পঞ্চম পর্ব
মাস্টার আর মজনু মিলে গ্রামের লোকদের উক্ত বিষয়ে জানালো। লোকজন গ্রামে শালিস ডাক দেয় শালিসের আগের দিন চেয়ারম্যান, গেদু, ডুগডুগি আর শরাফত মিলে বসলো ।
চেয়ারম্যান: গেলো গেলো, আমার সব গেলো আমার মান সম্মান কিছুই রইল না। বাবা শরাফাত, আপনি আমার মান সম্মান সব ঢুবাইয়া দিয়াছেন। গেদু সাব আমি এখন কি করি। আপনিতো বহুত মাইনসের উপকার করছেন, এবারের মত আমার এই ঘটনা থেকে বাঁচাইয়া দেন। আমি সারা জীবন আপনার পায়ের তলায় থাকুম।
গেদু : বুঝলা ডুগডুগি? ঘটনা যা শুনলাম, তাতো মনে অইতাছে, বিষয়টা অত্যন্ত মর্মান্তিক। দেশের রাজনীতি অর্থনীতি, বাজেট, সব করেছি।কি করি নাই? কিন্তু গ্রামে আসিয়া, অতি সাধারণ কিন্তু অসাধারণ ঘটনার মুখোমুখি হইতে হইবে তা স্বপ্নেও ভাবি নাই।
চেয়ারম্যান : আমি এখন কী করবো গেদু সাহেব। আমার মান সম্মানতো আর রহিল না।
গেদু: চ্যুইংগাম খাইয়াছেন কখনো? না খাইলেও নিশ্চই দেখিয়াছেন। ইহা হইল একপ্রকারের লেমনচুষ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা ইহা চুষিয়া চুষিয়া খায়। মিষ্টি অইলেও আদলে ইহা একটি রাবারের দলা। ইচ্ছা করিলে টানিয়া লম্বা করা যায়, আবার মুহুর্তে দুই আঙ্গু টিপা দিয়া ধলা মচড়া করিয়া আগের অবস্থায় আনা যায়। বুঝিয়াছেন?
চেয়ারম্যান: না, বুঝি নাই।
গেদু : আপনার ক্ষেত্রেও আমি চুইংগাম ফরমুলা প্রয়োগ করিবো। যদি মনে করি, টানিয়া লম্বা করার দরকার, করিবো। আবার যদি মনে করি, উহাকে গোলাকার পিন্ড অবস্থায় রাখা দরকার, রাখিবো। এইবার বুঝিয়াছেন? চলেন ডুগডুগি মুন্সি।
গেদু চলে যাওয়ার পর চেয়ারম্যান : বাবা শরাফত, যাহা ঘটিবার ঘটিয়া গিয়াছে। শত চেষ্টা করিলেও ফিরাইবার পথ নাই। কাজেই সাহস নিয়া শালিশ মোকাবেলা করিবেন। গেদু সাহেব আমাগো পক্ষেই থাকবেন।কাজেই মনের মধ্যে কোন প্রকার দুর্বলতা ঠাই দিবেন না।
শরাফত : মাস্টার সাব কি শালিসে আইবো আব্বাজান?
চেয়ারম্যান : বোধহয়। ক্যান বাজান।
শরাফত : না উনি থাকলেতো আবার, ডর লাগছে বাজান।
চেয়ারম্যান : ডরের কিছুই নাই বাজান। আমরা তো সবাই আছি। আপনি পরিস্কার একটা কথা বলিবেন, ময়নার লগে আমার কোন সম্পর্ক আছিলো না। ঠিক আছে?
শরাফত : জ্বি,
চেয়ারম্যান : একটা কথা মনে রাখবেন, আমার টেকা আছে।ওগোর কিছুই নাই। টেকা দিয়া দুনিয়া কিনোন যায়। আর মাস্টারতো কোন ছার। কি এবার সাহস হয়?
শরাফত : হ আব্বা জান এইবার মনে সাহস হয়। কোন শালা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
চেয়ারম্যান : সাবাস আব্বাজান, সাবাস।
পর দিন সকালে শালিশের বৈঠক বসলো, সবাই আগে থেকে বসা, গেদু ও ডুগডুগি ঢুকলেই সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো গেদু সবাইকে সালাম দিয়ে বসতে বলল।
মাস্টার : আইজ এমন একটা বিষয় নিয়া আমরা শালিসে বইছি, যার লগে পুরো গেরামের মান সম্মান জড়িত। জড়িত আরও একজনের জীবন মরনের ব্যাপার। কই ময়নার বাপ কই?
মজনু: এইতো আমি এখানে।
মাস্টার: বাদী আপনি, কাজেই সামনে আসেন।
ডুগডুগি : মাস্টার সাব, তার আগে আমার দুইখান কথা আছে। প্রথম কথা অইলো গিয়া শালিসের রায় উভয় পক্ষ মানতে রাজি আছে কি না?
মাস্টার : ন্যায্য হলে মানবো না ক্যান?
ডুগডুগি : দুই নম্বর কথা অইলো গিয়া, এই সমস্ত শালিসে একজন মুরুব্বি লাগে, আমাগো এলাকার কৃতী সন্তান গেদু সাহেব যেহেতু উপস্থিত আছেন আমার অনুরোধ এই দায়িত্বটা আমরা তেনার হাতে ছাড়িয়া দিই।
গেদু: আসসালামুআলাইকুম, আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলো না, এ জাতীয় কোন ঘটনায় নিজেরে জড়াই। তবুও আসিয়া যখন পড়িয়াছি, কিছু একটা হইবেই। আমি জানিতে চাই, শালিসের বিচারক হিসেবে আপ্নেরা আমারে মানেন কি না? না মানলেও আমার দায়িত্ব হবে আপনাদেরকে মানানোর। কারন, ইহার জন্য আমার হাতে নির্দিষ্ট ফরমুলা আছে। একা একা বিচার করিয়া শুনাম অথবা দুর্নামের ভাগিদার হইতে চাই না। আর তাই আরও দুই ব্যাক্তি শালিশ করিবেন। আপনারা নাম প্রস্তাব করেন।
জনৈক: আমি একাব্বর মাস্টারের নাম প্রস্তাব করিতেছি।
গেদু: বোঝা গেলো ওনি একজন পপুলার ব্যক্তি, আমি রাগ দাগ নিয়া কথা বলি না, যাহা বলি স্পষ্ট বলি, পূর্ণগণতন্ত্রে আমার কোন আস্থা নাই বিধায় ২য় ব্যক্তি আমিই মনোনীত করিব। তিনি হলেন ডুগডুগি মুন্সি। আসেন ডুগডুগি মুন্সি।
চেয়ারম্যান: শরাফত আপনাগো ছেলের মতই। বিশেষ করে মাস্টার সাব তারে খুব স্নেহ করেন।
মাস্টার : আমি আমার সব ছাত্র-ছাত্রীদের নিজের ছেলের মতই স্নেহ করি। আপনার বক্তব্য শেষ?
ডুগডুগি : ঠিক আছে। প্রথমে বাদী, কি নাম?
মাস্টার : ময়নার বাপ, সামনে আসেন ময়নার বাপ।
মজনু: আমি আর কী কমু। আপনারা বেবাক জানেন। মা মরা মাইয়া আমার ময়না।
গেদু: আমরা কিছুই জানি না। আপনি বলেন।
মজনু : আমার মা মরা মাইয়াটারে ঐ শরাফত.............
মাস্টার : মনে কিছু না নিলে গেদু সাহেব আমি বলি। মজনু ভাই ফকির লাইনের মানুষ। সারাদিন মাঝারে মাঝারে ঘুইরা বেড়ায়। এ ঘটনায় খুব ভাইঙ্গা পড়ছে।ঘটনাটা অইলো গিয়া, শরাফত আর ময়না দুইজন দুইজনরে ভালোবাসে। এখন ময়নার পেটে বাচ্ছা।
জনৈক: এখন দুইজনেরে মিলাইয়া বিয়া পড়াই দেন ব্যাচ মামলা শেষ।
ডুগডুগি : এত সহজে যদি সমাধান হত, তাহলে আইনের ওত প্যাচগোছ থাকিতো না।
জনৈক-২: প্যাচগোছতো মিয়া মানুষেই বানায়, সোজাসুজি কামটা সাইরা পালান।
গেদু: আমি অসুন্তুষ্ট হইতাছি। আপ্নারা বিচারের কাজে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিতেছেন।
ডুগডুগি : এবার বিবাদী বলেন।
চেয়ারম্যান: বাবা শরাফত আসেন। তয় গেদু সাব, আমার একখান কথা, শরাফত আমার একমাত্র পোলা, অন্যায় কারে কয় আমি শিখাই নাই। আপানাগো দশ জনের দোয়ায় আল্লায় আমারে বিষয় সম্পত্তি কম দেয় নাই। আমি মরলে বেবাক সম্পত্তির মালিক শরাফত। সে লোভে বহু মানুষ মাইয়া গোছাইয়া আমার পোলারে ফান্দে পালানোর চেষ্টা করছে। মাগার আল্লা বাঁচানোওয়ালা। কথাটা একটু খেয়ালে রাখবেন।
ডুগডুগি: এবার শরাফত মিয়া বলেন, যাহা বলিবেন সত্য বলিবেন।
শরাফত : আব্বা জানের কথাই ঠিক। সম্পত্তির লাইগা বহু মানুষ মাইয়া গছানোর চেষ্টা করছে। কত রকমের জাদু টোনা করছে আমারে। সব সময় আপনাগো দোয়ায় বাঁইচা আছি।
জনৈক-২: এবার তোমার বাঁচন নাই।
শরাফত: ঐ ময়নার চরিত্র খারাপ, বহুত চেষ্টা করছে আমারে বিয়া কইরতে, কিন্তু আমি হের ফান্দে পা দি নাই। আর এ জাতীয় কোন ঘটনাও ঘটাই নাই। কারন মানুষের জীবনের সব চেয়ে বড় জিনিস হলো তার চরিত্র। আমি নির্দোষ।
গেদু: কি ময়নার বাপ, শরাফততো অস্বীকার করে।
মজনু: দোহাই আল্লার, দোহাই শাহ্ আলী বাবার, এত বড় জুলুম আল্লাহও সহ্য করবে না। আমার মা মরা মাইয়া টারে বিয়ার লোভ দেখাইয়া, তার সর্বনাশ করছে।
গেদু: সর্বনাশের পক্ষে কোন তথ্য প্রমাণ আছে?
জনৈক-১: গত পুর্ণিমার রাইতে আমরা কয়জন গাং পাড়ে ময়না আর শরাফতরে অন্তরঙ্গ অবস্থায় কথা কইতে দেখছি।
জনৈক-২: গত ৭ তারিখে, রাইতের বেলায়, শরাফত ময়নার ঘরে ঢুকছিলো। পরে আমরা গ্রাম বাসিরা যখন লাঠি-সোটা নিয়া আগাইয়া গেছি শরাফত তখন স্যান্ডেল খুইলা পালাইছে। এ যে দেহেন তার স্যান্ডেল, কী শরাফত মনে আছে?
মাস্টার: যদি গেদু সাহেব অনুমতি দেন, তয় দুইটা কথা কই।
গেদু: বলেন মাস্টার সাব।
মাস্টার: বাবা শরাফত, ধর কথার কথা, যদি প্রমাণ হয় তুমি দোষি, তয় ময়নারে বিয়া করবা?
শরাফত : দরকার হলে টাকা দিয়া প্রমানের মুখ বন্ধ করুম।
মাস্টার: তুমি যদি দোষেই না কর, তয় টাকা দিয়া প্রমাণের মুখ বন্ধ করা লাগবো ক্যান? গেদু সাব এ যে দেহেন, এইডা শরাফতের চিঠি। ময়নার পেটের বাচ্ছা নষ্ট করার লাইগা শরাফত ময়নারে চিঠি দিছিলো। আর তার হাতের লেখা প্রমাণের জন্য স্কুলের তার পুরান খাতাও নিয়ে আইছি।
শরাফত : স্যার আমারে বাঁচান।
মাস্টার: সবার কথা বাদ দিলাম। আমি তো তোমার মাস্টার, তুমি তো জান, তোমার বাপেরে আমি পছন্দ না করলেও তোমারে আমি ছেলের মতন জানি। ভুলতো মানুষেই করে। স্বীকার করতে দোষ কি?
শরাফত : কয়টা দোষ স্বীকার করুম মাষ্টার সাব। দোষ তো আমার না, দোষ আমার রক্তের।
চেয়ারম্যান: খবরদার, স্বীকার যাইবেন না আব্বাজান। তাহলে আমার মান সম্মান কিছুই থাকবো না। ঐ ফকিন্নির মাইয়ারে কিছুতেই আমি ঘরে বউ করে আনতে পারুম না।
শরাফত এই প্রথম দৃঢ়ভাবে মাথা উঁচু করে বাবার সামনে দাঁড়ায় কয় আব্বাজান, আমি ময়নারে বিয়া করুম।
উৎভ্রান্তে রুপা দৌড়ে এসে কয় আর বিয়া করার দরকার নাই। তেতুল গাছের আগায় ময়নার লাশ ঝুলতাছে। ময়নার গলায় ফাঁস পড়ছে। সবাই ছুটে যায়, দৌড়াতে দৌড়াতে রুপা কয় বাজান, আমি সব দেখছি। ময়নার কামড় খাওয়ার জ্বীব দেখছি, কুছকানো শরীর দেখছি, খিচুনি খাওয়ার চেয়াল দেখছি। ডেড়সের মত বাঁকা আঙ্গুল দেখছি। ময়নার ভিতরে আমি আজরাইলের সুরত দেখছি।
মাস্টার : চুপ কর মা তুই ঢরাইছস? মনে সাহস রাখ, মা সাহস রাখ। ঠিকি সাকাইয়া ধরছিলাম মাকড়সাটারে। মাঝখান দিয়া মাইয়াটা গলায় ফাস দিয়া সর্বনাশ ঘটাইলো।
রূপা: সর্বনাশটা কার ঘটাইলো? বাজান। হের নিজের, না তোমাগো সবার। তোমরা কি একবারও ভাবো নাই, এতবড় কেলাংকারীর পর ময়না বাঁচতে পারে না, ময়নার মরনের কারণ শুধু শরাফত না, তোমরাও , তোমরাতো শালিস করতে যাওনি, গেছো যার যার স্বার্থ হাসিলের লাইগা। ... চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১২:১২