চতুর্থ পর্ব
ময়না আর রুপা ছোট বেলা থেকেই বান্ধবী। একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথি। একই বাড়ীতে থাকায় ময়না বেশিরভাগ সময় রুপার সাথে কাটায়। বেশ কিছু দিন হল ময়না রুপার কাছে কিছু একটা লুকাচ্ছে। সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে, কথায় কথায় মরনের কথা কয়। এমনি একদিন ময়না: রাসু ভাই কবে আইবোরে---
রূপা: কি জানি, বাবাজানতো কয় সামনের গরমের বন্ধে।বাবাজান যে কি করে, সারাদিন রাসু ভাইরে লইয়া আমারে শুধু ক্ষেপায়। কি যে আনন্দ পায় বুঝি না।
ময়না: আইচ্ছা বিয়া অইলে তুই রাসু ভাইর লগে ঢাকায় চইলা যাবি, কথাটা মনে পড়লেই আমার কইলজার মধ্যে কেমন জানি চ্যাত কইরা উঠে।
রূপা: সারা বছর কী ঢাকায় থাকুম? মাঝের মধ্যে গেরামেও আসুম। তোরে আমার কাছে ঢাকায় বেড়াতে নিয়া যামু। তুই কী ভাবছোস, ঢাকায় গেলে তোরে আমি ভুইলা যামু। আইচ্ছা ময়না, ঢাকার কথা মনে অইলেই আমার সারাক্ষন খালি ডর ডর করে। ঢাকার চলন ফিরন নাকি আলাদা। যদি কোন ভুল টুল অয় রাসু কী ভাববে।
ময়না: আরে পাগল, থাকতে থাকতে সব শিক্ষাই যাবি।
রূপা: ঢাকা শহরে যাওনের লাইগা আমার মন খালি সারাক্ষন চটপট করতাছে, আইচ্ছা, শরাফত ভাইয়ের কথা যে কইচিলি হে মানুষটা আসলে কেমন?
ময়না: মাইনসে তো কয় ভালা। তয় বাপের মতন না। কিন্তু পুরুষ মাইনসের মন, পাল্টাতে কতক্ষন। আমাগোই বা কি আছে? ঘর নাই, জমি জিরাত নাই, বাপ ঘুইরা ঘুইরা বেড়ায়, থাকুনের মধ্যে আছে শুধু ভালোভাবে বাইচা থাকনের আশা। কি জানি হয়তবা খোয়াব। হেডাও যদি ভাইঙ্গা যায়, তয় বাঁচুম কি নিয়া? চোখের সামনে দেখতাছি পোকা খাওয়া জাম গাছটা ভাইঙ্গা পড়তাছে। তবু মন আশায় বুক বাইন্ধা কয় গাছটা যেন না পড়ে। এমন অনেক কথা, যা কওন যায় না।
রূপা: ময়না, এমনি কি কথা? যা তুই আমারে কইতে পারিস না? এত কি কষ্ট তোর?
ময়না: এই কষ্টতো ধরনও যায় না, চোয়নও যায় না। বুকের মধ্যখানে কেবল খাবলা খাবলা করে। যন্ত্রনা নামের পাখিটা একবার বুকের ডালে বাসা বাঁধলে, তারে কি আর উড়াইয়া দেওন যায়? যায় না। রূপা, আমার মনে হয় আমি এক অদৃশ্য মাকড়সার জালে আটকা পড়ছি। মাইয়া মাইনসের জীবনতো এমনি। ভালোবাসে অন্ধের মত, প্রতারিত হয়, বঞ্চিত হয়, কান্দে, আবার ভুলে যায়, শত্রুকে বন্ধু ভেবে আবার গলায় ধরে। মাইয়া মানুষ অইলো গিয়া কাঁদা মাটি। যেমন খুশি নাড়াচাড়া কর, যা খুশি তৈরি কর, বাঁধা নাই। বাদ দে ঐসব কথা। আইচ্ছা, তুই কি রাসু ভাইকে নিয়া খোয়াব দেখস না?
রূপা : কত দেখলাম, ট্রেনে উইঠা আমি ঢাকা শহরে গেলাম। ময়না, ঢাকা শহর কিযে সোন্দর, লালনীল বাত্তি, ইয়া উঁচা উঁচা দালান, রাস্তার মোড়ে মোড়ে কত দোকান, তাকে তাকে সাজানো আঙ্গুর, বেদানা, নাশপাতি, যা ইচ্ছা খা পরান ভইরা খা।
ময়না: রূপা, আমার আবার বেশি বেশি খাওনের লোভরে। তুই ঢাকায় গেলে, আমি পাক্কা তিন মাস তোর বাসায় বইসা বইসা ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুইলা খামু আর খামু। তখন কিন্তু না করবার পারবি না।
রূপা : আরে পাগল, ঢাকায় কি খাওনের অভাব আছে? ঢাকার মানুষগুলা মাসাল্লা কি সুন্দর, চালচলন, আদব কায়দা। মাথায় ২৪ ঘন্টা খালি একটাই চিন্তা রাসু কবে উকিল অইবো, আমার লগে বিয়া অইবো। বাজানতো হারাদিন রাসু রাসু কইরা মুখে ফেনা তুলে। বাজান মুখে হুইনতে হুইনতে আমারও একটাই খোয়াব ঢাকা....ঢাকা....ঢাকা।
ময়না : হ, মাইয়া মাইনসের সব অইলো গিয়া কপাল। তয় আমার কপালে কী আছে জানস রূপা? মরন।আমার মরন বিনে গতি নাই।
রূপা : আমার মনে অয় তুই আমার কাছ থেকা কিছু একটা লুকাইতোছত।
ময়না: আমার জীবনটাতো লুকোচুরির খেলা। আর ভালোবাসাটা? সেটা অইলো ভাং, ধুতরার নেশা। যতক্ষন নেশা থাকে ততক্ষন ভালোবাসাও থাকে। নেশা শেষ, খেলাও শেষ। গত রাইতে মরা মায়েরে খোয়াবে দেখলাম। মা আমারে ডাক দিয়া কয়, কিরে আর কত টো টো কইরা ঘুইরা বেড়াইবি। সন্ধ্যা অইছে ঘরে ফিরা আয়।
রূপা : তোরে একটা সোজা কথা কই ময়না, মনে কিছু নিস না। তুই শরাফতরে ছাড়ন দে। হে মানুষ বেশি সুবিধার না।
ময়না : তুই ঠিকিই কইছস রূপা, তয় বড্ড দেরি হইয়া গেছে। ঐ যে কইছিলাম না, ধুতরার নেশা, নেশা যখন শেষ অইলো, নিজের দিকে যখন চোখ মেইলা দেখি বুঝতে পারলাম, আমার সারা শরীরে শুধু বিষাক্ত ঘা। দুর্গন্ধযুক্ত রক্ত বইছে আমার শরীরে।
ময়না তলপেটে হাত দিয়ে কয়, আচ্ছা রূপা মা যদি মারা যায় তবে কী পেটের বাচ্চাটাও মারা যায়? মরনের যে কি কষ্ট সেটা যদি আজরাইল জানতো বলে মাথা ঘুরে পড়ে যায়।
রূপা : ময়না ময়না চিৎকার করে বাজান, মজনু কাকা তোমরা কে কোথায় আছো, ময়না অজ্ঞান হইয়া গেছে।
ময়না অজ্ঞান হওয়ার পরবর্তীতে সবাই অাঁচ করতে পেরেছে, শরাফতের কু-কর্মের ফসল ময়নার পেটে। উক্ত রূপ দেখে মজনু দিশেহারা হয়ে মাস্টার মাস্টার, আমার সর্বনাশ অইছে। আমার সব শেষ অইয়া গেছে।
মাস্টার: কী অইছে কইবা তো?
মজনু: কানের কাছে মুখ নিয়ে- চেয়ারম্যানের লম্পট পোলা শরাফত আমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে।
মাস্টার : এটা কি মগের মুল্লুক? আমরা শালিশ ডাকুম।
মজনু : আমি এখন কি নিয়া বাঁচুম। আমারতো সব কিছু শেষ কইরা দিছে ঐ হারামজাদাটা।আমি ময়নার মায়ের কাছে চইলা যামু। আমি তো আর সহ্য করতে পারতাছি না।
মাস্টার: মজনু ভাই, মেরুদন্ড সোজা কইরা দাঁড়াও, শক্ত হও। এখন কান্দনের সময় নাই। মাইয়া আমাগো ঘরেও আছে। চল গেরামের হগলরে জানাই। সবাইরে এক কইরা এর একটা বিহীত করতে অইবো। বইশা থাকোনের সময় নাই। ........ চলবে
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:০২