এক
চল এবার ওঠা যাক, শমীর গলার নিঃস্পৃহতা চাপা থাকে না, রাজা অসহায় চোখে একবার তার দিকে তাকায়, একবার তাকায় চারপাশে। অদূরে রাস্তা দিয়ে গাড়ির স্রোত, জনস্রোত, সবাই ব্যস্ত দিনের শেষে নিজেদের নীড়ে মাথা গোঁজার দৌড়ে। সামনে বিশাল শ্বেত পাথরের প্রাসাদোপম ভবনে জ্বলে উঠেছে আলো, সামান্য দূর থেকে ভেসে আসছে, মিউসিকাল ফাউন্টেনের হাল্কা সুর, বাতাসে শেষ শীতের মিঠে আমেজ। আজ সারাটা দিনই তো কেটে গেল ভিক্টোরিয়ার বাগানে, এক মরশুমি ফুলের ঝোপের ধারে, তবে বিগত দুই বছরের বহু পরিচিত নরম সন্ধ্যের মত নয়, অপরিচিতের মত। আজ আর হাতে হাত, চোখে চোখ ছিল না, কথায় সত্যিই হারিয়ে গেছিল, বদলে গেছিল চোখের ভাষাও, দুজনের কেউ স্বচ্ছন্দ হতে পারেনি, পুরনো দিনের মত। যদিও রাজ ভেবেছিল দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে, সে শমীর সব ভুল ভাঙিয়ে দেবে। কিন্তু আসলে আর কোন কথাই তো বলার ছিল না। চার বছরের আলাপ, দুবছরের প্রেমে আর যাই হোক, কোনদিন কথার অভাব হয়নি তাদের। এই প্রথম। শমী খুব কথা বলতে ভালোবাসে। আর এই কথা বলার সূত্রেই তো তাদের আলাপ, পরিচয় আর প্রেম।
চোখ বুজলে এখনো রাজার কানে বাজে সেই হাসির লহরী, তাদের অফিসের ছোট ক্যান্টিনে, এরকম হাসির তরঙ্গ কে তুলল দেখতে গিয়ে সেই প্রথম চোখাচোখি; রাজা যেন এখনো দেখতে পায়, নীল আধুনিক ছাপের এক সালোয়ার কামিজ পরনে, অযত্নে বাঁধা চুলের গুচ্ছ পিঠের উপর ফেলা বছর ২৪-২৫ শের শমীকে, মাথা ঝাঁকিয়ে, গা দুলিয়ে হাসছে, সাথে তার সহকর্মী নমিতা, সেও হাসছে বেদম, তবে নিঃশব্দে। কেন জানি সেই মুহূর্তেই নতুন মেয়েটাকে খুব ওনেষ্ট মনে হয়েছিল রাজার, ঐ বলে না, প্রথম দর্শনেই প্রেম, অনেকটা সেরকম। কোন যুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা নেই। এরপর যা হয়, নিজে থেকেই আলাপ জমায় রাজা, অপরদিক থেকেও পায় সাড়া। মেয়েটি তাদের এফ এম চ্যানেলের নতুন শো 'শমীর সাথে সাতকাহন' এর এংকার। তৈরি গলা, কাজেও খুব প্রফেশনাল, প্রতিটা খুঁটিনাটির দিকে লক্ষ্য। অচিরেই সাতকাহনের টিআরপি টপে। সিনিয়ার ম্যানেজমেন্টের ও আর্টের দায়িত্বে থাকা রাজার কাছে, প্রথমদিনের মতই, আজো শমী এক ঝলক সতেজ হাওয়া। ঝড় নয়, প্রশান্তির আমেজ। বিগত দুবছরে রাজা ও শমী অন্তরঙ্গ হয়েছে, জেনেছে একে অপরকে। শমীর সন্তোষপুরের বাড়িতে, মা, বাবা ও এক বিধবা পিসী কে নিয়ে তার নিজের দুনিয়া। রক্ষণশীল পরিবার, তার রেডিও জকি হয়ে ওঠাটা এখনো মন থেকে পুরো মানতে পারেনি। অবশ্য এখন শমীর বেশ নাম ডাক, তাই পরিবারের কোঁচকানো ভুরু দ্রুত সোজা হচ্ছে। অন্যদিকে শমীও জেনেছে রাজার দুনিয়ায় মূলত এক দিদি ও বিধবা মা। মা থাকেন বাঘাযতীনে, দিদির শ্বশুর বাড়ি মানিকতলায়। জামাইবাবু রেলে ভালো পদে কাজ করেন, আর সোমা হল দিদির একমাত্র মেয়ে, ক্লাস থ্রির ছাত্রী। ব্যস, এছাড়া আর কিইবা জানার ছিল দুজনের। একে অপরকে জানার জন্য হাত তো তারা ধরেছিল আগেই।
দুই
জোর করে মনটাকে বর্তমানে ফেরাল রাজা, চল, তাহলে তোমায় নামিয়ে দিয়ে যাই। না, আমি একটা ট্যাক্সি ডেকে নিচ্ছি, পুরনো অভ্যাসগুলিতে তো ইতি টানতে হবে; শব্দ করে হাসে শমী, সেই হাসির শব্দে ভেজা মাটির গন্ধ পায় রাজা, অনাকাঙ্ক্ষিত, অকাল বৃষ্টিতে ভেসে গেছে শমী, গোপনে। রাজার কাছে আশ্রয় নেই। শমী কি বোঝে না, সেও বন্যার্ত? সামান্য খড়কুটোও হাতের নাগালে নেই তার? তারো সব ভেসে গেছে। এত অবুঝ শমী? হঠাৎ ভিতরে ভিতরে রেগে ওঠে রাজা, বেশ তাহলে চল বড় রাস্তায় ট্যাক্সিতে তুলে দি, ভাবলেশহীন গলা রাজার। মুখে আসা একটা কঠিন জবাবকে চট করে গিলে ফেলে শমী। গাঢ় হয়ে আসা আঁধারের আড়াল থেকে রাজাকে খুঁটিয়ে দেখে সে, ভারী অচেনা লাগে, দুই বছর যার প্রেম সে শিরায় শিরায় অনুভব করেছে, সে জেন অন্য কেউ। আজ তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পরাজিত যুবক, যে জীবনযুদ্ধে হার মেনে রণে ভঙ্গ দিয়েছে, যে ক্লান্ত, দিশাহীন। যে অচেনা। রাগের বদলে করুনায় মন ভাড় হয়ে আসে তার। চল এগিয়ে দাও। রাজা জেন ঠিক এই উত্তর আশা করেনি, আশা করেনি শমীর কন্ঠে এক অপরিচিত সমবেদনা, রাগ আরো বেড়ে গেল তার, করুণা করছে শমী তাকে? শমীকে সত্যিই কি সে কোন দিন বুঝতে পেরেছে?
কাল অফিসে দেখা হবে, ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করতে করতে ফিস ফিস করে বলে রাজা, কিছুতো একটা বলা দরকার বিদায়কালে। জানলার কাঁচ নামিয়েছে শমী, সোজা রজার চোখের দিকে দৃষ্টি, তাতে কোন আবেগ নেই। আমি কাল থেকে তিন সপ্তাহের ছুটিতে যাচ্ছি রাজা; কানপুরে খালার বাসায় থাকবো কিছুদিন। তোমার বউএর সাথে ফিরে এসে আলাপ হবে, তোমাদের জন্য অনেক শুভেচ্ছা। হাতব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে বলে, অগ্রীম উপহার, রাজা না বল না। রাজা কিছু বলার আগেই, শমীর ট্যাক্সি গড়ায় রাজপথে। রাজার মনে হয় তার জীবনও জেন গড়িয়ে গেছে অন্যখাতে, নিজের অনিচ্ছায়, নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
ট্যাক্সি ছুটছে সন্তোষপুরের পথে, একটু বেশি দেরী হয়ে গেছে, আটটা বাজে, কাল সকাল সাতটায় ফ্লাইট, কিছুই গোছানো হয়নি। জীবনটাই যখন এলোমেলো হয়ে গেল, তখনো ব্যাগের কথা ভাবছে সে! নিজের মনেই হাসল, হাতব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে বাবার নাম্বার ডায়াল করল, বাবা বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে লম্বা জ্যাম, বাড়ি পৌঁছতে দেরী হবে। একটা কর্তব্য শেষ। পিছনের সীটে গা এলিয়ে শমী, ভালোনাম শবনম। ভালো নামই বটে, সারা জীবনের ভালো মন্দ, শুধু এই এক নামের কল্যানে বদলে গেল দুইমাস আগে। ভালোই হল শবনম ভাবে, সারা জীবনের সংকীর্ণ পরিবেশ থেকে, নিজের সাথে লুকোচুরির থেকে মুক্তি। নিজের নামটাকে, গায়ের হাল্কা চাদরের মতই শক্ত করে জড়িয়ে নিল সে, তার নাম তো তারই সত্ত্বার অংশ।
তিন
শমীর ট্যাক্সি মিলিয়ে যেতে, নিজের আই টেন গাড়িতে স্টার্ট দিল রাজা। অনেক কাজ বাকী। বিয়ের কার্ড আত্মীয় বন্ধুদের পৌছে দিতে হবে এসপ্তাহেই। মা বলেছিল দত্ত জুয়েলারে একবার তাগাদা দিয়ে যেতে আর ঠাকুরমশাই এর কাছ থেকে অফিস ফেরত পাকা ফর্দটা নিয়ে যেতে, উনি কিছু জিনিস যোগ করবেন লিষ্টে। কোন কাজেই মন নেই রাজার, এক বিয়োগ ব্যথায় মনটা নীল হয়ে আছে। শুধু একটা নাম, কে জেন বলেছেন - 'নামে কি এসে যায়?' মিথ্যে কথা।
শবনমকে যেদিন প্রথম নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় রাজা, মা যথারীতি সন্ধ্যা আরতি সেরে জপের মালা হাতে, বসার ঘরে টিভির সামনে বসে ছিল। আগে থেকেই আঁচ দিয়েছিল রাজা, এক বিশেষ বন্ধুকে সে আনবে আজ, মায়ের সাথে আলাপ করাতে। অর্পিতা দেবী সবই বুঝে ছিলেন, আপত্তি করেন নি। কয়েকবছর আগেই তিনি টের পেয়েছেন রাজার মধ্যের পরিবর্তন। দায়িত্ববান হয়েছে ছেলে, ভালোই লেগেছিল। শুধু একটু অভিমান, রাজা তাকে খুলে বললে, তিনি কি না করতেন? কত রাতে মোবাইলে রাজার গুজগুজ, চাপা হাসি, তাকে একরকম বিদ্ধই করত; মায়ের কাছে কিসের এত লুকোচুরি? তিনি কি সেকেলে? ছেলে যদি অন্য জাতেও বিয়ে করেন, তাতেও ওনার কোন আপত্তি নেই, জাত নয়, মনের মিলই বড় কথা। তাছাড়া এখন দিনকাল পাল্টাচ্ছে, যে যুগের যে নিয়ম।
শেষে যেদিন রাজা দ্বিধাজড়িত স্বরে তার সহকর্মী শমীর সাথে আলাপ করানোর প্রস্তাব দিল, তিনি খুশি মনে স্বাগত জানান সেই প্রস্তাব, রাজারও উৎকন্ঠা দূর হয়। 'শমীর সাথে সাতকাহন', অর্পিতারও প্রিয় অনুষ্ঠান, গানের রুচি চমৎকার মেয়েটার।
শবনম ঘরে ঢুকে অর্পিতা দেবীর পা ছুঁয়ে প্রনাম করল। বস, বস, স্মিত হেসে সোফায় বসার ইংগিত করলেন তিনি। রাজাই প্রথম কথা বলে, মা এ হল শমী - সমিতা, আমার কলিগ, তুমি যার অনুষ্ঠানের বিশেষ ভক্ত।
এরপরে আরো ঘন্টাখানেক সেদিন শবনম ছিল রাজাদের বাড়িতে, কিন্তু বাচাল মেয়েটাকে কে জেন বোবা করে দিয়েছিল এক লহমায়। উঠে আসার সময় আর পা ছুঁয়ে নয় হাত জোড় করে নমস্কার করে শবনম। চটিতে পা গলাতে গলাতে বলে, মাসীমা আজকের সন্ধ্যেটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমার অনুষ্ঠান শুনবেন কিন্তু, তার মধ্যেই আমায় পাবেন।
বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে রাজা বলে, শমী মা প্রথমদিনেই শকটা নিতে পারত না, বয়েস হয়েছে, আমি ধীরে ধীরে বুঝিয়ে নেব, তাছাড়া বিয়ের পরে তোমার তো গোত্রান্তর হবেই। শক? মনে মনে হাসে শমী, মুখে বলে, রাজা আজ এসব কথা থাক, বড্ড মাথা ধরেছে। তুমি রাগ করছ শমী? না আমি খুব ক্লান্ত রাজা, আমার যে আজ গোত্রান্তর হয়ে গেছে, ধাক্কা সামলাতে একটু সময় তো লাগবেই। কি বলছ শমী! রাজার কন্ঠে উষ্মা; ভারী ক্লান্ত লাগছে, আজ, তর্ক থাক প্লীজ, শমী ইতিটানে কথা চালাচালিতে।
চার
পরের দিন, অফিসে জুনিয়ার রবি হঠাৎ রাজার চেম্বারে, রাজাদা শিগগিরী শমীদির প্রোগ্রামটা অন কর। কেন? করই না। নব ঘোরায় রাজা, ইথারে ভেসে আসে শমীর ঝকঝকে গলা- ফিরে এলাম বিজ্ঞাপনী বিরতির পরে, ৯৩.৭ এফ এমে আপনারা শুনছেন আপনাদের প্রিয় অনুষ্ঠান 'শমীর সাথে সাতকাহন' আর সংগে আছি আমি - আপনাদের সবার প্রিয় শমী ওরফে শবনম। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে রাজার, এখনি এসব বন্ধ কর রবি; অন এয়ার লাইভ চলছে রাজাদা, নিরুপায় রবি কাঁধ ঝাঁকায়।
এসব দুমাস আগের কথা। বাড়িতে নারায়ণ শিলা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে রাজা, শবনমকে ভুলে যাবে। একই সাথে ঠাকুরের কাছে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে, এই প্রতিশ্রুতি রাখা অসম্ভব, কি ভাবে 'ভুলে' যাবে নিজের জীবনের সেরা দিন গুলিকে? না, মাকেও তো এ বয়েসে ভুলে যেতে বলা যায় না মার সারা জীবনের সংস্কারকে! জীবন মানে তাহলে শুধুই কম্প্রোমাইজ, কই শমী তো কম্প্রোমাইজ করল না? শমী যদি তাকে সত্যিই ভালোবাসত! নিজের মনবিকারে এবার নিজেই লজ্জা পায় রাজা, অবচেতন মনে সে শমীকে দোষারোপ করছে, ছিঃ ছিঃ।
আনমনেই গাড়ি চালিয়ে কখন বাড়ির সামনে পৌঁছে গেছে রাজা। গাড়ি গ্যারাজে ভিড়িয়ে, নেমে আসার সময় চোখে পড়ল উপহারের প্যাকেটটা, সামনের সীটে। সেটা হাতে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল সে। এত দেরী হল ফিরতে? একটা ফোন তো করতে পারিস? ঠাকুরমশাই নিজে এসে ফর্দ দিয়ে গেলেন; দত্ত জুয়েলারে গেছিলি তো? মায়ের সব প্রশ্নবাণ নীরবে ভেদ করে সটান নিজের ঘরে ঢুকে যায় রাজা। পিছন থেকে অর্পিতা দেবীর ব্যকুল কন্ঠ, কিছু খাবি না?। বিছানায় বসে কাঁপা হাতে রাজা খুলে ফেলে উপহারের প্যাকেট। ভিতরে একটা টেবিলে রাখার ছবি ও একটা সিডি।
রাতের খাওয়া শেষ।সামনে অনেক কাজ, বিয়ের তোড়জোড় বলে কথা। পাশের ঘরে মা দিদির সাথে সেই সব জোগাড়যন্ত্র নিয়ে ফোনে কথা বলছে, নমস্কারি শাড়ির হিসাব মিলছে না। বাইরে গভীর রাত, সিডিটা চালিয়ে ছবিটার দিকে অপলকে চেয়ে থাকে রাজা, লালন ফকির, তাদের দুজনেরই বড় প্রিয়। জয়দেবের মেলায় সারারাত গান শুনে ফেরার পথে এই ছবি সে উপহার দিয়েছিল শমীকে। ল্যাপটপ থেকে শমীর দেওয়া সিডিতে বেজে ওঠে লালন ফকিরেরই ভূবনবিখ্যাত গান, 'সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে?' কোন কিছুরই আর হিসেব মিলছে না। বাইরে রাত কিন্তু তার থেকেও গভীরতর রাত নামছে রাজার মনে, রাজা আজ সব হারিয়ে সত্যিই ফকির।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৮ সকাল ১০:৩৬