আরেকটি কর্মব্যস্ত দিনের শেষে শ্রেয়া গাড়িতে উঠেই, উদ্বেগভরা স্বরে বলে, তপন, দেরী হয়ে গেছে, একটু টেনে চালিও, না হলে সাঁতার ক্লাসের শেষে রুবি একা একা অপেক্ষা করবে, যা দিনকাল। ঠিক পৌঁছে যাব বৌদি, বলে এক্সিলারেটরে চাপ দেয় তপন, দুএকটা সিগনাল যদি সবুজ পায় তাহলে ঠিকই পৌঁছে যাবে তারা।
শহরতলীর হালফেশানের আবাসনে শ্রেয়া ও প্রণব তাদের একমাত্র মেয়ে রুবি ওরফে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে নীড় বেঁধেছে, সে প্রায় বছর পাঁচেক হল। প্রণবের মা, বাবা মানিকতলার পৈতৃক ভিটা ছেড়ে দক্ষিন কলকাতার ফ্ল্যাটে আসতে নারাজ। শ্রেয়া অবশ্য লেক টেরাসের মেয়ে, কিন্তু বিগত বছর পিতৃবিয়োগের পরে, বাপের বাড়িতে তার নিকটাত্মীয় তেমন কেউ নেই। তিনজনের সুখী সংসার। প্রণবের মা, বাবা মাঝে মাঝে ঘুরে যান এখানে, থেকে জান এক আধরাত। এই বেশ, এই দূরত্বটাই জেন তাদের সবার মধ্যের সম্পর্ককে সুস্থ, সুন্দর রেখেছে, তারা রোজকার ঠোকাঠুকির উর্ধে।
প্রণবের নিজের চাটার্ড একাউন্টেন্ট ফার্ম, শ্রেয়া সফটওয়্যার প্রোগ্রামার, ওয়েবেলে ভালো চাকরী, আকর্ষণীয় স্যালারী প্যাকেজ। রুবি হয়ার পরেও চাকরী ছাড়েনি সে। প্রণবের অনুরোধেও না। অবশ্য সেই সিদ্ধান্তে এখন প্রণবকেই বেশী খুশি মনে হয়, নিজের ফার্মের আর্থিক ঝুঁকি গুলি সে চোখ বুজে নিতে পারে আর এ পর্যন্ত বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সে বিফল হয় নি। তাছাড়া প্রণব পোজেসিভ ও নয়। এই তো নয় মাস সিলিকন ভ্যালিতে কাজের সূত্রে কাটিয়ে এল শ্রেয়া; ১৪ মাসের এসাইনমেন্ট ছিল, কিন্তু নয় মাসের মাথায় একরাতের নোটিশে দেশে ফিরতে হয় তাকে। স্মৃতিপথের এইখানে এসে ব্রেক কষে শ্রেয়া, অন্যকথা,রোজকার কথা, আগামীকালের কথায় মনকে ঘুরিয়ে দেয়। সেই আকস্মিক ফিরে আসার ভয়াবহ স্মৃতি সে মনের গভীরে তালা বন্ধই রাখতে চায়। কি লাভ? কিছুইতো আর আগের মত হবে না!
গাড়ি এসে দাঁড়ায় চ্যাম্পিয়ন সুইমিং ক্লাবের সামনে, ২০ মিনিট লেটে। গেটম্যানের সাথে গল্প করছে রুবি। বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে শ্রেয়ার, আপাত ভদ্র এইসব কর্মচারীদের মনে কি আছে ভগবানই জানেন। রোজ কাগজের হেড লাইনে তো এরাই।
মায়ের গাড়ি দেখে,মতিন কাকু (গেটম্যান) কে টা টা করে এগিয়ে আসে শ্রেয়া। এবার গাড়ি বাড়িমুখো।
- তোকে না কতদিন বলেছি আজে বাজে লোকের সাথে কথা বলবি না?
- কই বলিনিতো
- গেটম্যানের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলি, আমি নিজের চোখে দেখেছি
- ও তো মতিন কাকু মা, নাসিমার বাবা। জানো মা নাসিমা এবার স্টেট জুনিয়ার টীমে চান্স পেয়েছে।
- পাক, তোকে পড়াশোনাও তো করতে হবে, সাঁতারটা একটা ফিটনেস এক্সারসাইজ, এতে অত আদিখ্যেতা করার কিছু নেই। তোমার ক্লাস টিচার ফোন করেছিলেন, লাইফ সাইন্সে তুমি মোটে ৯২% পেয়েছ, যদি ক্লাস থ্রিতেই এই হয়, তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে আমার ভয় করে রুবি। ইউ মাস্ট ফাইট, ইউ মাস্ট টপ। এখন খেয়ে নাও।
বলতে বলতে পাশের ব্যাগে রাখা ফ্রুট স্যালাড ও ঠাণ্ডা মিল্কশকের ফ্ল্যাস্কটা এগিয়ে দিল শ্রেয়া। অতি অনিচ্ছায় খাবার চিবোয় রুবি, তারো ভীষণ ইচ্ছে করে নাসিমা, গীতা, সন্ধ্যাদের সাথে আইসক্রিম বা ফুচকা খেতে, ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস চাপে রুবি। এই মুহূর্তে তার মনে হয় বড় হয়ে সে ফুচকাওয়ালা হবে, অনেক মজা হবে, ফুচকা খেতে বাড়ন করার কেউ থাকবে না।
ওজোন - টু ক্যাম্পাসে গাড়ি ঢোকে, প্রথামাফিক, সিকিউরিটি সেলাম দেয়। গাড়ি পার্কিং করতে বলে, রুবি কে নিয়ে এলিভেটারের দিকে শ্রেয়া। কয়েক মিনিট পরেই এলিভেটারে চড়ে জীবনের উচ্চ মঞ্জিলে তাদের দ্রুত যাত্রা শুরু হয় সেভেন্টিনথ ফ্লোর। ঐ উচ্চতা থেকে নীচের জনবহুল, প্রদূষন আক্রান্ত শহরটিকে ভুলে যাওয়া যায় দুঃস্বপ্নের মতই। ভুলে যেতে ভালো লাগে রোজকার ঝঞ্জাট। সেভেন্থ ফ্লোরে লিফিট দাঁড়াল। মিসেস ডালমিয়ার প্রবেশ। হাতে পুজোর থালা। বারোমাস পুজা অর্চনা নিয়ে বেশ আছেন ইনি, স্বামীর বড়বাজারে বিশাল ব্যবসা। এদের একটু এড়িয়েই চলেন শ্রেয়া। কাঁচা পয়সা হলেই তো আর সংস্কৃতি রাতারাতি তৈরি হয় না। বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স, মোটা কমলা সিঁদুর, চওড়াপাড় শাড়ি, হাতে পুজোর থালা, কপালে তিলক, গা ভর্তি গয়না, উফ শ্রেয়ার সুক্ষ রুচিতে আঘাত লাগে এই চড়া সুর। তবু ভদ্রতা বসত হাসে শ্রেয়া, ক্যায়সে হ্যায় আপ জী? নিখাদ বাংলায় উত্তর আসে, ভালো, আর আপনারা? গোয়িং অন, কথায় ইতিটানার স্পষ্ট আভাস শ্রেয়ার।
রুবির এখন কোন ক্লাস?থ্রি,শ্রেয়ার চেষ্টা যতটা সংক্ষেপে সারা জায়। একটু চুপচাপ; মাঝে আবার বারো তলায় লিফট থামে, এবার প্রায় একই বেশভূষায় মিসেস আগারওয়ালের প্রবেশ, এনার স্বামীরও বড় বিজনেস। তিন পুরুষ বাস কলকাতায়। একটু কৌতূহল হয় শ্রেয়ার
- আপনারা সব কোথায় যাচ্ছেন? কোন বিশেষ পুজো?
না জী, মিসেস আগারওয়াল ব্যাখ্যা করেন। আজ মিসেস সিন্ধের পিতাজীর সালানা কাম-কাজ, ছোট করেই করছেন অনুষ্ঠান আজ। কাল ধরমশালায় দান করতে যাবার প্ল্যান। সেই স্মরণসভায় যোগ দিতেই এঁরা দুজন যাচ্ছেন। চোদ্দ নম্বর ফ্লোরে নেমে গেলেন দুজন। ক্ষনিকের জন্য মন্ত্রপাঠ কানে এল সিন্ধেদের ফ্ল্যাট থেকে। এলিভেটর আবার উর্ধমূখী।
অন্যমনস্ক শ্রেয়া, সতেরো নম্বরে নেমে, নিজের দরজার ডোরবেল বাজালেন। হারুর মা দরজা খুলে দিল। হঠাৎ ক্লান্ত লাগে শ্রেয়ার, নিজের ঘরে যাবার বদলে, বসার ঘরের সোফায় গা এলিয়ে চোখ বোজেন। বৌদির হয় মেজাজ নয় শরীর খারাপ, লক্ষণ বিলক্ষণ চেনা হারুর মায়ের। নয় নয় করে তিন বছর তো হয়ে গেল এ সংসারে। রুবিকে ভিতরে নিয়ে যায় সে আর এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল রেখে যায় শ্রেয়ার জন্য।
জল রাখার মৃদু আওয়াজেই চোখ খোলে শ্রেয়া, আকন্ঠ পান করে সেই ঠাণ্ডা জল, তবু তেষ্টা মেটে না,
- হারুর মা জলেত বোতলটা...
বোতল দিয়ে ছায়ার মত মিলিয়ে যায় হারুর মা, এসব মুহূর্তে এনাদের কাছে না থাকাই মঙ্গল, বড় লোকের মতিগতি। কিন্তু আজ ভাগ্য খারাপ, আবার ডাক।
আজ কি তিথি হারুর মা?
শুক্ল পক্ষ, তৃতীয়া বৌদি,
হুম, ১৪ই জুলাই তাই না? হ্যাঁ বৌদি, অবাক হারুর মা। এই তিন বছরে এসব কোনদিন জিজ্ঞেস করেনি বৌদি! কেন গো বৌদি? সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলে সে। না কিছু না, তুই একটু বাজার যেতে পারবি? ছবিতো কালকের আগে আসবে না। হ্যাঁ বল না কি আনতে হবে? একটা গোড়ের রজনীগন্ধার মালা, কিছু রজনীগন্ধার স্টিক আর ভালো ধুপ। টাকা দিন গো বৌদি, এক্ষুনি আনছি, তবে আজ বিয়ের দিন, ফুল পাওয়া যাবে কিনা কে জানে? তোর আগে থেকেই না, দেখ না খুঁজে, একটায় না পেলে আর পাঁচটা দোকান দেখবি, দাম নিয়ে দরাদরির দরকার নেই। শেষের কথায়, একটু বিশেষ উৎসাহ পায় হারুর মা ওরফে রমা। একটা থলি আর টাকা নিয়ে পা বাড়ায়। আর হ্যাঁ, কে সি দাশের দশটা কাঁচা পাকের সন্দেশ আনিস সাথে, শ্রেয়ার নির্দেশ ভেসে আসে।
আচ্ছা গো বৌদি, মধ্য তিরিশের হারুর মা যেন হাওয়ায় ভেসে প্রস্থান করল। এরকম 'অবসর' তার নিত্যকার কাজে দুর্মূল্য। যদি যতীনের সাথে দেখা হয়ে যায়, কিছু পরামর্শও আছে। তার সামান্য সঞ্চয়, চটজলদি বাড়িয়ে নেবার কি জেন এক উপায়ের কথা, 'প্রয়াস' না কি একটা ব্যংকের কথা সেদিন বলছিল যতীন। কোন কাগজপত্র লাগবে না, ছ মাসেই টাকা ডবল। ঐ তো পাশের বাড়ির শ্যামলীও টাকা রেখেছে, প্রথম কিস্তির ভালো সুদও পেয়েছে। তাকে দেখেই না ভরসা পেয়েছে রমা। তাড়াতাড়ি লিফট বেয়ে নামতে থাকে সে।
বসার ঘরে একা শ্রেয়া, ভারী পর্দা ভেদ করে, মেঝেতে শহুরে সন্ধ্যার নিয়ন আলো, অন্ধকারকে গাঢ়তর করছে। পাশের ঘরে রুবি ভিডিও গেমস খেলছে, এখন দুই ঘন্টা তার ছুটি। শ্রেয়ার দৃষ্টি সামনের দেয়ালে, লাইফ সাইজ ল্যামিনেটেড ছবির উপরে। বাবা। আজ বাবার প্রথম প্রয়াণ দিবস, সেই আতঙ্ক নিয়ে সিলিকন ভ্যালী ফেলে ছুটে আসা, সেই প্রচণ্ড ডিপ্রেশান, সেই ব্যথায় নীল হয়ে থাকা মন, দিনের পর দিন ওষুধ, কাউন্সিলিং, শূন্যতা। মাত্র একবছরে সব কোথায় উধাও হল! কাজের চাপে আজকের দিনটাও বিস্মৃত হয়েছিল সে, শ্রেয়া! ছোটবেলায় মাকে হারিয়ে বাবার চোখের মনি ছিল, একমাত্র সন্তান শ্রেয়া, অনেকটা রুবিরই মতই। বাবার সব আশা আকাঙ্ক্ষার, গর্বের একমাত্র উৎস ছিল সে। বাবা ছিল তার জগত আর আজ!
মোবাইলে প্রণবকে ধরার চেষ্টা করল, উত্তর দিল তার সেক্রেটারি তথাগত। স্যার অফিসে মোবাইল ফেলে গেছেন ম্যাডাম, উনি ক্লায়েন্টদের সাথে ডিনার মিটিং এ গেছেন, আপনি চিন্তা করবেন না, আশ্বস্ত করে সে। আশ্বস্ত হওয়া দুরস্ত, শ্রেয়া মনে মনে খেপে যায়। কই প্রণব তো নিজের মা বাবার জন্মদিন থেকে বিবাহবার্ষিকী কিছুই ভোলে না। তারা তো নিয়ম করে সেদিন শ্বশুর বাড়ি যায়! আর তার বেলা?
আরেক গ্লাস জল খেয়ে, মাথার রগ দু হাতে চেপে বসে থাকে শ্রেয়া। বাবার সাথে কাটানো জীবনের ফেলে আসা দিন গুলি তার রক্তে টান মারে। অজান্তেই, চোখের জ্বলে কামিজ ভিজে ওঠে তার। সতেরো তলার নৈঃশব্দ্য শ্রেয়ার নীরব কান্নায় ছিড়ে ছিড়ে যায়, অবিরত রক্তক্ষরণ শ্রেয়ার বুকে। কি করে সে পারলো ভুলে যেতে? কি করে নিজেকে ক্ষমা করবে সে? প্রণবের কি দোষ, বাবা তো শ্রেয়ার, শুধু বাবা নয়, আক্ষরিক অর্থেই ফ্রেন্ড, ফিলোজফার ও গাইড ছিলেন তিনি। ছিঃ ছিঃ - নিজেকে ধিক্কার দেওয়া শেষ হয় না তার। মনে হয় সেদিন নয়, আজ যেন বাবার সত্যিকারের মৃত্য হল। স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়াই তো মৃত্যু।
দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ, হারুর মা ফিরেছে, বেশ দেরী করেই ফিরেছে, মনে মনে বকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ফিরেছে; কিন্তু আজ বকার মন নেই শ্রেয়ার। সে চোখ তুলে চায় শুধু। ওমা আলো জ্বালাওনি কেন বৌদি, অন্ধকারে বসে আছ। বলতে বলতে সুইচ টিপে দেয় হারুর মা, এক অবাঞ্ছিত আলোর ঢেউ, খেলে যায় সারা ঘরে। বৌদির শুকনো মুখ আর চোখের জলের দাগ, তার নজর এড়ায় না। মনটা নরম হয়ে ওঠে তার। হঠাৎ মনে পরে হারুকে, কতদিন দেখেনি, মার কোন খোঁজখবর সে রাখে না।
- পেলাম না গো বৌদি, ভাঙা গলায় বলে সে,
- কি পেলে না হারুর মা?
- ঐ ফুলের হার আর ফুল গো, সব বিক্রি হয়ে গেছে, বলে রাখলে কাল সকালে দিয়ে যাবে।
- পেলেনা? হতাশা ঝড়ে পরে শ্রেয়ার গলায়।
নিরুত্তরে সেন্টার টেবিলের উপর ধুপ, মিষ্টি আর বুদ্ধি করে আনা কিছু কুচো ফুল নামিয়ে রাখে হারুর মা, রান্না ঘরে যায় মোমবাতি আনতে। এতক্ষনে সেও বুঝেছে ব্যপারটা।
আধ ঘন্টা পরে, বসার ঘরে, হারুর মা ও রুবি শ্রেয়ার দুপাশে বসে। সুন্দর করে আলপনা দিয়ে দিয়েছে হারুর মা, জ্বালিয়েছে দুটি মোমবাতি আর ধুপ। শ্রেয়া একটা তামার পাত্রে ভাসিয়ে দিয়েছে কুচো ফুল। বাবার ছবির সামনে, চোখ বন্ধ শ্রেয়ার, দুচোখে অশ্রুধারা, বাবা ফুলের মালা নেই, আমার এই অশ্রুমালা শুধু তোমারই জন্য, গ্রহন করবে তো? ক্ষমা করবে তো আমায়?
হারুর মার চোখেও জল, হারু কি তার মুখাগ্নি করতেও আসবে না, সেদিনো কি একটু কাঁদবে না, নাতিকে বলবে না - ঠাকুমাকে প্রণাম কর। তার আত্মা সব ভুলে আন্তরিক আশীর্বাদ করবে তাদের।
রুবি এই ভাবগম্ভীর পরিবেশে হতভম্ব। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ভিডিও গেমস কম খেলবে, আরো মন দিয়ে লাইফ সাইন্স পড়বে সে, যাতে ৯৯% পায় পরেরবার, যাতে মা আর এমনভাবে না কাঁদে। ধীর পায়ে এগিয়ে মার গলা জড়িয়ে ধরে রুবি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০১৮ ভোর ৪:২০