বাইরে ঝম ঝমে বৃষ্টির শব্দে খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল রহিমের, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মনটা খুশি হয়ে উঠলো, ঠিক যেন তাদের গাঁয়ের বাড়ির বর্ষা, পদ্মার ধারে তাদের ছোট গ্রাম, পানির মরসুমে নদীর সে কি বাহার, পদ্মার সেই বাতাস যেন এই ভিনদেশে গায়ে এসে লাগলো তার। নদীর টাটকা বাতাসে খিদে পেয়ে গেল। খিচুড়ি আর ইলিশের গন্ধ যেন নাকে লাগছে। বাইরে কালো আকাশের দিকে কয়েক মুহূর্ত আনমনে তাকিয়ে থাকে রহিম, কি করছে এখন আসিফা, মাইয়া ও পুলা - সোহা ও সোহান। এইসব ফ্যান্সি নাম তাদের মায়ে রাখসে,সে হিন্দী ছবির পোকা। আচ্ছা এই ম্যাঘ গুলি কি তাদের গেরামের উপর দিয়া আইল?
ঘরের অন্য অধিবাসী আরো তিন জন এখনো অঘোর ঘুমে। তারা চারজন বাংলাদেশী হকার এই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে রোমের পিরামিডা মেট্রোর কাছের এক আবাসনে। খানিকটা লুকিয়েই। চার প্রবাসী বাংলাদেশী ছেলেদের মধ্যে শুধু তারই খানিকটা সঠিক আইনি কাগজপত্র আছে, অন্যরা 'বে আইনি' ভাবে এসে আশ্রয়ের আবেদন করার প্রক্রিয়ায়। কাজেই এই খুপরিটা রহিমের নামেই ভাড়া নেওয়া; বিদেশে তার নিজের বাসা।
একটা ঘর, তারই একপাশে রান্নার কিচেনেট আর সংলগ্ন বাথরুম, এরই জন্য মাসে মাসে দেশের টাকায় ৪০,০০০ দিতে হয়, সুতরাং ভাগ করে থাকা ছাড়া আর উপায় কি?
নিজের ম্যাট্রেস থেকে উঠে পড়ে রহিম; আসাদ, জামিল, হাসান কে ডিঙিয়ে বাথরুমে পৌঁছায়, তারপরে রান্নার কোনে। আজ মনটায় দেশ দেশ ভাব। ঘুমন্ত তিন সহযোদ্ধার দিকে তাকিয়ে মায়া হয় তার। জামিলের বয়েস মোটে ২০ আর আসাদ প্রায় ৫০ ছুঁই ছুঁই। জামিলেরই বয়েস থেকে সেও কাগজের চেষ্টা করছে। অনেক আশা নিয়ে, পরিবারকে অনেক ভরসা দিয়ে, নিজেদের জমানো টাকার শেষ পয়সাটাও দালালের হাতে তুলে দিয়ে, তারা আজ এখানে। জীবন এখানে দয়ামায়াহীন। তারা অদৃশ্য, অবাঞ্ছিত, অনুপ্রবেশকারী। রাস্তার হকার। পুলিশের ভয়ে কোন স্থায়ী স্টলও নেই। তবু তারা আসে, যেমন আসাদের পরে হাসান, তারপরে জামিল আর তার আগে সে নিজে। আসে জীবিকার সন্ধানে, বলা ভালো রুপালী স্বপ্নকে ধরার আত্ম প্রবঞ্চনায়।
আজ বন্ধুদের জন্য কিছু স্পেশাল করার ইচ্ছে হয় রহিমের। প্রেশারকুকারে চাল ডালের খিচুড়ি বসায় সে, কিচেনেটের ফ্রিজ খুলে দেখে কটা ডিম আছে, ভাজি বানাবে। একটা কম পরছে, কোন ব্যাপার না, সে নিজেই না হয় আজ খাবে না ভাজি, বৃষ্টির রসে আজ ভারি উদার রহিম। হাঁড়িতে খিচুড়ি ফুটছে, আনমনে আবার দেশে ফিরে গেছে সে। বারান্দায় দুই ভাই অস্থির, এখনি আম্মি খেতে ডাক দিবে। পেট ভোরে খেয়ে, পানিতে মাছ ধরতে যাওয়ার আনন্দই ছিল আলাদা।
- কিরে কি পাক করস, সকালের নাস্তা? আসাদের প্রশ্নে স্বপ্ন থেকে মুহূর্তে বাস্তবে ফেরে রহিম। ঘরের অন্য আবাসিকেরা উঠে পড়েছে। সব থেকে বেশী লাফায় জামিলটা, ফটাফট রহিমের দুই গালে দুটো চুমু খেয়ে বলে ভাইজান আজ তো পরব গো। কম বয়েস জামিলের, এদেশের চালচলন তার উপরে ছাপ ফেলে, বোকা ছেলে বোঝে না সারা জীবন কাটালেও এই দেশ নিজের হবে না।
নাস্তার পাট চুকিয়ে আসাদ রওনা হয় সবার আগে। রহিম বাকি দুজনকে নিয়ে বের হয়, সিংজীর দোকান থেকে সস্তার ছাতা নিতে হবে, চাইনিজ মাল, আজ শহরের আনাচে কানাচে সহজেই বিক্রি হয়ে যাবে এই ২ ইউরোর ছাতা - ইউজ এন্ড থ্রো টাইপ।
বর্ষাতিতে নিজেদের মুড়ে, রোমের রাস্তায় জীবিকার যুদ্ধ শুরু হয় এই ভিনদেশী গ্ল্যাডিয়েটরদের। শত্রু কি একটা; প্রকৃতি, পরিবেশ, পুলিশ এমনকি আম জনতার এক অংশও তাদের বিরোধী। তাদের যুদ্ধ তো ভিসা অফিস থেকে কাজের বাজার পর্যন্ত সব জায়গায়। বেকারত্ব তাদের মজবুর করে নূন্যতম মজুরী না নিয়েই কাজ করতে, তাতে ইন্ধন দেয় না পাওয়া কাজের অনুমতি পত্র বা ওয়ার্ক ভিসা। পেট বড় দায়, শুধু নিজের নয়, দেশে পরিবারেরও। কত গুলা মুখ তাদের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যৎ এর নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বোনে। তাদের মুখ চেয়েই তো সব কষ্ট মেনে নেওয়া।
কলোসিয়ামের মেট্রো স্টেশন রহিমের সব থেকে পছন্দ, বহু বিদেশীরা এখানে আসে । আর এই রকম ভেজা দিন গুলিতে, তারাই আদর্শ খদ্দের। আসে স্বদেশবাসীও, টুকটাক দেশের গল্প হয়, ভালো সময় কাটে। আমেরিকানরা দামাদামি করে না। কিন্তু স্বদেশবাসী বা ভারতীয় হলে দরাদরি করবেই, তাতেও একরকম মজাই পায় রহিম - দেশে দরাদরি করে কেনায় তার ভারি সুনাম ছিল।
আজ ভাগ্যটা ভালোই তার, বৃষ্টি থামার নাম নেই, স্টকের ছাতা প্রায় শেষ, আর চারটা বিক্রি হলে, একটু জলদি বাসায় ফিরবে, ফেরার পথে এশিয়ান শপে একবার খোঁজ করবে, মাছ আসল কিনা দেশ থেকে। আজ মনটা ইস্কুলের ছেলেদের মত ছটফট করছে, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিজে আনন্দ করতে ইচ্ছা করছে। মনে মনেই হাসল রহিম, কি ছেলেমানুষি, তার ছোট পুলারই তো কেলাস থ্রি হইল। এইরকম পানি যদি এই সপ্তাহ জুড়ে হয়, তাহলে সঞ্চয় বাড়বে তার, এই ঈদে হয়ত একবার দেশেও ঘুরে আসতে পারবে। পানি যেন আল্লাহর রহমত। আকাশের কালো মেঘের দিকে তাকালো সে। আজকের কামাইও মন্দ হয়নি, এই পানিতে পুলিশের উৎপাতও কম। বৃষ্টির জন্য হিঁদুরা কি এক দেবতার পুজো করত, ছোটবেলায় গ্রামের মন্দিরের আবছা স্মৃতি মনে পরে। শেষ ছাতা এক স্পেনের টুরিস্টকে গছিয়ে বাসার পথ ধরে সে। মাছটাও সস্তাতেই পেয়েছে, আজ রাতে সত্যই পরব হোক।
প্রায় আটটা নাগাদ ফিরলো জামিল, সাথে হাসান, দুজনে আজ ভেটিকেনে অনেক ছাতা বেচেছে, ভালো কমিশন পেয়ে খুশি। বাসার দরজা, ঠেলতেই খুলে গেল, মানে কেউ আরো আগেই ফিরেছে। আশ্চর্য তবু ঘর অন্ধকার! হাঁতড়ে বাতির সুইচ টেপে হাসান। ঘরের এক কোনে কি রকম যেন এক ভঙ্গিতে শুয়ে রহিম ভাইজান, কি হল শরীর খারাপ নাকি! দুইজনে তাড়াতাড়ি ছুটে যায়।
চার ঘন্টা পরে সিটি হাসপাতালের আইটিইউ এর বাইরে বসে তিনজন। আসাদকে জামিলই বুদ্ধি করে ফোন করে, ফোন করে এমার্জেন্সীতেও। মোটা দরজার ওপাশে অনেকগুলি একক যুদ্ধ চলছে। রহিমও যুদ্ধ করছে তবে অনিচ্ছায়, অস্ত্র ত্যাগ করেই। ফলাফল উপরওলার হাতে,বলে গেছেন সার্জেন। নিঃশব্দে বসে দোয়া পড়ছে তারা তিন জন। অনেক্ষন পরে, হাসান বলে,
-আসাদ ভাই দেশে একটা খবর দেওন লাগে
আসাদ শূন্য চোখে তাকায়, বিড়বিড় করে বলে
- কার লগে? হাসান আর জামিল জানেনা কাকে, শুধু মনে হয় তাদের দেশে একবার জানানো উচিৎ। আবার খানিকটা নীরবতা। করিডোরে জুতোর শব্দ। পুলিশ। এবার এক অন্য যুদ্ধ, সঠিক কাগজ না নিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকা তিনজনের এখন নিজেদের বাঁচাতে হবে। চট করে মকবুল মিঞা কে ফোন করে আসাদ, উকিল মকবুলকে অল্প কথায় সব বলতে না বলতেই সামনে পুলিশ। বাকি রাতটা থানায় কাটে তাদের। নিজের দেশে একবার গ্রামের মিছিলের সাথে থানায় গেছিল হাসান। এদেশের থানা তো চকচকে, কিন্তু তার মনে হয় চকচকে হলেও পাথরের মত কঠিন।
জিজ্ঞাসাবাদ শেষ, সাময়িক ভাবে তাদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ, তবে নজরবন্দি। ক্লান্ত শরীর, মন নিয়ে বাসায় ফেরে তারা। পুলিশ ইতিমধ্যেই ঘুরে গেছে। নিয়ে গেছে সুইসাইড নোট আর টুকিটাকি। চা বানানোর মত মনের অবস্থাটুকু নেই কারুর। তবু জামিল চায়ের জল চাপায়। আসাদ হঠাৎ জোরে কেঁদে ওঠে, একবার আমগো লগে কইলানা ভাইজান! আমরা কি তোমার কেউ না?
পুরো ব্যপারটাই ধোঁয়াটে হাসান ও জামিলের কাছে। সকালেই তো কত খুশি ছিল ভাইজান, সবারে রাঁইধা খাওয়াইল, পানি দেইখ্যা কি খুশি, বার বার দেশের কথা কইতা আছিল। গীতও গাইল একটা। তারপরে কি হল, আল্লাহ! আসাদ ঘরের কোনে রাখা পুরানো কাগজ ঘেঁটে একটা কাগজ বের করল। এটা সে পুলিশ কে দেয় নি। এটা পুলিশের জন্য না। এইটা তাদের জন্য। কালির কলমে লেখার বড় শখ ছিল রহিমের, সে কালির কলমেই লিখেছে, বাংলায়।
আসাদ ভাইজান, হাসাল ও জামিল,
তোমাগো ভাবী, সোহা ও সোহন ডাক দেয়। ঢাকার থেইক্যা ফোনে খালাম্মা খবর দিল, বন্যার পানিতে হেরা পদ্মায় ভাইসা গেসে। আজ সারাদিন সেই পানিতেই আমিও ভাইসা গেসি।, কত লোককে ছাতা বেচেছি কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা, নিজের পরিবারের মাথায় ছাতা ধরতে পারিনাই। এহন সোহা, সোহন তাদের আব্বুকে ডাকতাছে। যাই। যাই দেরী হইয়া যাইব।
আমার একডা পরামর্শ শুন, যেখানে জানডা রাইখ্যা আসছস, সেইখানেই ফিইরা যাও, দেশে যাও। পরিবারেকে কাছে পাবা, দেশের মাটিটুক তো মিলব। আমার যা সঞ্চয় সবই আসিফা যাতে পায়, দেখ।
আল্লাহ হাফিজ
রহিম
দুই সপ্তাহ পরে রহিমের জানাজায় তারা তিনজন, সাথে আরো দু তিন জন দেশবাসী। কবরে মাটি দেওয়ার সময় আসাদের মনে পড়ল দেশের মাটি, রহিমেরে যদি একটু দেশের মাটি দেওয়া যাইত। নিজের হাতে বাঁধা পিরসাহেবের দেওয়া মাটির কবজটা কবরে ফেলে দিল আসাদ, শেষবার মাটি দেওয়ার সময়। দেশের মাটির ছোঁয়া। রহিমের বেহস্ত নসিব হোক, যেখানে তার পরিবার তার লগে অপেক্ষা করে আছে। চোখ ঝাপসা হয়ে এল তার।
পুলিশের ঝামেলা মিটলেই দেশে ফিরে যাবে আসাদ। সিদ্ধান্ত পাকা। রহিমের মতই তারেও দেশ বড় টানছে। যে দেশে আধপেটা খেলেও তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে না, নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হবে না, যেখানে তার পরিবারর রোজকার পথ চাওয়া শেষ হবে। যেখানের মাটিতে সে শেষ শয্যা পাতবে নিশ্চিন্তে। আধপেটা খেলেও।
জামিল আর হাসান নতুন বাসা খুঁজছে, তারা এখনো শেষ দেখতে চায়। তারা এই প্রজন্ম, তারা বিদেশেই গড়ে নিতে চায় নিজের দেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৮ রাত ৩:২০