ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব
কোনো মানবিক আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত মানুষদের মধ্যে "ব্যক্তিস্বার্থ আর সামাজিক স্বার্থ" এই দুইয়ের মধ্যে গোলমাল পাকিয়ে গেলে যে কোন নির্দিষ্ট সংগ্রাম ব্যর্থ হয়।
জ্ঞানী এবং সেরা বাটপার - এই দুই শ্রেণির লোক নেতৃস্থানীয় হয় বা যে কোন সংগ্রামে সামনের সারিতে থাকে। আর অনুন্নত দেশগুলোতে বেশীরভাগ জনগণ হুজুগে নাচে এবং তারা সামাজিক সমস্যা সমাধানে সঠিক কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনা।
এই অবস্থায় কুশিক্ষিত বাটপার কিছু লোক ভুল সংগ্রাম গড়ে তুলে সাধারণ জনগণকে আরও বিভ্রান্ত করতে থাকে। এভাবে সাধারণ জনগণ ভুল পথে নাচতে থাকে। এইধরণের সংগ্রামে নেতৃস্থানীয়রা এবং সংশ্লিষ্ট বিভ্রান্ত জনগণ সবাই ব্যক্তিস্বার্থের জন্য সামাজিক স্বার্থকে বিসর্জন দিতে সঙ্কিত হয়না। অর্থাৎ, একমন চালে পাঁচ কেজি পাথর মেশালে, যদি চাল বেঁচে লাভ কিছু বেশী পাওয়া যায় তবে এই বাটপার শ্রেণিটা সমাজের অন্য মানুষের সমস্যার চিন্তা না করে চালে পাথর মেশাবেই।
আবার সবদেশে সবকালে কিছু জ্ঞানী মানুষ সামাজিক সমস্যা সমাধানে জনগণের পক্ষে একটি ভালো সংগ্রাম গড়ে তুলতে কাজ করে থাকে। এই ধরণের সংগ্রামে যেসব জনগণ যুক্ত হয় তারা মোটামুটি মহৎ চিন্তা ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ বুঝে বা কিছু বুঝে এগোতে থাকে। সমাজকে মানবিক করতে যারা সংগ্রাম করে, তারা সামাজিক স্বার্থকে অনেক মূল্য দেয়। সামাজিক স্বার্থে তারা জীবন বিসর্জন দিতে সঙ্কিত হয়না। এই ধরণের ব্যক্তিরা গরুর দুধে পানি মিলিয়ে কখনও ব্যক্তিগতভাবে দুই টাকা বেশী লাভ করতে যাবেনা। কারণ তারা সমাজের সবার ভালোকে মূল্য দেয়।
কিন্তু যে কোনো ভালো সামাজিক সংগ্রামে যারা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে বা জনগণের মধ্যে ঐক্য ভেঙ্গে দেয় তারা অনেক বড় অপরাধী। কারণ তারা জেনে শুনে জনগণের সাথে বেঈমানী করে।
এমন দেখা যায় যে, অনেকে মানবতার পক্ষে খুব ভালো কথা বলছে, লিখছে, কিন্তু এদের মধ্যে কেউ কারও চেয়ে ভালো লিখলে, বললে, কাজ করলে বা জনপ্রিয় হলে- তা একই সংগ্রামে থাকা অন্য অনেকে সহ্য করতে পারেনা। ফলে নানাভাবে সত্য, মিথ্যা মিলিয়ে হিংসুক জ্ঞানীরা অন্য জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে লেগে যায়।
আবার বাটপারি করে দাঁড়িয়ে যাওয়া দলগুলোর নেতারাও মানবিক সংগ্রামকে ভন্ডুল করার জন্য নানা চাল চালতে থাকে।
এসব দ্বন্দ্বের ফলে মানবতার পক্ষে লড়াইরত নেতৃস্থানীয় জ্ঞানীদের মধ্যে বিশাল অমানবিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায় এবং যেসব জনগণ এদের অনুসরণ করে সামাজিক মানবিক সংগ্রামে এগোতে চায়, তারা তখন এদের গালি দিয়ে নীরব হয়ে ঘরে চলে যায়।
এভাবে অনেক বিশাল সংগ্রামও ব্যর্থ হয় এবং এই সুযোগে বাটপারিতে যারা সেরা, সেসব নেতাদের চেহারা সমাজে সাধারণ জনগণের কাছে বেশী পরিচিতি পায়। সাধারণ জনগণ ভাবতে থাকে যে, এসব বাটপারি ব্যতীত জগতে আর কোনো সংগ্রাম স্থায়ী নয়। তাই যা হয় হোক- কিছু করার নেই- এই মনোভাব নিয়ে সবাই অসচেতন হয়ে পড়ে।
জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার এই সুযোগে স্বার্থপর শ্রেণি জনগণকে দুর্বল করার জন্য সমাজে যত অশিক্ষা- কুশিক্ষা-ধর্মীয় কুসংস্কারের বিষ আছে তা জনগণের মগজে ঢালতে থাকে। এভাবে মস্তিষ্ক নষ্ট করা বিষে সাধারণ জনগণ এতই জর্জরিত থাকে যে, তারা মেরুদণ্ড সোজা করে আর দাঁড়াতে পারেনা। তারা কখনও মানবিক সংগ্রামকে চিনতে পারেনা এবং মানবিক সংগ্রামে জড়িত প্রকৃত জ্ঞানীদেরও চিনতে পারেনা। তারা ব্যক্তিস্বার্থকে চরমভাবে চিনতে গিয়ে প্রয়োজনে সমাজের ভালো মানুষদের কোপাতে, গুলি করতে, আহত করতে এক পায়ে খাড়া থাকে।
আমরা যখন কোনো মানবিক প্রশ্ন তুলি তখন তার সঠিক সমাধান হলে ব্যক্তি আমিসহ সমাজের সবার মানবিক জীবন নিশ্চিত হওয়ার পথ সুগম হয়। তাই সকল মানবিক কাজের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এক থাকা উচিত এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসাকে মজবুত রাখা উচিত। যদি আমরা সামান্য কারণে পরস্পর হানাহানি শুরু করে আমাদের মানবিক সংগ্রামে জড়িত থাকা নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে ঐক্য ভেঙ্গে দিই, তাহলে সেই অপরাধে আমাদের ফাঁসি হওয়া উচিত। কারণ আমরা মানবিক পথের অগণিত যাত্রীদের জেনেশুনে হতাশ ও বিভ্রান্ত করে অমানবিক সমাজ গড়ে তোলার পথ সুগম করে দিচ্ছি।
ধরি, আমরা কোনো একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে ভালো মনের কিছু মানুষ নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তুললাম। সেখানে সংগ্রামরত কোনো এক বড় ভাই বা বোন যদি ব্যক্তি আমাকে ভুল বুঝে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ফেলে, তখন আমার কি সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে আজেবাজে কথা বলা বা তার গালে চড় বসিয়ে দেয়া উচিত ? নাকি আমার পরবর্তী আচরণ, যোগ্যতা, ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেয়া উচিত যে, সংশ্লিষ্ট বড় ভাই বা বোন ভুল করছে?
যদি আমি এই ধরণের ছোটো বা বড় ঘটনায় অতিরিক্ত উদ্ধত হয়ে পড়ি, তবে আমি হয়ত আমাকে একটা বড় কিছু প্রমাণ করতে সক্ষম হতেও পারি, কিন্তু তাতে আমরা যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের সংগঠনটি গড়ে তুললাম সেটা কি নড়বড়ে হয়ে যায়না ? সামাজিক সমস্যা সমাধান করার ক্ষেত্রে ভালো যেসব সংগঠন বা দল গড়ে ওঠে, সেগুলোর অভ্যন্তরে কোনো সমস্যা হলেই হাম্বরা ভাব নিয়ে সংগ্রামী ব্যক্তিগুলো আলাদা সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কেন তারা আলোচনায় যায়না ?
আমরা যদি সামাজিক সমস্যার সত্যিকার সমাধান চাই, তবে আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সুনাম কুড়োনোর চেয়ে সবার মিলিত প্রচেষ্টাকে বড় করে দেখা উচিত। সামাজিক সমস্যা সমাধানের স্বার্থে মিছিল, মিটিংয়ে একজন মেথর, ঝাড়ুদারকেও কখনও কখনও আমাদের সামনে কথা বলার জন্য ঠেলে দিতে হতে পারে। সেখানে যদি ভাবি যে, একজন মেথর আমার সাথে একই মঞ্চে দাঁড়ালো কেন- তবে চোখ বুঝে বলা যায় যে, আমি কেবল আমাকেই সবার সামনে বড় করতে চাচ্ছি, আর আমার যত কাজ তা সবই ভন্ডামি।
আমরা এভাবেই অনেক সংগ্রামকে নিজেরাই ব্যর্থ করেছি এবং সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে চলেছি। সাধারণ মানুষ না বুঝে আর্তনাদ করেই যাচ্ছে। কিন্তু এসব ভন্ডামি আর কত ?