ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রবি ঠাকুরের গান শুনছে হিমি।
খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে
বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে,
কী ছিল বিধাতার মনে।
এমন সময় মুমু ডাক দেয়, আপু তোমার সেই প্রেমিক আবার এসেছে।
-সকালে না একবার চলে যেতে বললাম, আবার এসেছে? উফফ!
-তুমি এর প্রোপোজালে কিভাবে যে রাজী হয়েছিলে আল্লাহ মালুম।
-আসলে প্রোপোজটা আমিই প্রথম করেছিলামরে, তার পর সে।
-বল কি! কিভাবে সম্ভব?
-ল’ডিপার্মেন্টের প্রথম দিন , ক্যম্পাসে পা দিয়েই একদল ছেলে মেয়ে কে কোরাস গান গাইতে দেখি। যে ছেলেটা লীড দিচ্ছিলো তার চমৎকার মেলোডিয়াস গলা, কোকড়া চুল, শার্প চেহাড়া। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো ছেলে।
তার তিন/চার দিন পর র্যাাগ দিতে এসে বড় আপুরা।আমাকে দূরে একটা ছেলে দেখিয়ে বলে ওকে প্রোপোজ করতে হবে । আমি ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখি এই সেই ছেলে, মাথা ঝুকে অংক কষছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। ছেলেটা মাথা না তুলেই বলে, যার চরন এতো সুন্দর তার মুখ না জানি আরো কত সুন্দর । যা বলতে পাঠিয়েছে বলে চলে যাও। এই বছরে তুমি পাঁচ নাম্বার মেয়ে আসছো র্যা গের প্রাপোজ করতে। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, কান্নার জন্য নাক টানার শব্দ শুনতে পায় সে। তাও না তাকিয়ে বলে ওদের কথা শোন, নাইলে আরো ঝামেলায় পড়বা। যা বলতে এসেছো বলে চলে যাও। আমি তোমাকে চিনে রাখবো না, যাতে পরে তুমি বিব্রত না হও, সবাই অবশ্য নরমালিই নেয়।
আমিও আর কথা না বািড়য়ে I Love You বলে চলে আসি।
-সে থেকেই তোমাদের প্রেমের শুরু?
-আরে নাহ। তারপর এমনিতেই দেখা হতো, কথা হতো না। জানতাম সে পলিটিক্স করে, ছাত্র দের বিসিএস এর অংক করায়, টুকটাক নেশা করে, ড্যাম কেয়ার টাইপ, ভার্সিটিতে রেকর্ড ভাল না।
আমি একটা সাংস্কৃতিক দলে যোগ দেই ও সেটার সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলো। ক্লাবের প্রয়োজনেই ফোন নাম্বার আদান প্রদান হয়। ওর সাথে আড্ডা দেয়া ছিলো খুবি মজার। আমাদের প্রিয় গান, কবিতা, বই, সিনেমা সব মিলে যেতো।আর ক্লাবের সব আড্ডায়, অনুষ্ঠানে আমাদের ডুয়েট গান থাকতোই থাকতো।
এক বর্ষায় সে আমাকে হুট করে দেখা করতে ডাকে, আমি বান্ধুবী সহ আসতে চাইলে বলে একা এসো। দেখা হলে অন্যদিনের মতো তেমন কথা বলে না। আমি বলি মাটিরর দিকে তাকিয়ে কি দেখেন। সে বলে তোমার মুখের দিকে যখন সংকোচে তাকাতে পারিনা, তখন তোমার পায়ের দিকে তাকাই। আমিতো অবাক, আপনি আমাকে চিনেছেন? তাকান আমার দিকে।
তার হাত পেছনে লুকানো ছিলো। সে হাটু মুড়ে বসে একগুচ্ছ কদম আমার সামনে ধরে, আমার চোখের দিকে তাকায়। এতো আকুল চাহুনি আমি আমার জীবনে দেখিনি। সেই চাহুনি আমি কোনদিন ভুলবো না। কেউই মুখে কিছু বলি না। তার হাত থেকে ফুল গুলো নেই।
-উফফ এত্তো রোমান্টিক! তারপর?
-আমাকে প্রায়ি ওর সাথে রিকশায় ঘুরতে দেখে বন্ধুরা সাবধান করতে আসে। বলে ওর ফ্যামেলি তোর ফ্যামেলির সাথে যায় না, ওর বাবার তিন বিয়ে, ঘর বাড়ি কিচ্ছু নাই, ও নেশাখোর ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে ঐ সময়টা আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এত্তো সুন্দর সময় কাটছিলো আমাদের। নিজেদের নিয়ে এতো মগ্ন ছিলাম যে ওসব কথা ভাবার বা দুজন আলোচনা করতেও ইচ্ছা করতো না। ভাবতাম এভাবেই যাকনা আরো কিছু দিন। একদিন আমি বন্ধুদের চাপে ওকে ওর ফ্যমেলি, পলিটক্স এগুলা নিয়ে কথা বলবো ভেবে ফোন দেই। ফোন তুলতেই ও আমাকে নিয়ে লেখা কবিতা আবৃতি করে শোনায়। কি যে সুন্দর একটা কবিতা! আমাকে নিয়ে কেউ কখনো লিখবে এটা কখনো চিন্তাও করিনি। আমরা দুজন দুইটা প্রজাপতির মতো ছিলাম। আজকে মুভি দেখি তো কাল আর্ট একজিভিশন, পরশু কন্সার্ট এভাবেই ঘুরতাম রোজ। ও অবশ্য টাকা ওভাবে খরচ করতে পারতো না, আমার টিউশোনির টাকায় দিব্বি ঘোরাঘুরি হয়ে যেতো আমাদের।
-এতোই যদি ভালবাস বিয়ে করলা না কেন?
-ইশ আমাদের সময়টা যদি ওখানেই থেমে থাকতো! কিন্তু তা তো আর হয় না। অনেক বুঝিয়েও তাকে লাইফ নিয়ে কখনোই সিরিয়াস করা যায়নি। আমার বাসায় বিয়ের কথা চলতে থাকে, ওকে বলতাম বিয়ে করতে চাইলে আমার বাসায় কথা বলো বাকিটা আমি ম্যানেজ করবো। সে বলতো পালিয়ে বিয়ে করার মধ্যে একটা থ্রিলিং ব্যাপার আছে। বিয়ে করলে পালিয়েই বিয়ে করবো। তোমার বাসা থেকে তোমাকে আমাকে খুঁজবে, কেস করবে উফফ হোয়াট আ এডভেঞ্চার! আমি যে ফ্যমেলির মেয়ে সেখানে এসব ভাবতেই পারি না।
হিমি কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। লো ভলিয়মে গান বেজে চলেছে
বনের পাখি বলে-- "না,
আমি শিকলে ধরা নাহি দিব।'
খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি কেমনে বনে বাহিরিব!'
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--
দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,
কোথাও বাধা নাহি তার।'
খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি
কেমন ঢাকা চারি ধার।'
বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও
মেঘের মাঝে একেবারে।'
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'
আস্তে আস্তে আরো ভালমত পলিটিক্সসে জড়িয়ে যায় সে। সে সবসময় নিজে যা বোঝে সেভাবেই চলতো। মাঝে মধ্যে পুলিশে ধরতো। কাউকে তেল দিতে পারতো না। তাই কারো সুনজরেও পড়ে নি। তার রাস্তা আমার রাস্তা এভাবে ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়।
কোর্টে আমর প্রথম প্র্য ক্টিস এর দিন আমি যে কেইসটা অবজার্ভ করি সেটার আসামী ছিলো ও ! সেটাযে কতটা যন্ত্রনার আমি তোকে বোঝাতে পারবোনারে মুমু।
-নতুন করে জীবন শুরু করলা না কেন? কত মানুষই তো একজনকে ভালবেসে আরেকজনকে বিয়ে করে। জীবনতো আর সিনেমা না।
-চেষ্টা করেছিলামরে। কয়েকজনের সাথে কথা বলেছিলাম ফ্যমেলিগত ভাবে। কিন্তু সবার মধ্যেই আমি শুধু ওর ছায়া খুঁজি। তখন আর কথা আগাতে পারি না কারো সাথে, মনের মধ্যে ও আরো বেশি করে আকড়ে থাকে তখন। আমাকে ওর মতো ভাল কেউ কখনো বাসেনিরে।
আমি না পারি নিজে উকিল হয়ে দুই দিন পর পর জেল খাটে, সোজা বাংলায় একটা আসামীকে বিয়ে করতে, না পারি তাকে ভুলে অন্য কারো সাথে সংসার করতে। সে নিজেও বোঝে যে আমাদের যাবে না। আর কখনো সে কথা বলেওনি তার পর থেকে। তাও হঠাৎ হঠাৎ বছরে দু’একবার কোথথেকে এসে হাজির হয়। ওর মুখে খুব সংকোচ থাকে বোঝা যায়, আমার মুখের দিকে তাকায় না। পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। এটা আমি সহ্য করতে পারি না। আমরা আগের মতো গল্প করতে গিয়েও আটকে যাই। খুব অস্বস্থিকর পরিস্থিতি। কাপের চা শেষ হওয়ার আগেই চলে আসি দুজন।
মা বাবা ভাই বোন সবার সাথে আমার দূরত্ব এক মাত্র ওর কারনে। আমার চিন্তায় আমার মা অসুস্থই হয়ে গেল। নিজের বাসায় থাকি না অশান্তির জন্য, তোদের সাথে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি।
জানিস আমাদের মধ্যে ট্যেলিপ্যাথি কাজ করে। আমি জানতাম আজ ও আবার আসবে। বারান্দা দিয়ে দেখতো চায়ের দোকানে এখনো বসা কি না, থাকলে আরেকটু বসতে বল।
আর তুইনা কাল পাঁচ মিনিটে রঙ হয় এমন একটা মেহেদী কিনে আনলি, ওটা আমাকে দেতো একটু।ও মেহেদী খুব পছন্দ করে।
-হুম আপু আছে উনি এখনো। আচ্ছা আমি গেলামরে, একটু দেখা করে আসি, বেচারা বোধয় কিছু খায়নি এখনো।
হিমি চলে যায়। তখনো মৃদু স্বরে বাজছে-
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
কাতরে কহে, "কাছে আয়!'
বনের পাখি বলে--না,
কবে খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
খাঁচার পাখি বলে--হায়,
মোর শকতি নাহি উড়িবার।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৪