গল্প: ইঁচড়ে পাকা
সাইয়িদ রফিকুল হক
মেয়েটি খুব সকালে কলেজের বাস ধরার জন্য দ্রুত হাঁটছিল। তার সকল মনোযোগ ছিল বাসটার প্রতি। এই রুটে তাদের কলেজের একটামাত্র বাস। এটি কোনোক্রমে একবার মিস হয়ে গেলে তাকে জনমানবের প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে লড়াই করতে হবে। এসব তার ভালো লাগে না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে তাকে এসব করতে হয়। আজকাল ভিড়ের মধ্যে অনেক ছেলে ইচ্ছাকৃতভাবে মেয়েদের শরীর-স্পর্শ করার চেষ্টা করে। এসব মনে হলে সুরভীর মনে দারুণ ঘৃণা জন্মে। আর কলেজের বাসটা পেলে এসব থেকে আপাততঃ রেহাই পাওয়া যায়। তাই, সে কলেজের বাসটা ধরার জন্য এত ব্যস্ততার সঙ্গে ছুটছিল।
সে পথ চলতে-চলতে ভাবে: মানুষের মন থেকে দিন-দিন আল্লাহর ভয় যেন কমে যাচ্ছে। আর মানুষগুলো কেমন স্বার্থপর ও লোভী হয়ে উঠছে। এদের সংখ্যা আরও বাড়লে তাদের কী উপায় হবে? সুরভী আর ভাবতে পারলো না। তার মাথাটা দুশ্চিন্তায় ব্যথা করছে। সমাজে অবাধে বিচরণকারী এইসব পশুর কথা ভাবলে তার মনটা নীলযন্ত্রণায় কেমন যেন ছটফট করতে থাকে। সে এসব ভাবতে চায় না—তবুও কেমন করে যেন এই পশুদের কথা তার মনে চলে আসে!
সে যখন ডাকবাংলার মোড়ে এল তখন নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল যে, সে আজও বাসটা ধরতে পারবে। সে ডানদিকে মোড় নিয়ে হাঁটছিল। এমন সময় সে দেখলো, একটা চায়ের দোকানের সামনে রোমিওবেশে কতকগুলো ছেলেছোকরা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে আপত্তিকর আড্ডাবাজিতে লিপ্ত হয়েছে। ওদের মুখের ভাষা শুনলে সুরভীর কয়েক সপ্তাহ রাস্তায় বের হতে ইচ্ছে করে না। তবুও তাকে ছুটতে হয়। আজও সে এই জায়গাটা অতিক্রম করার সময় ইঁচড়ে পাকা ছেলেগুলোর নোংরা কথা শুনতে পেল। আর এগুলো যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তা সুরভী জানে। সে ওদের নোংরা কথাগুলো হজম করে আগের মতো দ্রুততার সঙ্গে হাঁটতে লাগলো। সে জানে, ওরা এখন সংখ্যায় অনেক বেশি। তারউপরে এখন সকালবেলা। রাস্তায় মানুষজনের সংখ্যাটাও অনেক কম। এদের সঙ্গে কোনোকিছু বলতে যাওয়া মানে নিজের সম্মান হারানোর ভয় রয়েছে। সে ভীতুপ্রকৃতির মেয়ে নয়। তার যথেষ্ট সাহস আছে। তবুও মাঝে-মাঝে পরিবেশপরিস্থিতির কারণে কেমন করে যেন তাকে একটু ভীতু হয়ে যেতে হয়। এই সমাজ মেয়েদের একটু ভীতুই দেখতে চায়!
এদের নোংরা কার্যকলাপ দেখে মাঝে-মাঝে তার মনের মধ্যে দারুণ একটা ক্ষোভের জন্ম হয়। আবার সে নিজের মানসম্মান বজায় রাখার স্বার্থে সবকিছু হজম করে নেয়। আর তার কেবলই মনে হয়: এই পশুদের সঙ্গে সে একা কী করবে? সমাজে আরও অনেক লোক যদি এই পশুদের বিরুদ্ধে একটুখানি রুখে দাঁড়াতো—তাহলে এদের জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। তার মনে হলো: এরা তো মানুষ নয়—একেবারে পশু। আর এইটুকু বয়সে এরা শুধু মেয়েদের শরীর চিনেছে। এরা একটা ভালো বই পড়বে না। ভালো একটা মুভি দেখবে না। জীবনে ভালো একটা স্বপ্নও দেখবে না! এদের চোখেমুখে শুধু মেয়েদের শরীরটাই ভাসে। এই পশুদের দিয়ে এই সমাজ কী করবে? এদের এখন নিয়মিত পড়ালেখা করার বয়স। এরা এখন জীবন গড়বে নিজেদের মতো করে। এদের স্বপ্ন থাকবে বড় মানুষ হওয়ার। তা না করে এরা মেয়েদের শরীর নিয়ে অনবরত চিন্তাভাবনায় নিয়োজিত। এদের গবেষণার একমাত্র বিষয় মেয়েদের শরীর!
সুরভী একবার ওদের দিকে আড়চোখে তাকালো। সে তখনই বুঝতে পারলো, তার অনুমান সঠিক। এদের বয়স ষোলো থেকে বড়জোর আঠারোর মধ্যে। ওরা এখনও কিশোর। কিন্তু ওরা কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করছে? ওদের কি বাপ-মা নাই? ওরা কি অন্ধ হয়ে আছে? নাকি ওরা ভেবেছে, সমাজে মানুষ পয়দা করেছি—এখন আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নাই! এদের বাপ-মা’র কথা ভেবেও সুরভীর লজ্জা হলো। আর মনে হলো: এরকম বাপ-মা না থাকাই ভালো। এগুলো হয়তো সামাজিক এতিমসন্তান। তাই, সকালে-বিকালে কিংবা রাত অবধি আড্ডাবাজি করে নিজের জীবনটাকে ধ্বংস করছে। এই আড্ডাও একটা ভয়াবহ নেশা। এইরকম কুরুচিপূর্ণ আড্ডা নেশার চেয়েও ভয়ংকর ও ক্ষতিকর।
সে বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলো, তাদের কলেজের বাসটা এখনও আসেনি। এজন্য সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। একটু পরে সে আরও দেখলো, বাসের জন্য আরও কয়েকটি মেয়ে প্রায় ছুটতে-ছুটতে এদিকে আসছে। ওরা তার চেনা মেয়ে। সুরভী ওদের দেখে হাসলো।
বাস এল আরেকটু পরে। ওরা বাসে উঠে পড়লো। আর খুব অবাক হলো, আজ বাসে ভিড় কম! কিন্তু বাসে ভিড় কম কেন—এ প্রশ্ন তাদের কারও মনে জাগলো না। তারা বাসে উঠতে পেরে সন্তুষ্ট।
সুরভী আজ একটা সিট পেয়েছে। প্রতিদিন সে এই ডাকবাংলার মোড় থেকে দাঁড়িয়ে কলেজে যায়। এখান থেকে সিট পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু আজ সে একটা সিট পেয়ে পরম প্রভুকে মনে মনে কয়েকবার ধন্যবাদ জানালো। এজন্য তার মন থেকে কয়েকবার উচ্চারিত হলো শোকর আলহামদুলিল্লাহ। সে খুব অল্পে তুষ্টপ্রাণ।
সুরভী সরকারি ব্রজলাল কলেজে এবারই অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। সে মনমতো সাবজেক্ট না পেলেও পছন্দমতো একটা সাবজেক্টে চান্স পেয়েছে। এজন্যও সে পরম প্রভুর কাছে কৃতজ্ঞ। সে জীবনে বেশি কিছু চায় না। কাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু একটু পেলেই সে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যায়। ইংরেজিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সে নিয়মিত ক্লাস করছে। বাড়িতেও সে প্রচুর পড়াশুনা করে। বই পড়তে তার ভালো লাগে। এজন্য সে তার বাবাকে অনেক জ্বালাতন করে। তবে তার বাবা হাসিমুখে তাকে সব বই কিনে দেন। কোনো বয়ফ্রেন্ড কিংবা ঠুনকো প্রেমিক না থাকায় বইই সুরভীর প্রধান বন্ধু হয়ে উঠেছে। সে পড়ালেখা করে তার বাবার স্বপ্নপূরণ করতে চায়। তাদের কোনো ভাই না থাকায় তারা দুটি বোন খুব মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। স্কুলশিক্ষক বাবার দেখানো স্বপ্ন তাদের চোখেমুখে সবসময় খেলা করে।
হাঁটতে-হাঁটতে এইসময় তার বাবার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবা কি এত সকালে ঠিকমতো স্কুলে পৌঁছাতে পেরেছেন? বাবার জন্য সে মনে মনে প্রার্থনা করলো। দিনে-দিনে এই বাবাটা তার বন্ধু হয়ে উঠেছে। এই বাবার জন্য তার মনে খুব মায়া।
কলেজে এসে সুরভী দেখলো, আজ ক্লাস হবে না। ছেলেরা কীসের যেন মিটিং করছে। এসব সুরভীর ভালো লাগলো না। সে আরও জানলো, আজ আর কলেজের বাস ফিরতি রুটে চলবে না। সেখানেও কীসের যেন একটা স্টাইক। এসব দেখে সুরভীর মন ও মেজাজ দুটোই বিগড়ে গেল। সে রিক্সায় করে বাসায় ফেরার কথা ভাবতে লাগলো। হঠাৎ সে কলেজের লাইব্রেরির সামনে থমকে দাঁড়ালো। কিছুটা সময় সে এখানে বসে বই পড়ার কথা ভাবছে। সে লাইব্রেরির ভিতরে ঢুকে দেখলো, আরও কয়েকটা মেয়ে এখানে বসে বই পড়ছে। তবে কেউই তাদের ক্লাসের নয়। তবুও এই মেয়েগুলোকে দেখে তার খুব ভালো লাগলো।
সুরভী আগে খুব বাংলা বই পড়তো। এখন ক্লাসের পড়ার চাপে তাকে ইংরেজি বইও বেশি পড়তে হচ্ছে। এজন্য সে খুব আনন্দিত। এতে দুই ভাষার সাহিত্যে তার অনুরাগ জন্মানোর পাশাপাশি দক্ষতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্লাসিক-লেখকদের বই তাদের পাঠ্যসূচিতে বেশি অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। তবে সে আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের বইও পড়ে। হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড তার প্রিয় লেখকদের একজন। এঁর বই পেলে সে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে তা পড়তে থাকে। এজন্য তাকে মায়ের বকুনিও শুনতে হয়। তবুও সে বই পড়ে পাগলের মতো। এজন্য সে তার বাবার কাছে কৃতজ্ঞ। বাবা তাকে বই কিনে দিতে কখনও কার্পণ্য করেন না। পড়তে-পড়তে সে দেখলো, দুপুর হয়ে আসছে। এবার তাকে বাসায় ফিরতে হবে।
দুপুরের একটু আগে সে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এলো। আর হাঁটতে লাগলো রিক্সার খোঁজে।
কলেজের সামনে এসে সে কোনো রিক্সা পেল না। এখন সবাই রিক্সা খুঁজছে। তবুও সে একটা রিক্সার আশায় সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু তার আশা পূরণ হলো না। এবার সে সামনের দিকে আস্তে-আস্তে হাঁটতে লাগলো।
হাঁটতে-হাঁটতে সে কিছু সময়ের জন্য একেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো, একটা ছোকরা হোন্ডা নিয়ে তার পাশে-পাশে চলছে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে হোন্ডার গতি কমিয়ে হোন্ডায় চড়ে যেন তার পাশে হাঁটছে! সে যে তাকে উদ্দেশ্য করে এভাবে হাঁটছে—তা সুরভী স্পষ্ট বুঝতে পারলো। সে আরও বুঝতে পারলো, এই বখাটে ছেলেটা বয়সের দিক থেকে তার চেয়ে কমপক্ষে দুই-তিন বছরের ছোট হবে। এটা বুঝতে পেরে তার খুব রাগ হলো।
সে দেখলো, ছেলেটা আড়চোখে বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। এটা দেখেও রাগে সুরভীর পিত্তি জ্বলে গেল। সে ছেলেটাকে চিনলো। এই ছেলেটাও ডাকবাংলার মোড়ে চায়ের দোকানের সামনে বখাটেগুলোর সঙ্গে আড্ডাবাজি করে। এটাও ভয়ানক ইঁচড়ে পাকা।
আরেকটু পরে সুরভী বুঝতে পারলো, ছেলেটি তার সঙ্গে ভাব জমাবার পাঁয়তারা করছে। সে এসব বুঝেও আগে থেকে তাকে কিছু বললো না। সে এদের একেবারে ঘৃণা করে। এরা বাপের বখে যাওয়া নষ্ট সন্তান। এদের হয়তো টাকাপয়সা আছে কিন্তু শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব নাই।
সুরভীকে দেখে একটা রিক্সা এগিয়ে আসছে। এমন সময় হোন্ডাধারী ছেলেটি সুরভীর সামনে হোন্ডার ব্রেক কষে খুব ভাব নিয়ে বললো, “আপনি পোস্ট-অফিসের কাছে থাকেন না? চলেন আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেই।”
ওর মুখে এমন একটা কথা শুনে সুরভী রাগে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে হঠাৎ তার ডান হাতটা শূন্যে তুলে বললো, “এটা দেখছিস? এক চড়ে তোর দাঁত সবক’টা ফেলে দিবো। বেআদব কোথাকার। আমি তোর চেয়ে বয়সে বড় না? ভাগ এখান থেকে।”
ব্যস, এতটুকুতেই কাজ হলো। সুরভীর হঠাৎ এই অগ্নিমূর্তী দেখে ইঁচড়ে পাকা ছেলেটি হোন্ডা সজোরে চালিয়ে সটকে পড়লো।
এবার সুরভী আপনমনে হাসতে লাগলো। আর ভাবলো: এই বখাটেগুলোর সাহস তাহলে খুব একটা বেশি নয়। এদের এত ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এখন থেকে রুখে দাঁড়ালেই ওদের খেল খতম!
©সাইয়িদ রফিকুল হক
২২/১২/২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০