১.
ডেস্কটপ কম্পিউটারের পর্দায় টিং করে নোটিফিকেশনের আওয়াজ। ব্যালেন্সসীটের জটিল জগত থেকে, মুখ তোলে সোমা, সামনের স্ক্রিনে চোখ রাখে, চ্যাট বক্সে প্রীতমের হাসিহাসি মুখের ছবি
- হাই, বিজি? একটা কৌতূহলী কুকুরের স্টিকার!
- কাইন্ড অফ ছোট্ট উত্তর সোমার
- টেক আ ব্রেক ডিয়ার, একটু ভিডিও চ্যাটটা খোল না প্লীজ
- আহ প্রীতম আমার ওয়ার্কিং আওয়ার, বস দেখলেই...
- জাষ্ট ফর আ মিনিট, তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
- না এখন না, আর এই আমার মুখ দেখতেই তো পাচ্ছো, তুমি তো লাইভ ভিডিও তে আসো না কখনো।
- এই আর ইউ এংগ্রী উইথ মি? তুমি জানোনা সোনা আমার ফার্ম খুব কড়া, ধরলেই চাকরী নট।
- এখানেও কড়াকড়ি সোমার কিবোর্ড টিপে জবাব
- আচ্ছা আজ রাতে ফোন করি? তখন তো ফ্রি থাকবে, প্রীতম নাছোড়বান্দা।
স্ক্রিনের ইমোজিতে চোখ টেপা, জীভ ভেংচানো কুকুরের স্টিকার পাঠিয়ে, চট করে অন্য উইন্ডো খোলে সোমা, বসের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রীতম কত আপন এক মানুষ, অথচ আজ থেকে চার মাসে আগে কেউ কাউকে চিনতো না। ভাগ্যিস অনলাইন ডেটিং সাইটে মধু জোর করে সোমার একটা প্রোফাইল খুলে দেয়। আপত্তি করেছিল সোমা,
- কি করছিস, এই সব বেশিরভাগ জালি একাউন্ট
মধুর চটজলদি জবাব
- তুই আর কি খাঁটি প্রেম করতে যাচ্ছিস? একটু আধটু ফ্লার্ট করে দেখ, স্ট্রেস বাস্টার। নিমরাজি সোমা এরপরে মাঝে মাঝে ঐ সাইটে গিয়ে ঘোরাঘুরি করত। না মধু মিথ্যে বলেনি, সত্যিই মনটা হালকা লাগে। একসময় আবিষ্কার করল ঐ সাইট দেখা তার প্রতিদিনের কাজের থেকেও বড় নেশা হয়ে উঠেছে, কখন তারই অজান্তে। যাই হোক প্রথমে তেমন আড্ডা জমেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে সেও পাকা ইউজার হয়ে উঠলো। এরকমই এক সময়ে, প্রীতমের প্রথম মেসেজ রিকোয়েস্ট আসে। তারপরে সময় জেন ডানা মেলে উড়ে চলেছে, স্বপ্নবৎ। খালি একটাই আশংকা যদি কোনদিন স্বপ্ন ভেঙে যায়? যদি স্বপ্ন দুঃস্বপ্নতে পরিণত হয়! মাঝেমাঝে এই চিন্তার পোকারা মাথায় কিলবিল করে সোমার; কিন্তু প্রীতমকে যত বেশী চিনছে, ততই স্বচ্ছন্দ বোধ করছে সে। নিজের অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য মনে মনে নিজেকেই ধমক দেয় সোমা।
২.
বুধবারের পার্কস্ট্রীট, রাত দশটা, প্রীতম আরেকটা ড্রিংক অর্ডার দেয়। ঘড়ি দেখে উশখুশ করে সোমা, এখনই রওনা না হলে, বাড়ি ফিরতে তার মাঝরাত পেরিয়ে যাবে, সে থাকে শহরতলিতে। পাড়াটা মধ্যবিত্ত, সারাক্ষণ পরনিন্দা ও পরচর্চা লেগেই আছে। সেখানে রাতদুপুরে প্রীতমের গাড়ি থেকে নামলে, পাশের বাড়ির মঞ্জুলা বৌদি পুরো এক সপ্তাহের খোরাক পাবে। সোমা পাত্তা না দিলেও তার পরিবারের কথা ভেবে, পুরো অগ্রাহ্যও করতে পারেনা, এইসব মরাল পুলিশিং। অগত্যা প্রীতমকে খোঁচায় সে,
-চল এবার উঠি, কাল অফিস
প্রীতম নির্বিকার মুখে আরেকটা সিগারেট ধরায়, লম্বা সুখটান দিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে, হুইস্কিতে চুমুক দেয়। নেশায় মগ্ন চোখ সোমাকে জরিপ করে।
-সোমা আজ না হয় নাই গেলে বাড়ি
- পাগল হলে নাকি প্রীতম,কি বলছ এসব?
- কেন, অফিসের ট্যুরে তো বাইরে যাও তুমি? প্রীতম যুক্তি সাজায়, বাড়িতে ফোন করে বলে দাও হঠাৎ জরুরী কাজে আজ বাইরে যাচ্ছ।
- এভাবে হয় নাকি? ট্যুর প্ল্যান আগে থেকেই বাড়িতে বলা থাকে আমার, চল ওঠ।
-আমার কথা বাড়িতে বলনি! আমি তোমার প্ল্যানে নেই? ইউ ডোন্ট এটাচ এনি ইমপরটেন্স টু মি সোমা। অভিমানে গাঢ় গলা প্রীতমের।
অস্বস্তিতে আর দোটানায় পড়ে সোমা, কি করবে সে?
- ইউ ডোন্ট বিলিভ মি, ডু ইউ? প্রীতমের তির্যক প্রশ্নবাণ।
- ডোন্ট বি সিলি, এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসছে কেন, ট্রাই টু বি প্র্যাক্টিকাল। তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারবে না। এই সমাজে মেয়ে হয়ে তো জন্মাও নি, সোমা ব্যাখ্যা করে।
- সমাজ আগে না আমি আগে? ছোটদের মত জেদি স্বর প্রীতমের। বাকবিতণ্ডাতে সময় ফুরিয়ে যায় আরো খানিকটা।
- ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা, এখন বাড়ি ফেরাটাও কম রিস্কি নয়, মনে হয় সোমার। বিরক্ত মুখে, সাইডব্যাগ হাঁতড়ে মোবাইল বের করে,মার নম্বর ডায়াল করে। ওপাশে রিং হচ্ছে, তপনের মা ফোন ধরল, সোজা কাজের কথায় চলে আসে সোমা,
- মাকে দাও
- মাসীমা শুয়ে পড়েছে, মাথা ব্যথাটা বেড়েছিল তাই,তুমি কখন আসবে গো দিদি। আমি জেগেই আছি।
আজ ফিরতে পারব না, অফিসের কাজে বাইরে এসে আটকে গেছি। মাকে বলে দিও চিন্তা না করে আর তুমিও খেয়ে শুয়ে পড়। ফোন কেটে দেয় সোমা। প্রীতমের দিকে তাকায়, সে একদৃষ্টে তাকেই দেখছে। এক অজানা ভালোলাগা আচ্ছন্ন করে সোমাকে। অহেতুক সেন্টিমেন্ট ঝেড়ে ফেলতে, সে লম্বা চুমুক দেয় সুইমিং পুলে, এটি তার ফেভারিট ককটেল।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল সোমার। অচেনা পরিবেশে সে কোনদিনই ভালো করে ঘুমাতে পারে না। মাথাটা অসম্ভব ধরে আছে, এক কাপ কফি পেলে ভালো হত। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে উঠে বসে সে। এক লহমায় কাল রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে যায়। তার পাশেই শুয়ে প্রীতম এখনো গভীর ঘুমে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সোমা
- ভুল হয়ে গেল কি? কিন্তু এই ঘুমন্ত মুখ কি ভীষণ নিষ্পাপ, নাহ প্রীতম তাকে ঠকাবে না, সেও সারা জীবন প্রথম রাতের মতই আদরে ভরে দেবে ওর জীবন, তাদের দুজনের জীবন।
ধীর পায়ে রান্নাঘরে গিয়ে, চায়ের সরঞ্জাম খোঁজে সোমা, পেয়েও যায়। দুই মগ চা নিয়ে বেডরুমে ফেরে সে। প্রীতম টয়লেট থেকে উড়ন্ত চুমু ছুঁড়ে দেয়। প্রাতরাশ শেষে সোমাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে, নিজের অফিসের দিকে রওনা দেয় সে।
৩.
দুসপ্তাহ পরে সোমার বাড়ি ভর্তি লোক। সোমার অফিসের কলিগ, পাড়া প্রতিবেশী, পুলিশ। অনিমা দেবী এখনো বুঝতে পারছেননা কেন সবাই ভিড় করেছে এখানে? কেন তাকে হাসপাতালে তার মেয়ে সোমার কাছে কেউ নিয়ে যাচ্ছে না? আজ ভোরে তিনিই তো প্রথম দেখেন সোমার নিথর দেহ বিছানাতে, স্যালাইন, ইঞ্জেকশানে কি এখনো জ্ঞান আসেনি মেয়ের? তার তো এই সময় সোমার পাশে থাকা উচিত। কেউ কেন তার কোন কথা শুনছে না? সবাই কি সব সান্ত্বনার কথা বলছে। কোন মানে হয়!
থানার বড় বাবু গম্ভীর গলায় তপনের মাকে জেরা করছেন। শেষ কখন দেখেছিলে দিদিমণি কে? কিছু বলেছিল, যা অস্বাভাবিক? থানার এস আই সাহা বাবু এসে দাঁড়ালেন, হাতে একটা চিঠি আর সোমার মোবাইল ফোন।
- স্যার কনফার্মড সুইসাইড কেস। সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। আর এই এমএমএসটাও একটু দেখুন, চোখ টেপেন মেজবাবু।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে, কলকাতা পুলিশের সাইবার সেলের অফিসে, বাইরের বেঞ্চে অনেকক্ষণ বসে আছেন অনিমা দেবী। প্রায়ই বসে থাকেন বিগত এক বছর ধরে, এ অফিসের লোকেরা এখন তার মুখ চেনা। আজ মজুমদার সাহেবের মেয়ের বিয়ে, তাই উনি আসেননি, ফাইলটা উনিই দেখছেন। ফিরেই যেতেন তিনি, নতুন অফিসার যতীন বসতে বললো। সে চেষ্টা করছে ফাইলের অগ্রগতির খবর নেওয়ার। দূর থেকে যতীনের ডেস্কটা দেখা যাচ্ছে, সোমারই বয়সী, সৎ, কর্মঠ এক তরতাজা প্রাণ। আজও মনে হয় বাড়ি ফিরতে দেরীই হবে, তপনের মাকে একটা ফোন করতে হবে নীচের পিসিও থেকে। মোবাইল ফোন আর রাখেন না অনিমা দেবী, খুনের অস্ত্র সাথে নিয়ে ঘোরা নিরাপদ নয়।
প্রীতমও এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেনা কিছুদিন। মেয়েটা এত ইমোশানালি উইক সে বোঝেনি। টাকাকড়ি কিছুই এল না, মাঝ থেকে সে ফেঁসে গেল। এখনো কিছুদিন লাগবে মামলা ঠাণ্ডা হতে। আরেকটা পরিচয় পত্র চাই, নতুন সিম নিতে হবে। নতুন একটা প্রোফাইলও খুলতে হবে ম্যাট্রিমনি সাইটে। দুএকটা তীর ফস্কালেই যদি সে রণে ভঙ্গ দেয়, তবে ব্যবসা চলবে কি করে? বন্ধুর ডেস্কটপ ঘেঁটে প্রীতম শুরু করে নতুন শিকারের সন্ধান।
আকাশ জোড়া মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়, তারপরে শহর ভাসিয়ে বৃষ্টি নামে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০১৮ ভোর ৪:২৭