আজ কলকাতার পথে অনেকদিন পরে ঘুরছিলাম। দুটি বিশেষ দৃশ্য দেখলাম। তারপর থেকে ফেসবুক নিয়ে বেশ চিন্তিত
দৃশ্য এক : স্থান - লেক মার্কেটের কাছের এক বড় রাস্তা। সময় - বিকেল ৫ টা
আমার গাড়ি লাল বাতিতে আটকে, লম্বা জ্যাম। অনেকটা সময় ও ধৈর্যর পরীক্ষা। বসে বসে এদিক ওদিক দেখছি। হঠাৎ যা দেখলাম চোখ আটকে গেল। এক ৫০ এর কাছাকাছি বয়েসের ভদ্রলোক, রাস্তার ধারে পার্ক করা এক দামী গাড়ির সামনে এসে নানা ভঙ্গিতে অনেক সেল্ফি তুলছেন। গাড়িটা তার না হওয়ার সম্ভাবনা ষোলআনা। কিন্তু সেল্ফি অবশ্যই তার নিজের। দুই -তিন মিনিট, ডান বাঁ, উপর, নীচ করে শেষে দেখি হঠাৎ লম্বা করে জীভ বের করে সেল্ফি তুলছেন। সত্যি বলছি, সাধারণ হিসাবে ভদ্রলোক পাগল নন, দিব্বি মধ্যবয়েসের মধ্যবিত্ত। আমি তো চোখের পাতা না ফেলে দেখছি। হঠাৎ চোখাচোখি। ভাগ্যিস সেই মুহূর্তে সিগনাল সবুজ হয়ে গেল। না হলে কি হত বলা মুশকিল, হয়ত আমিও দিনের আলোয়, হাজার লোকের মাঝে নেমে জীভ বের করে সেল্ফি তুলতাম ফেসবুকে শেয়ার করার তাগিদে, নয়তবা হাসার অপরাধে, ধুন্ধুমার কাণ্ড বেধে যেত।
দৃশ্য দুই : স্থান - গড়িয়া মাছের বাজার, সময় - সন্ধে ৮টা
আমি ইলিশের মরশুমে একটু সৌখিন হয়ে পড়ি। গেছি চেনা মাছওলার কাছে বড় ইলিশ কিনতে। একটা এক কেজি দুশোর মাছ দাম দর করে কিনেছি, কাটার ইন্সট্রাকশন দেবার পালা। ঠিক তখনি আরেক ক্রেতার আবির্ভাব। বছর তিরিশ বয়েস, কানে হেড ফোন হাতে দামী মোবাইল। মাছ বিক্রেতা আমার মাছ ছেড়ে তাকে নিয়েই পড়লেন, আমি তো হাতেই রয়েছি। ইনিও ইলিশ প্রেমিক। তাকে সব কটা বড় ইলিশ দেখানো হল। তিনি - জাষ্ট আ মিনিট বলে, ফেসবুকের লাইভে চলে গেলেন, সাথে মাছের বর্ণনা, দাম, বাজারে মাছের সাপ্লাই কেমন ইত্যাদি, বুঝতেই পারলাম লাইভ ফেসবুকে অনেক কমেন্ট আসছে। মাছওলাও মরীয়া, সে বলল - মাছ তো নয় মাখন, যদি ভিতরটা দেখাতে চান ক্যামেরাটা এই দিদির কেনা মাছ, যা আমি কাটছি তার উপর ঘোরান। ইলিশ প্রেমিক হাইটেক ক্রেতা, মন দিয়ে আমার মাছটার পিস পিস হওয়ার ভিডিও তুললো। আমায় কেউ জিজ্ঞেসও করল না আমার আপত্তি আছে কিনা! না মাছওলা না হাইটেক ক্রেতা। দাম চুকিয়ে মাছ থলিতে ভরে যখন এগুচ্ছি, পিছনে শুনলাম হাইটেক ক্রেতা তার ফেবুর বন্ধুদের পরামর্শ চাইছে, কতবড় করে পিস করা উচিত সে ব্যপারে।
সেই থেকে ভাবছি, পৃথিবী কোথায় পৌঁছে গেছে, ফেবু লাইভ করে মাছ কেনে এ প্রজন্ম, নিজেকে কেমন ফসিলের মত পুরনো মনে হল।
বিকেলে জীভ বের করে সেল্ফি আর সন্ধ্যেতে ফেবু লাইভে ইলিশ কেনা - দুটোর ধাক্কা এখনো কাটেনি।
সেই ছোটবেলায় ইস্কুলে রচনা লিখতে দিত বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ? তখন আশীর্বাদের পক্ষেই জোর সওয়াল করতাম। আজ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একই রচনা লিখতে দিলে, কি লিখবো? আর এই বিষ্ময় প্রকাশের মাধ্যমও তো শেষমেশ সেই ফেবু।
সুতরাং বেঁচে থাকো ফেসবুক চিরজীবী হয়ে তুমি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৮ রাত ৩:৩৫