইতিহাস যে পরনির্ভর, শাসক শ্রেণীই যে ইতিহাসকার, তুমি দাদুর আদর্শে যদি চল জীবনে তবে সেটাই হবে ওনাকে মালা দেওয়া। বাবার মৃদুস্বর।
সব কথা না বুঝলেও কোথাও একটা অন্যায় যে দাদুর সাথে হয়েছে সেটা সেই অল্প বয়েসেও রমা বুঝেছিল আর তাই আরো বেশি করে দাদুকে ভালোবাসে সে। দাদুর নামে যা বই পত্র সবই সে পড়ে ফেলেছিল কৈশোরেই। নতুন কিছু নেই, সব পুরনো বই। তাই সই। তাই বারবার পড়তো।
তিন
জীবন ভালো মন্দে কেটেই যাচ্ছিল। কিন্তু রমা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন সব পালটে গেল। বাবা প্রায়ই রাতে বাড়ি ফিরতো না। মা চিন্তিত মুখে জেগে থাকতো। পার্টির কাকুরা আর তেমন বাড়িতে আসতো না, তাদের এড়িয়ে চলত। মা বলেছিল বাবা মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে গেছে। রমার যেমন ভয় করত তেমনি গর্বও হত। একদিন বাবার খোঁজে বাড়িতে পুলিশ এল, সব তছনছ করে চলে গেল তারা। রমা আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখলো। পুলিশ তো চোর ডাকাতদের ধরে, তাদের বাড়িতে পুলিশ কেন? মা বলল -পুলিশ তো নেতাদের গোলাম, যাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোর বাবা পথে নেমেছে।
এর পরের রাতে শেষবার বাবা বাড়ি আসে, ক্লান্ত। অনেকদিন অভুক্ত থাকা মানুষের মত ভাত খায় তৃপ্তি করে। মা ও রমা সামনে বসেছিল। খাওয়ার পরে রমার মাথায় হাত রেখে আদর করে, মাকে আড়ালে গিয়ে কি সব বলে। তারপরেই বেড়িয়ে যায়। আর ফেরেনি। কোনদিন না। চার দিন পরে আবার পুলিশ আসে। মাকে নিয়ে যায়। তারপরে আর মাও ফিরে আসেনি। পাশের বাড়ির ঝুমা মাসি এসে রমাকে নিয়ে যায় একদিন পরে। সেই গোটা একদিনের উৎকণ্ঠায় ভরা একলা থাকাটা যে তার সারা জীবনের একাকীত্বের ইংগিত, ক্লাস সেভেনে পড়া রমার সেটা বোঝার বয়স তখন কি আর হয়েছিল?
এরপরে সরকারি অনাথালয়ে থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ। ওরাই গণবিবাহ অনুষ্ঠান করে রমা ও আরো পাঁচ জনের বিয়ে দেয়, খাতায় পাকা কালিতে রমার সামাজিক পুনর্বাসন সম্পূর্ণ হয়।
চার
এখন চল্লিশের শেষে এসে গৃহিণী রমার কোন বিশেষ আক্ষেপ বা চাহিদা নেই। একটা সখ আছে, খবর কাগজ পড়ার। পাশের বাড়ির বাসি কাগজ চেয়ে এনে আজো পড়ে রমা। সময় কেটে যায়, দিনগত পাপক্ষয়।
ঘরের ভিতর থেকে আসা ছবির গলার আওয়াজে নড়েচড়ে বসে রমা, হাঁড়ির ভাত ফুটছে, ছবি গামছা চাইছে, চানে যাবে। বাস্তবে ফিরে আসে রমা, মৃদু হাসে। এই ঘরে বসে থেকে থেকে মনটা কোথায় চলে গেছিল। ঘরের কাজে মন দেয় সে।
বিকেলে রতন আসে, হাতে একটা টিনের বাক্স। মা এটা দেখুন তো আপনার কিনা। দাদুর নাম লেখা। রমা দেখেই চেনে, এই বাক্স তার বাবা যত্ন করে রাখত, সে দেখেছে ছোটবেলায়। ঝুমা মাসির সাথে চলে আসার সময় সে কিছুই নিয়ে আসেনি। কি অদ্ভুত সংযোগ, আজই ভাবছিল ছেলেবেলার কথা আর আজই এল এই বাক্স।
- হ্যাঁ রতন আমারই, কোথায় পেলে? উৎসুক সুরে সে জিজ্ঞেস করে। রতন চটপট ব্যাখ্যা করে, ক্ষমতায় আসা নতুন দল, আগের পার্টি অফিসের দখল নিয়েছে। আজ তারা পুরানো জঞ্জাল সাফ করছিল। অনেক অকাজের জিনিসের সাথে আস্তাকুঁড়ে স্থান হয় এই বাক্সেরও। রমার বাবার নামটা দেখে রতন তুলে এনেছে।
-ঐ কোনে রাখো বাবা, বোস, চা করি, বলে রমা চায়ের জল চাপায়। দুধ ফুরিয়েছে, লাল চা আর সকালে করা দুটো রুটি চিনি দিয়ে পরিবেশন করে সে। রতন চায়ে ভিজিয়ে, রুটি চিবায়। বলে
- মা, বাবাকে বলার তো মানে হয় না, আপনাকেই বলি, আপনার মেয়ের সখ, আপনার নাতিকে স্কাই হাইট ইংরেজি ইস্কুলে ভর্তি করবে, তা আমারো সেটাই ইচ্ছে। কিন্তু ভর্তি হতেই ৫০০০০ টাকা লাগবে বলছে। এখন আপনিই ভরসা। রমা চুপ করে শোনে, রতন যে উপকারের বদলে কিছু একটা চাইবে, এ ব্যপারে রমা নিশ্চিত ছিল, তা বলে, ৫০ হাজার!
- 'আমাদের অবস্থা তো তোমার অজানা নয় বাবা' মৃদু গলায় বলে রমা।
- তা তো ঠিকই মা, কিন্তু আপনার মেয়ে বলছিল আপনার কি একটা পোষ্ট অফিসের কাগজ নাকি ভাঙানোর সময় হয়ে এল...। রমা চুপ করে থাকে, অসহায়তা প্রসূত নিঃশব্দতা। আজ তার মুখের রক্ত তুলে রোজগার করা টাকায়, নিজের মেয়ে জামাইএর চোখ।
একদিনের জন্য যথেষ্ট হয়েছে, ভেবে রতন উঠে দাঁড়ায়, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে, আজ আসি মা, এরপরে রাত হলে আবার আপনার মেয়েই কুরুক্ষেত্র করবে। দোক্তা খাওয়া দাঁত বের করে হেসে সে বিদায় নেয়।
পাঁচ
রতন চলে যাওয়ার একটু পরেই ছবি ফেরে, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাকে ভাত বেড়ে দিয়ে, রান্নাঘরের খুঁটিনাটি গুছোয় রমা, মনটা তার পরে আছে ঐ টিনের বাক্সেই। রোজকার খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে, ছবি শুতে গেল। এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল রমা। কোন থেকে প্রায় নিঃশব্দে বাক্সটা বেড় করে নিয়ে আসে। বারান্দায় কুপিটা জ্বালিয়ে বসে বাক্স নিয়ে। রাতের আকাশ নিকষ কালো, মেঘ করে গুমোট পরিবেশ। কাঁপা হাতে বাক্সের উপর হাত বোলায় সে। যেন বাবার স্পর্শ, আঙুল দিয়ে শুষে নিতে চায়। ছোটবেলায় বাক্সটা তাকে টানতো এক অদম্য কৌতূহলে, কিন্তু বাবা কোনদিন বাক্সের ডালা মেলে ধরে নি। আজ সেই বাক্সের সে একমাত্র উত্তরাধিকারী।
বাক্সে তালা, তবে খুব জং ধরেছে। চাপ দিয়ে ডালা খুললো রমা, বিকট শব্দে বাক্স খুলে একদিক ডালা ভেঙে পড়ল। রমার সেদিকে নজর নেই। সে ভিতরের জিনিসে হারিয়ে গেছে। এক তাড়া, কাগজ, বেশ কিছু পত্র পত্রিকা, কিছু পুরানো খাম, ডাক টিকিট, দুটি কালির কলম, দোয়াতে শুকনো কালি, ব্লটিং পেপার। বেশির ভাগ খাতার মলাটে দাদুর নাম লেখা, বাবার লেখা খাতাও একটা আছে। দৈনন্দিন কতকিছু লেখায় ভরা খাতা, কত পরিকল্পনা, হিসেব, নাম, ঠিকানা। খাতা গুলি নামায় রমা। নেপথোলিন দিয়ে রাখতে হবে। খাতারও নীচে, রমা অবাক হয়ে দেখে চারটে মোটা ডায়েরী। পাতা উল্টায় সাবধানে, হলুদ হওয়া পাতা তার আঙুলের সামান্য চাপেই কিছুটা গুঁড়ো হয়ে যায়। যেন রমাকে কেউ সাবধান করে ফিসফিস করে। রমা পড়তে শুরু করে প্রথম পাতা থেকে।
ছয়
ধীরে ধীরে বাইরের আকাশ ফর্সা হয়ে আসে, টিমটিম করে কুপি জ্বলছে, আর সেই আধা অন্ধকারে, চারটে ডায়েরী পড়ার পরে জ্বলছে, রমার চোখ। তার সামান্য পড়াশুনোতেও সে বুঝতে পারে কি অমূল্য ঐতিহাসিক দলিল, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। ভাগ্যক্রমে রতন আজ সেই অমূল্য ধন তার ঘরে রেখে গেছে। দিশাহারা বোধকরে রমা। চারটি ডায়েরীর প্রতিটা পাতা এক উত্তাল রাজনৈতিক সময়ের সাক্ষী। যে ইতিহাস কোথাও প্রকাশ পায়নি, যা নিঃশব্দে নির্বাসিত হয়েছে কালের গহীনে, তা আজ তার সামনে মুর্তিমান। সেই ইতিহাসের আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে তার পরিবারের গৌরবময় অতীতও। যার কোন স্বীকৃতি তারা কোনদিন পায়নি, পাবে না। বাবা, মা যে সেই পারিবারিক মূল্যবোধের বলিকাঠে স্বেচ্ছায় শহীদ, এতদিনে আরো ভালো করে বোঝে রমা। চোখ ভিজে ওঠে তার। বর্তমান সরকারের আগের সরকার ও দল এই অমূল্য দলিল বাক্সবন্দি করে একধারে ফেলে রেখেছিল, পালটে দিতে চেয়েছিল নিজেদেরই জন্ম বৃত্তান্ত। আর নতুন রাজার কালে আর রাখ ঢাক নেই। সটান আস্তাকুঁড়ে ইতিহাসের সমাধি। সবাই এক, ভাবে রমা। লাল, নীল, সবুজ, গেড়ুয়া - সব এক। কে লিখবে এই ইতিহাস? কে পারবে শিরায় শিরায় উপলব্ধি করতে এই ধারাবাহিক পারিবারিক আত্মত্যাগ, তার নাতি কি পারবে হতে যোগ্য উত্তরাধিকারী ? স্কাই হাইটে পড়লে বড় হয়ে সে হয়ত পারবে বুঝতে, লিখতে, কিন্তু মন মানে না। নাহ তাতাই পারবে না। ছবি বা রতন তো এটা কাগজওলার কাছে কেজি দামে বেচেই দেবে। তার মেয়ে সীমার কাছেও সে কিছুই আশা করেনা। নিজের মনেই মাথা নাড়ে রমা। সারা রাত জাগা চোখে, সকালের সদ্য ওঠা নরম রোদও বড় কড়া লাগে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে।
সাত
সব কাগজ গুছিয়ে আবার বাক্সে ঢোকায় রমা। আঁচলটা দিয়ে বাক্সটা ঢেকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বড় রাস্তার পথে হাঁটা দেয় । প্রথম বাস ধরে কলকাতা যেতে হবে। সেখানে মাস্টারমশাই থাকেন, তার বাবার মাস্টারমশাই। অনেক বয়েস, কিন্তু স্মৃতিশক্তি ভালো। তিনিই একমাত্র মানুষ যাকে রমা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে। তার হাতেই তুলে দেবে এ সম্পদ। তিনিও হয়ত কিছুই করতে পারবেন না। তবু, তিনিই এর মুল্য বুঝবেন। বাবা, মা কে হারানোর পরে, মনের শান্তি যদি কোথাও পেয়ে থাকে রমা তবে তা মাষ্টারমশাইএর সান্নিধ্যতেই। প্রতিদান তো কোনদিন দিতে পারবে না সে, এই বাক্সটাই হোক তার শ্রদ্ধার অর্ঘ্য।
রাস্তার এক প্রান্তে নীল রঙের বাসটা দেখা যাচ্ছে। ভোরের আলোয় জেগে উঠছে শহরতলী। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে, প্রস্তুত হয় রমা, এতদিনে, জীবনের এক লক্ষ্য, বেঁচে থাকার এক দিশা পেয়েছে সে। তার নাতির প্রজন্মকে ইতিহাসের উত্তরাধিকার থেকে সে বঞ্চিত হতে দেবে না। কোনমতেই না।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৩