somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টুটুল ও অপরাধী আমি

০২ রা আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাকে মাঝে মাঝেই গাবতলী থেকে মহাখালী যেতে হয়। সকাল বেলা অফিস টাইমে মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ে কিছুতেই গাড়িতে ওঠা যায় না। কিন্তু কোন না কোন ভাবে ত পৌঁছাতেই হবে জায়গামত।

একদিন এমনই অপেক্ষা করছি গাড়ির আশায়। খুব ভিড়। যথারীতি প্রয়োজনের তুলনায় যানবাহন কম। একটা লেগুনা এল আর লেগুনার হেল্পার ছেলেটি কি কারণে জানি না লেগুনায় খালি থাকা এক মাত্র সিটটি আমাকেই বরাদ্দ করতে আগ্রহী হল এত এত পুরুষ যাত্রীর ভিড়ে। সে লেগুনার দরজায় ভিড় করা সব যাত্রীকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা খালি করে আমাকে দেখিয়ে বলছে, “আপারে জায়গা দেন, আপা যাইব। ছেলেটির এমন আচরণে যাত্রীরা অনেকেই ভীষণ বিরক্ত আর আমি তাড়াহুড়োয় খুব বেশি অবাক হওয়ার সময়ই পাইনি।

কিছু দূর যাবার পর হেল্পার ছেলেটি যাত্রীদের কাছে ভাড়া চাইতে লাগলো। বর্ধিত ভাড়ার কারণে যাত্রীরা ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতে লাগল ছেলেটির সাথে। ছেলেটি জবাব দিল, “আমি কি করুম? মালিকে ভাড়া যা তুলতে কইছে আমি ত তাই নিতাছি। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে দু’একজন যাত্রী ক্ষেপে গিয়ে দুম করে ছেলেটিকে খুব মেরে বসল। আমি হতবাক হয়ে গেলাম এই নিষ্ঠুরতায়।

যাত্রীদের না বলে পারলাম না যে, “ওর কি দোষ? ওকে মেরে বীরপুরুষ সাজবার কি মানে? এতই যদি পালোয়ান ত গিয়ে তাদের ধরুন যারা পলিসি মেকার, যারা তেলের দাম বাড়ায়, যারা মালিক-ব্যবসায়ী, যারা ভাড়া নির্ধারণ করে। এই ছোট ছেলেটি পেটের দায়ে দুটো পয়সা রোজগারের আশায় এত প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে। ওকে মেরে কি মান-সম্মান খুব বাড়ল নাকি নিজেদের দুর্বলতা-কাপুরুষতা-নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ হল? যেখানে নিজের সাহস আর শক্তি দেখানো দরকার সেখানে দেখানোর মুরোদ না থাকলে চুপ করে ভাড়া দিয়ে দিন। বাচ্চা ছেলেটির সাথে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করবেন না।

সমস্ত যাত্রীদের রাগ এবার আমার উপর পড়ল এবং আমায় খুব একচোট শুনিয়ে দিল, সবই যুক্তিহীন মাত্রাছাড়া কথাবার্তা। যা হোক, সেসব উল্লেখ করে লেখা দীর্ঘায়িত করার কোন মানে হয় না।
আমি ভালো করে ছেলেটিকে দেখলাম। দশ এগার হবে বয়স। রোদ-গরম-গাড়ির কালো ধোঁয়া-ধূলি-ময়লার কারণে হারিয়ে গেছে পোশাকের চাকচিক্য, চুলের সৌন্দর্য, চেহারার কোমলতা। তবু কী যেন এক মায়া জড়িয়ে আছে চোখেমুখে। দু গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা, নিশ্চুপ, শূন্য দৃষ্টি। আমি তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে চোখ মুছল।

ছেলেটির নিষ্পাপ-মলিন-শুষ্ক মুখ দেখে খারাপ লাগছিলো। আমি ওর মন ভাল করবার জন্য ওর সাথে আলাপ শুরু করলাম।
-কি নাম তোমার?
-টুটুল।
আমি জানলাম, টুটুল ক্লাস ফোরে পড়ে তার বাসার কাছেরই এক প্রাইমারী স্কুলে। লেখাপড়ার পাশাপাশি মাবাবাকে সাহায্য করতে সে সকালবেলা গাড়িতে কাজ করে। যারা বড় বড় লেখাপড়া করে তাদেরকে তার খুব ভালো লাগে কারণ সে নিজেও একদিন এমন বড় লেখাপড়া করবে, তার মা তাকে এ ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহ দেন। বিজ্ঞের মত সে আমায় আরও জানিয়ে দিল যে, এ জন্যই সে সবাইকে ঠেলে আমাকে বসার সুযোগ করে দিয়েছে কারণ আমাকে দেখেই সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে আমিও বড় (!) লেখাপড়াই করছি।

ওর কথাগুলো শুনে নাকি ওর স্বপ্নিল চোখ দুটো দেখে ওকে আমার খুব ভালো লাগল, জানি না। ওর গালে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ আর ঠোঁটে মৃদু হাসি। বড় মায়া জাগায় মনে।

এবারে টুটুল আমার খোঁজ-খবর নিতে শুরু করল। আমার নাম কি, আমি কি করি, কোথায় থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আব্বু আমায় ফেলে আল্লাহর কাছে চলে গেছেন শুনে সে খুবই দুঃখ পেল এবং আমায় সান্ত্বনা জানালো ভীষণ আন্তরিকভাবে। সে এরপর জানতে চাইল, যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন আমার বাবা কী করতেন। আমি যখন বললাম, “অ্যারনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার”, সে বুঝল না। আমি বুঝিয়ে বলার পর, টুটুল বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, “অ বুঝছি। পেলেন মিস্তিরি। আমার বাপেও মিস্তিরি। রিকশার”।

পৌঁছে গেলাম জায়গামত। বড্ড গরম পড়েছে। আমি টুটুলকে বললাম, “তুমি কি অনেক ব্যস্ত? নাকি একটু সময় হবে তোমার”?
-ক্যান?
-আইসক্রিম খাবো দুজনে মিলে।
প্রথমে সে খুব অবাক হল। তারপর লাজুক হেসে বলল, সে আইসক্রিম খাবে না। আমি জোর করতে সে জিজ্ঞেস করল,
-আপনের কাজের দেরি অইব না?
-নাহ। অল্প কিছুক্ষণ দেরি হলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

টুটুল মহা আনন্দে তার ওস্তাদের কাছ থেকে ছুটি চেয়ে নিল, আর আমরা দুজনে মহা উৎসাহে একটি আইসক্রিম পার্লারে গেলাম। আর গিয়েই ধাক্কা খেলাম, আইসক্রিম খাবার সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। আইসক্রিম শপে টুটুলকে ঢুকতে দিতে রাজি নয় শপটির মালিক, এতে তার দোকানের আভিজাত্য নষ্ট হবার ও অন্যান্য খদ্দের বিরক্ত হবার আশঙ্কা আছে। শেষমেশ টুটুলের পরামর্শে আমি দুটো আইসক্রিম কিনে মন খারাপ করে ফিরে এলাম এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেতে লাগলাম দুজনে মিলে।

টুটুল মহা আনন্দে আইসক্রিম খাচ্ছে আর নানান কিছু বকে চলেছে। আমি আইসক্রিমে কোন স্বাদ পাচ্ছি না। তিক্ততায় ভরে আছে মনটা। টুটুলের প্রতি বৈষম্যে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন এতসব বিভেদের দেয়াল রচেছি আমরা? খুব কি প্রয়োজন এসবের? টুটুলদের আর আমাদের মাঝে খুব কি বেশি তফাৎ?

টুটুলের মুখে অবিকল আমার ভাইয়ের হাসি। মহসিনকে আমি কিছু খেতে দিলেও ঠিক এমনি আনন্দে দাঁত বের করে হাসে, অকারণ বকে আর খুব তৃপ্তি করে খায়। টুটুলও ঠিক আমার মত করেই স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া করে বড় বড় পাশ দিয়ে বড় কিছু হবার। টুটুলের মা ঠিক আমার মায়ের মতই সন্তানকে উৎসাহ দেন স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে। টুটুলের বাবা রিকশার মিস্তিরী আর আমার বাবা পেলেনের মিস্তিরী। মিস্তিরীই ত বটে দুজনে, তাই না? খুব কি বেশি তফাৎ আমার আর টুটুলের মাঝে? তবে কেন আভিজাত্যের এ মিথ্যে অহংকার?
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:৫৫
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×