গল্প:
তাহমিনার চোখে জল
সাইয়িদ রফিকুল হক
তাহমিনার রাগ খুব বেশি।
সে রেগে গেলে আর মানুষ থাকে না। তখন সে কাকে কী বলে ফেলবে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। জীবনে এই রাগের জন্যই সে আজও অনেকের কাছে অপ্রিয়।
স্কুলজীবন থেকে শুরু করে কলেজজীবন পেরিয়ে―এমনকি ভার্সিটির জীবনশেষেও সে তার রাগ কমাতে পারেনি!
রাগের জন্য যে তাকে এতবড় খেসারত দিতে হবে―তা সে আগে কখনো ভেবে দেখেনি। সে নিজের রাগের ওপর খুব সন্তুষ্ট ছিল। আর রাগকে ভালোবেসে মনের গভীরে এতদিন সযত্নে পুষেও এসেছে। কিন্তু আজ যে তার বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে!
ভার্সিটির ফাইনাল পরীক্ষার মাস কয়েক আগে জোহেব একদিন তাকে বললো, “চলো, আমরা এখনই বিয়ে করে ফেলি। তাছাড়া, বাড়ি থেকে আমার বিয়ের জন্য আজকাল একটু চাপাচাপিও করছে!”
ওর কথা শুনে তাহমিনা হেসে বলে, “তুমি না ছেলেমানুষ! এখনই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছো কেন? এসব কথা মেয়েরা বললে তবুও মানায়।”
ওর কথায় সন্তুষ্ট হতে পারে না জোহেব। সে কথাটা সিরিয়াসলি বলেছে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাহমিনা আবার বলতে লাগলো, “আচ্ছা, ঠিক আছে। আমরা বিয়ে করবো। কিন্তু আর ক’টা দিন সবুর করো। এই তো দেখতে-দেখতে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তখন একদিন বসে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলবো।”
জোহেব তবুও অনড় ও অটল হয়ে বলে, “না-না। তা হচ্ছে না। বাড়িতে দাদাজান আমার বিয়ের জন্য একেবারে হন্যে হয়ে উঠেছেন। তার বয়স এখন আটাত্তর বছর! তাই, তিনি একমাত্র নাতবৌকে দেখে নিশ্চিন্তে মরতে চান। তুমিই বলো―আমি এখন কী করবো?”
তাহমিনা আবারও বিষয়টাকে খুব হাল্কাভাবে দেখে বলে, “এটা কোনো বিষয় হলো! ফালতু একটা ব্যাপার। এসব সনাতনী ভাবসাব আমার একদম ভাল্লাগেনা।”
জোহেব বলে, “আহা! এগুলোকে নাহয় মূল্য দিলাম না। কিন্তু বাড়িতে আমার বিয়ের জন্য সবাই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। তার কী হবে? তুমি সিদ্ধান্ত নাও―কবে আমরা বিয়ে করবো। বাড়ির লোকজনকে সামাল দিতে-দিতে দেওয়ালে আমার পিঠ ঠেকে গেছে!”
তাহমিনা এসবে যেন একটু-একটু করে উত্তেজিত হতে থাকে। সে বলে, “বিয়ে তো করবোই। কিন্তু এখন নয়। তোমার দাদা যদি আমাদের বিয়ের জন্য মরেও যায়―তবুও নয়!”
“এমন কথা বলছো কেন?”―জোহেব সরল মনে জানতে চায়। যদিও সে ওর এধরনের কথায় ভিতরে-ভিতরে খুব কষ্ট পেয়েছে। দাদাজান তার খুব কাছের একজন মানুষ। তাঁর সম্পর্কে ওর এসব কথা শুনে সে আপনমনে লজ্জিত হয়।
তাদের প্রেম পাঁচ-বছরের। এমন প্রেম একটা-দুটো কথায় তো আর ভেঙে দেওয়া যায় না। তাই, জোহেব ওর কথা গায়ে না মেখে বলে, “তাহলে, বলো, কবে আমরা বিয়ে করবো? এবার তুমি একটা ফাইনাল কথা বলো।”
তাহমিনা এবার গম্ভীর হয়ে বলে, “আমার বড়বোন ও দুলাভাই আমেরিকা থেকে মাস ছয়েক পরে বাংলাদেশে আসবে। তারা তোমাকে দেখবে, তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলবে। তারপর বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা হবে। আর সেই আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আমাদের সম্পর্কটা এরপর বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে।”
জোহেব একথা শুনে সরল মনে বলে, “আমাকে বুঝি তোমার বোন-দুলাভাইয়ের কাছে ইন্টারভিউ দিতে হবে?”
তাহমিনা এতে মুখঝামটা দিয়ে বলে, “তা কেন হবে? তারা আমার গার্জিয়ান। তাদের কথা তো শুনতেই হবে। আর তাদের সামনে তোমাকে দাঁড়াতেই হবে। তারা তোমাকে দেখবে―এটা এমন কোনো দোষের বিষয় নয়।”
জোহেব বলে, “না, দোষের হবে কেন? এটা খুব ভালো ব্যাপার। তারা বিদেশি বলে সবকিছুতে তাদের অগ্রাধিকার। কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্ক করার সময় তোমার ওই গার্জিয়ানদের পারমিশন নাওনি কেন? তাহলে, আজ এত ঝামেলা হতো না!”
এতে তাহমিনা খুব তেজের সঙ্গে বলে, “হ্যাঁ, সেটা আমার ভুল হয়ে গেছে।”
ওর কথা শুনে জোহেব শান্তভাবেই বললো, “আমেরিকা-নিবাসীর কথা শুনে তুমি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিবে―এটা বোকামি! তারা এমন কী যে তাদের কথা শুনতে হবে! আমেরিকায় থাকে বলেই তারা সব ব্যাপারে মাতবরি করবে?”
তাহমিনা এবার খুব ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, “হ্যাঁ, তা-ই। পারলে একবার আমেরিকায় গিয়ে দেখাও না।”
জোহেব হেসে বলে, “পারি না বলেই তো তোমার কাঁধে মাথা রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে চাই। কিন্তু আমার না―তোমার এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। তাদের এত পাত্তা দিয়ো না।”
তাহমিনা সরোষে বলে উঠলো, “তোমার ভালো লাগুক আর না লাগুক তাদের অবশ্যই শ্রদ্ধা করতে হবে। হাজার হলেও তারা আমার বড়বোন ও ভগ্নিপতি।”
জোহেব বলে, “তাহলে, আমার দাদার ব্যাপারটা তোমার কাছে নিছক একটা ছেলেমানুষি!”
তাহমিনা আগের চেয়ে বেশি তেজ দেখিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠলো, “সেসব একেবারে সেকেলে চিন্তা। আর খুবই আজেবাজে একটা ব্যাপারস্যাপার। আর তুমি কীসের সঙ্গে কী মেলাতে চাচ্ছো?”
জোহেব হাসিমুখে বলে, “না, কিছুই মেলাতে চাচ্ছি না। শুধু তোমাকে আজ দেখছি। তোমাকে না আজ অন্যরকম লাগছে!”
তাহমিনা এবার আরও শক্ত আর গম্ভীর হয়ে বলে, “শোনো, তোমাকে তাদের পছন্দ না-হলে বিয়ের ব্যাপারটা কী হবে―তা বলা যায় না। তাই, তাদের সম্পর্কে তুমি আগে থেকে ভালো ধারণা রাখবে। তাছাড়া, তারা এলে তুমি তাদের খুব তোয়াজ করেও চলবে। তাহলে, একটা পজিটিভ মেসেজ আসবে।”
জোহেব সরাসরি বললো, “আমি ওসব পারবো না। কাউকে তেল দিয়ে আমি চলতে শিখিনি।”
একথা শোনামাত্র তাহমিনা একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, “তোমার চৌদ্দোপুরুষে কেউ কোনোদিন আমেরিকায় গিয়েছে যে―তুমি তাদের মূল্য বুঝবে!”
ওর কথা শুনে জোহেব আজ এতদিন পরে একেবারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল! সে আর কোনো কথা বলতে পারে না। সে কী বলবে তা ভেবে পেল না। তাই, সে চুপ করে থাকাটাকেই ভালো মনে করলো।
কিন্তু এতেও তাহমিনার রাগ কমে না। সে আবার বলে উঠলো, “আমার দুলাভাই আমেরিকায় পিএইচডি করেছেন। তিনি তোমার মতো সাধারণ কোনো মানুষ নন।”
জোহেব এবার হাসিমুখে নয়―একটু গম্ভীর হয়ে বললো, “তবুও তিনি আমার চেয়ে বড় নন। কারণ, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার কাছে আমাকেই বড় মনে করা উচিত ছিল।”
একথা শুনে তাহমিনা খুব বিরক্ত হয়ে দ্রুত একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো। তারপর রিকশার হুড তোলার সময়টুকুতে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, “তোমার সাথে এসব আজেবাজে কথা বলার মতো সময় আমার নেই। থাকো, তুমি তোমার দাদাকে নিয়ে।”
সে ঝড়োগতিতে চলে গেল।
এরপর থেকে জোহেবের সঙ্গে আর-কখনো ওর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। ওরা একই ভার্সিটিতে পড়লেও ওদের সাবজেক্ট ভিন্ন ছিল। তাই, কেউ ইচ্ছে করে দেখা না-করলে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুব কম।
এতবড় একটা ইউনিভার্সিটিতে জোহেব বেশ কয়েকদিন তবুও তাহমিনাকে খুঁজেছিল। তাকে না-পেয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিল। শেষমেশ সে নিজেই যেন আত্মগোপনে চলে যায়!
পরীক্ষা শেষ হয়েছে তাহমিনার। রেজাল্টও বের হবে কিছুদিন পরেই। তবুও জোহেবের আর-কোনো খোঁজ নেই!
এদিকে তাহমিনার বড়বোন ও ভগ্নিপতি এসেছে অনেকদিন হলো। তারা দেশে ফিরে তাহমিনার জন্য অনেকরকম পাত্র দেখেছে। কিন্তু তাহমিনার জোহেবকে ছাড়া আর কাউকেই ভালো লাগে না।
জোহেব একটা মেসে থাকতো। তাহমিনা সেটা ভালোভাবে চিনতো না। ওদের ডিপার্টমেন্টের একটা ছেলের নিকট থেকে ঠিকানা জোগাড় করে ওর মেসেও সে গিয়েছিল। কিন্তু সেখানকার সবাই বলেছে―সে অনেক আগে মেস ছেড়ে দিয়েছে।
ওর নতুন মোবাইল-নাম্বারটাও কেউ জানে না!
সে কোনোদিন ওদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানাটা জানতে চায়নি। আজ তার খুব অনুশোচনা হচ্ছে এজন্য।
তাহমিনা এখন প্রতিদিন বাসা থেকে বের হয় জোহেবের একটা খোঁজ জানতে। সে কোনো চাকরির ইন্টারভিউ দেয় না। এগুলো দেওয়ার মতো সময় তার নেই। সে শুধু জোহেবকে খুঁজে বেড়ায়।
জোহেবকে তার এখন খুব মনে পড়ে। তার মতো সরল মনের ছেলেকে ভালোবেসে একদিন সে মনে মনে খুব গর্ব করতো।
জোহেবও তাকে খুব ভালোবাসতো। এটা সে পাঁচ-বছরে খুব বুঝেছিল। তবুও সে তাকে অপমান করেছে। কতবড় ভুল করে ফেলেছে! আজ সে তা বুঝতে পারছে।
শহরে জোহেবদের তেমন কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। সে কারও কাছে গিয়ে ওর ঠিকানাটা চাইতে পারলো না।
তার বিয়ের জন্য বাড়িতে সবাই এবার খুব উঠেপড়ে লেগেছে। দুই-একদিন পরপরই পাত্রপক্ষ আসছে তাকে দেখতে। কোনদিন না জানি তার বিয়ে হয়ে যায়!
সে এখনও জোহেবের ঠিকানাটা জোগাড় করতে পারলো না। আজ সে রাস্তায় প্রকাশ্য জনসমুদ্রে রিকশায় বসে কেঁদে ফেললো! এত শক্তমনের তাহমিনা আজ কেমন করে যেন ভেঙে পড়লো। তা কেউ না জানলেও তাহমিনা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। আসলে, সে যে জোহেবকেই ভালোবেসেছে!
দুপুরের তপ্ত রোদে সেদিন জোহেবকে খুঁজতে-খুঁজতে হয়রান হয়ে রিকশায় চড়ে ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরছিল তাহমিনা। হঠাৎ তার মনে হলো―চলন্ত একটা বাসের জানালার পাশে বসে ছিল সে!
এরপর তাহমিনার বুকের ভিতরে কেমন করে যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো! এত শক্তমনের মেয়ে হয়েও সে বরফের মতো গলে যেতে লাগলো!
তাহমিনা এখন কাঁদছে! তার চোখে এখন জল!
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:১৭