বেবীর চলে যাওয়ার পথে বেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থাকে রুমা। কত আগ্রহ, কৌতূহল ও ভালোবাসা নিয়ে এই দিনটার অপেক্ষায় ছিল সে। আজ দুপুরে যখন দূর থেকে বেবীর নীল সালোয়ারকামিজ পরা চেহারাটা পথচলতি জনতা ফুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছিল, সেই কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলি এক লহমায় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল আবার। অক্সফোর্ডের ঐতিহ্যময় ক্যাম্পাস, প্রবাসে তার নিজের একটুকরো এপার্টমেন্ট, মিলিয়ে গিয়ে, চোখের সামনে ঢাকুরিয়া লেক, কলেজস্ট্রীটের কফি হাউস, পুরনো বইএর গন্ধ। পাশে বেবী। সেই ক্লাস ফাইভ থেকে বিএ পাশ পর্যন্ত নিবিড় বন্ধুত্ব, সেই প্রগাঢ় সখ্যতা। তারপরে যা হয়, উচ্চশিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, জীবন তাদের নিয়ে ফেলেছে দুই মেরুতে, যেমন মূল নদীর থেকে নিঃসৃত স্রোত আলাদা পথে বয়ে যায়, তারাও নিজেদের জীবন বৃত্তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
যেদিন প্রথম দেশ ছাড়ার পাকাপোক্ত আমন্ত্রণ আসল রুমার, সেদিন কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে অনেক সন্ধ্যে পর্যন্ত বসেছিল দুই বন্ধু।
- আবার কবে দেখা হবে বলত? বেবীর ধরা গলার প্রশ্ন,
- আমি একটু গুছিয়ে বসলেই, চলে আয়, শুধু তো প্লেনের ভাড়া, ওখানে সব আমি সামলে নেব, সান্ত্বনার সুর রুমার গলায়। বেবী অস্পষ্ট ভাবে হেসে ওঠে। রুমা লজ্জা পায়। বেবীর পারিবারিক অবস্থা তার থেকে আর কে ভালো জানে? লন্ডনে যাওয়ার প্লেন ভাড়া থাকলে, ওর মায়ের ভালো চিকিৎসা হত, মাসীমা শয্যাগত।
- কয়েকটা তো বছর, আবার এখানেই তো ফিরে আসব, চ্যাটে কথা হবে রে। সত্যি তোর সাথে আর রোজ দেখা হবে না, এটা কিরকম যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে।
- এটাই ঘোর বাস্তব রুমা, বিদেশ থেকে আর ফেরে কজন। সাবধানে যাস। মেল করিস। ভালো থাকিস। রুমার হাতে বেবীর উষ্ণ স্পর্শ। বন্ধুত্বের উষ্ণতাকে রক্তে শুষে নেয়, রুমা। খানিক নীরবতা। পাশের বেঞ্চে একদল বৃদ্ধ আড্ডা দিচ্ছিলেন রোজকারমত, তারা উঠে পড়লেন। - দশটা বাজলো, চল, বেবী হাত ধরে টানে। শিয়ালদাতে ট্রেন ছাড়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিল সে। ধীরে ধীরে উল্টোদিকে ছোটা প্ল্যাটফর্মে স্থির বিন্দু বেবী মিলিয়ে যায়, বাইরের অন্ধকারে।
প্রবাসে প্রথম প্রথম দেশের বন্ধুদের জন্য মন কাঁদত রুমার, ইন্টারনেটের দৌলতে, ভালোই যোগাযোগ ছিল তার ও বেবীর। তারপরে যা হয়, নতুন দুনিয়া, নতুন বন্ধু, নতুন।স্বপ্ন। এর মধ্যেই বেবীর শেষ মেলটা এখনো মনে আছে তার।
- রুমা এবার সত্যিই বিদায়, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র রেলের কর্মচারী, চলি। তোকে আসতে বললাম না, আমাদের দুজনের মধ্যে, চিরকালই আমি প্র্যাক্টিকাল, জানি, আমার বিয়ের জন্য লন্ডন থেকে তোর আসা সম্ভব নয়। হয়ত আবার দেখা হবে, ভালো থাকিস। - বেবী।
অনেকদিন পরে, সেইদিন বেবীকে খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল রুমার। এতই কি প্র্যাক্টিকাল হওয়া দরকার? একটা নিমন্ত্রণ করলে কি ক্ষতি হত রে বেবী?
বিয়ের পরে নেটের দুনিয়া থেকে বেবী বেপাত্তা, তা প্রায় বছর কুড়ি। ব্যস্ত রুমা এখন প্রতিষ্ঠিত গবেষক, সমাজতত্ত্ব তার বিষয়। ইদানীং একটা প্রোজেক্টের কাজে প্রায়ই ভারতে যেতে হচ্ছে, ঘুরতে হচ্ছে। এই রকমই এক ভ্রমণের সময় কলকাতায় বসে ফেসবুকের পর্দায় আবার বেবী। দারুন এক্সাইটেড হয়ে পড়েছিল রুমা। সাথে সাথেই যোগাযোগ। বেবীও সমান আগ্রহে, ছিঁড়ে যাওয়া সুতোয় গিঁট বেঁধেছে। প্ল্যান করেছে দেখা করার। উত্তর কলকাতায় থাকে বেবী আর দক্ষিণে রুমা। কত যুগ পরে, নভেম্বরের অপরাহ্ণতে দুজনে আবার মুখোমুখি, সেই কলেজ স্ট্রীটেই তবে কফি হাউস নয়, আধুনিক এসি লাগানো ঝাঁ চকচকে এক নামজাদা ক্যাফেতে। কফি হাউস যতই নস্টালজিক হোক, দুই বন্ধুর শান্তিতে বসে দীর্ঘ আড্ডার উপযুক্ত নয়। অথচ কলেজের দিন গুলিতে এখানেই কফির পেয়ালায় তুফান তুলতো তাদের দল, দিন গড়িয়ে রাত হয়ে যেত। আনমনে হাসে রুমা, সে নিজে তো কত পাল্টে গেছে আর বেবী! কে জানে।
সহজেই কোনের টেবিলে বসা রুমাকে খুঁজে নেয় বেবী;
- কিরে চিনতে পারছিস? এক গাল হেসে রুমাকে জিজ্ঞেস করে সে
- একটু মুটিয়েছিস ঠিকই, চুলের স্টাইলটাও নতুন, কিন্তু আর সব একেবারে একরকম, বরং আমায় যদি না চিনতে পারতিস রাগ করতাম না,পাল্টা জবাব রুমার।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে, মৃদু হাসল বেবী,
- তা বটে, বড্ড রোগা হয়েছিস, খুব ডায়েট করিস নাকি? বিদেশে তো আবার এসবের খুব চল।
- ধুর ডায়েটের নিকুচি করেছে, কাজের চাপে,পাগোল হয়ে যাচ্ছি রে। ছাড় বল কি অর্ডার করব? আজ আমি খাওয়াব। বেবীর সেই আর্থিক দুর্দশার চিত্রটাই রুমার মনে এখনো গাথা।
- না তুই আরেকদিন খাওয়াস আজ আমার ট্রীট। বেবীর হালকা প্রতিরোধ, রুমার চাপাচাপির কাছে শেষে সে হাল ছেড়ে দেয়। কফি আর এগর্যাপের অর্ডার দিয়ে, তারা গুছিয়ে বসে।
- তারপর বল, কেমন আছিস? এই এক প্রশ্নে কোথা দিয়ে সময় বয়ে যায়। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে দুজনে আবার বাস্তবের ক্যাফেটেরিয়াতে ফেরে, তিন ঘন্টা পরে। কিন্তু রুমার মনে এক অস্বস্তির ভাব। কারনটা নিজেই বুঝতে পারে না। এত কথার মাঝে কি যেন নেই, কি সেটা!বেবীই বেশী কথা বলেছে,রুমার শুনতে ভালো লেগেছে। আগেও সেই ছিল প্রধানত শ্রোতা, তবু কেন যেন সুর লাগছে না সঠিক পর্দায়। নিজের খুঁতখুঁতে ভাবে, নিজেই একটু লজ্জা পায় সে।
- কদিন থাকবি রে রুমা এবার? বেবী জিজ্ঞেস করে।
- থাকতে হবে রে, আমার একটা ব্যক্তিগত কাজ নিয়েও এসেছি।
- কি কাজ রে?
- আমি এবার বাড়িটা বিক্রি করে যাব। দেখাশুনার ল্যাঠা চোকাবো।
- তাহলে একেবারেই পাত্তাড়ি গোটাবি? - বেবীর গলায় কৌতূহল।
হ্যাঁ আর মায়া বাড়িয়ে কি হবে? রুমার গলা সামান্য ভারী হয়ে আসে।
-ক্লায়েন্ট পেয়েছিস? আমার দেওর ডেভেলপার, অনেক চেনা জানা, ভালো পার্টি ঠিক করে দিতে পারে, বলিস।
-সেতো খুব ভালো কথা রে, আমি অবশ্যই যোগাযোগ করব। আমি তো এখন আর কাউকেই চিনি না, যাকে বিশ্বাস করা যায়। খুব উপকৃত হব। রুমার স্বস্তির সুর।
-আরে ফর্মালিটি কিসের রে? আমরা এতদিনের বন্ধু আর এটুকু করব না, বেবী কৃত্রিম ক্ষোভ দেখায়। সামনের রবিবার আমাদের সাদার্ন এভিনিউএর বাড়িতে আয়, ওখানেই লাঞ্চ কিন্তু।
- নিশ্চই আসব। রুমা সানন্দে সম্মতি দেয়।
বেবী ঘড়ি দেখে, রুমা উঠে যায় বিলের তাগাদা দিতে, আগে বারদুয়েক তারা পরিবেশক কে -পরে দিচ্ছি, বলে ফিরিয়ে দিয়েছে, সে আর এদিকে আসছে না। বিল মিটিয়ে আবার দুজনে খানিকক্ষণ গল্প করে, কত যে কথা জমে আছে, এত তাড়াতাড়ি তা কি ফুরায়?
অনেকক্ষণ ধরেই কোথাও এক ছন্দপতনের খটকা লাগছিল রুমার। কারনটা এখনো অস্পষ্ট। বেবী তার পরিবর্তিত জীবনের গল্প করতে করতে আবার ঘড়ি দেখে, কব্জিতে বাঁধা দামী ওমেগা ঘড়ি। ভালো লাগে রুমার, বেবীর এই স্বচ্ছলতা। জীবনে কম স্ট্রাগল করে নি বেবী। সামনে বসা ডিজাইনার সালোয়ারকামিজ পড়া, দামী পারফিউম মাখা, পার্লারের নিখুঁত যত্নে মোড়া ত্বকের বেবী নতুন, বেশ লাগছে ওর সুখী মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কত কথাই বলে চলেছে বেবী, ওর স্বামীর সফল ব্যবসা থেকে শুরু করে, ডাক্তারিতে সদ্য ভর্তি হওয়া
ছেলের সাফল্য। সাফল্যের গর্বে উদ্দীপিত বেবীর মুখ।
এমনসময় ফোন বেজে ওঠে রুমার, তার রিসার্চ এসিস্টেন্ট শ্যামলীর ফোন।
- বল শ্যামলী
- ম্যাডাম, ফর্মটা কালই জমা না করলে, সোমবার বইগুলো পাওয়া যাবেনা।
- ফর্মতো আমারই কাছে, কাল নিয়ে যেও।
- হ্যাঁ ম্যাডাম আমি সকালে নটা নাগাদ, নিয়ে নেব। দুটো সাক্ষী লাগে, একটা তো আমিই, আরেকটা প্লিজ করিয়ে রাখবেন।
- ও তাও তো বটে, মনে ছিল না, দেখছি।
- জাস্ট ফর্মালিটি ম্যাডাম,
- হ্যাঁ হ্যাঁ হয়ে যাবে, তুমি কাল নিয়ে যেও।
ফোন রাখে রুমা। বেবী মোবাইলে কিসব লিখছিল, এবার বলে চল উঠি, রাত হল।
সত্যিই কলকাতার হিসেবে রাত হয়েছে ৯:৩০বাজে, বাড়ি ঢুকতে ১১টা বাজবে দুজনেরি। এত রাতে আরেকটা সাক্ষী কোথায় পাবে, এই চিন্তা মাথায় ডানা মেলে রুমার।
কাল ন্যাশানাল লাইব্রেরীর বিশেষ কিছু বই দেখার আবেদন পত্র জমা করতেই হবে, শ্যামলী সকাল ৯টায় ফর্ম নিতে আসবে। রুমা যে রুমাই এই মর্মে লেখা কাগজে তার দুটো সই চাই,শ্যামলীকে বাদ দিলে আর একটা সই।
হঠাৎ মনে হয় আরে, এই তো বেবীই আছে, আর সে মিথ্যা চিন্তা করে চলেছে। বেবী এদিকে উঠে পড়ার মুডে,
- চলি রুমা, রবিবার তা হলে দেখা হচ্ছে, দেওরকেও খেতে নেমন্তন্ন করব, তখনই ওই বাড়ির কথা হয়ে যাবে, একদম চিন্তা করিসনা, লীভ ইট অন মি নাউ, উঠে দাঁড়ায় সে।
- বেবী এক মিনিট একটা হেল্প কর, আমার একটা লাইব্রেরীর ফর্মে আর্জেন্টলি একটা এটেস্ট করার সই দরকার, জাস্ট ফর্মালিটি, কিন্তু কাল সকালেই জমা করতে হবে। ফর্মটা সাথেই আছে একটা সই করে দে প্লিজ। একটানা সব বলে, হাতের ফাইল থেকে একটা কাগজ ও ব্যাগ থেকে একটা পেন বের করে এগিয়ে দেয় রুমা। বেবী ইতস্ততভাবে বসে পড়ে আবার।
- কিসের ফর্ম, কিসের সই রে? খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে সে, আলতো সন্দেহের সুর রুমার কানে লাগলেও, সেটা উপেক্ষা করে আবার সব ব্যাখ্যা করে রুমা। নেহাতই ফর্মালিটি। কাল সকালেই দরকার বুঝলিনা, এখন তো আর কলকাতায় অত চেনা নেই, তাছাড়া সময় নেই, এত রাতে আর কার বাড়ি যাব। তোর কোন দায়িত্ব নেই বেবী, জাস্ট একটা ফর্মালিটি।
- আসলে একটু তাড়া আছে রে আজ রুমা, দ্রুত উঠে পড়ে বেবী। চলি।
- একটাই সই রে - রুমা একটু অবাক।
- ফর্মালিটি যখন, এই কফি শপের লোকটাকে দিয়ে করিয়ে নে না, এতক্ষন বসলাম এখানে।
রুমা হতবাক।
- আসিস কিন্তু রবিবার, অরিজিনাল দলিলটা নিয়ে আসিস। ঠিকানা মেসেজ করে দেব, বাই।
আর একবারো পিছনে না ফিরে, ক্যাফের কাঁচের দরজা ঠেলে বেবী বেড়িয়ে যায়। রুমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু বেবী।
বেবীর চলে যাওয়ার পথে বেশ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থাকে রুমা। হঠাৎই একটা ধাঁধার মীমাংসা হয়ে যায়। আজ বেবীর সাথে কাটানো সময়টা জুড়ে এক অস্বস্তি অনুভব করছিল রুমা, কারনটা বুঝতে পারছিল না। এতক্ষনে বুঝলো, যার সাথে দেখা করার আগ্রহ নিয়ে সে ছুটে এসেছিল, সেই বেবী হারিয়ে গেছে। এতক্ষন বেবীর চরিত্রে কোন দক্ষ অভিনেত্রী তার সাথে সময় কাটিয়ে গেল। অতুলনীয় অভিনয়, কিন্তু আদতে তো শুধুই অভিনয়।
ফর্ম, পেন গুছিয়ে, উঠে পড়ে রুমা। বাইরে ওলা ক্যাবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ভাবে, নদী কি আর উল্টো দিকে বয়! তাদের বন্ধুত্ব দুই ভিন্ন স্রোতে ভেসে গেছে, এখন এই সামাজিকতাগুলিও জাস্ট ফর্মালিটি। হয়তবা দুতরফেই, ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে সে।
দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে, সজল ঠান্ডা বাতাস তাকে স্পর্শ করে অকৃত্রিম সমবেদনা জানিয়ে যায়। বাইরে রাত আরো গভীর হয়ে আসে।