ছোটগল্প:
আফসারের চোখে জল
সাইয়িদ রফিকুল হক
আফসার বাসস্ট্যান্ডে এসে আজ বড় ভাবনায় পড়ে গেল।
বাসে আজ খুব ভিড়। তার কাছে রাস্তায় আজ লোকজনের উপস্থিতি একটু যেন বেশি মনে হচ্ছে।
এদিকে অফিস-টাইম প্রায় হয়ে গেছে। আর-একটু দেরি করলে আজ তাকে নির্ঘাত বসের কড়াধমক কিংবা নিদেনপক্ষে কটুকথা শুনতে হবে।
সে দেখলো, একটা মিনিবাস আসছে। সে যেন চোখের সামনে হঠাৎই আশার আলো দেখতে পায়। বাসটা কাছে আসতেই সে তাতে ওঠার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। লোকজনের ঠেলায় তার গোরস্থানে কিংবা শ্মশানে যাওয়ার অবস্থা।
সে বুঝলো, আজকাল বাসে চড়তে হলেও একজন মল্লযোদ্ধা হতে হবে। আর নয়তো একজন সাধারণ কুস্তিগীর হওয়া চাই। নইলে, এই ঢাকা-শহরের বাসে চড়া ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার।
এরপর এলো একটা সিটিংচিটিং-বাস। এখানেও মারাত্মক ভিড়। তাই, সে আগে থেকে অন্য গাড়ির তুলনায় এখানকার জন্য বেশি টাকা দিয়ে একখানা টিকিট কিনে ফেললো। তারপর সে নেমে পড়লো বাসে চড়ার প্রতিযোগিতায়।
টিকিট কেটেও আজকাল লোকজনের কোনো স্বস্তি নাই। সবখানে এখন কেবল ফাঁকি, অনিয়ম আর দুর্নীতি। ঢাকা-শহরের সিটিংচিটিং-বাসগুলো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারক। এদের কোনো চরিত্র নাই—মনুষ্যত্ব নাই। এমনকি ধর্মও নাই। এরা জানোয়ার। তাই, এরা শুধু অর্থই চেনে। লোকজনের সঙ্গে আফসারও বাসে ওঠার চেষ্টা করছে। মানুষজন বাসে উঠছে। তারপরও এরা ঠিকভাবে যাত্রী না উঠিয়ে গাড়ি টানতে থাকে। প্রতিনিয়ত ইচ্ছাকৃতভাবে এরা যেন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। আর সকালবেলার গাড়িগুলোতে এরা বেশি লোক নেওয়ার জন্য কৃত্রিমভাবে বাস-সংকটসৃষ্টি করে। এসবকিছু দেখেশুনে তাই আফসারের মনে হলো—দেশের পরিবহণ-সেক্টর এখন পশুদের হাতে।
সে লোকের ভিড় ঠেলে কোনোরকমে এই বাসটার গেটের কাছে একটু দাঁড়ানোর জায়গা পেলো। কিন্তু আর ভিতরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। তবে এটুকুতেই এখনকার মতো খুশি হয়েছে আফসার। সে সবসময় অল্পে তুষ্ট।
সে দেখলো, বাসের ভিতরে এখনও কিছু জায়গা আছে। কিন্তু গেটের একটু উপরে একটা জায়গায় দুনিয়ার লোকের ভিড় যেন! এই জায়গাটাতে এতো ভিড় কেন? সে কোনোরকমে ফাঁকফোঁকড় গলিয়ে আরও দেখলো, এখানে একটা সিটে বসা নিয়ে কয়েকটা লোকের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ চলছে। আর কে কার আগে বসবে—তারই দুর্বিনীত আয়োজন। একজন বয়স্কলোক কতিপয় জওয়ানের মারমুখীভাব দেখে পিছু হটতে লাগলেন।
আফসারের তখন মনে হলো: আহারে! এই লোকটাতো একজন মুক্তিযোদ্ধাও হতে পারে! আমরা কি তার কথাটা একটু ভাবতে পারি না?
কিন্তু এখন কে ভাবে কার কথা? গায়ের জোরে একটা ছোকরাবয়সী ছেলে সবাইকে প্রায় ঠেলেঠুলে নিজের দখল করা সিটটাতে বসে পড়লো। আর তার মুখে সে কী বিজয়ের হাসি! তার হাবভাব দেখে মনে হলো—সে যেন এইমুহূর্তে ভারতবর্ষ-জয় করেছে!
আফসার এসব দেখে ভিতরে-ভিতরে যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো। সে এতোক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে এসব তামাশাই দেখছিলো। আর ভাবছিলো—মাত্র কিছুদিন আগে—১৯৭১ সালে, এই দেশটার জন্য ৩০লক্ষ মানুষ অকাতরচিত্তে জীবন দিয়েছেন। তাঁদের আত্মত্যাগের কথা ভাবলে আনন্দে আফসারের চোখে জল আসে। তাঁরা কী নিঃস্বার্থ আর কী মানবদরদী ছিলেন! কী পবিত্র হৃদয়ের অধিকারী মহামানব ছিলেন আমাদের চিরগর্বের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা! আর আজ আমরা সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য সকলপ্রকার নীতিনৈতিকতা হারিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ করে চলেছি। এটা তো মানুষ আর মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আর মারাত্মক সীমালংঘন! এই জাতি এই দেশ কীভাবে বড় হবে?
লোকজনের মধ্যে এখন ত্যাগের মহিমা কমে যাচ্ছে। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য, আর বাসের সিটে কে কার আগে বসবে—কিছুলোক তা-ই ভাবছে! এরা কতটা নির্লজ্জ আর কী ভয়ংকর অসভ্য হয়ে উঠছে—তা হয়তো এরা এখনও বুঝতে পারছে না। সামান্য একটা বাসের সিটের জন্য এরা আজ নিজেদের মনুষ্যত্ব পর্যন্ত বিসর্জন দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করছে না। এরা, একটা বাসে চড়া নারী, শিশু, বৃদ্ধ, পঙ্গু ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা তো কেউ ভাবছে না! সবাই শুধু এখন ঠেলাঠেলিতে ব্যস্ত! এই কি স্বাধীনদেশে আমাদের মনুষ্যত্ব?
ভাবতে-ভাবতে আফসারের যেন চোখ ফেটে জল আসবে! এমনই একটা অবস্থা তার। সে মানুষের অধঃপতন দেখলে শিউরে ওঠে। মানুষের প্রতি দানবীয় আচরণ দেখে সে শিহরিত হয়। আর তার চোখে জল চলে আসে। সে মানবাত্মার পরাজয় দেখতে পারে না। সহ্য করতে পারে না। মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে তার চোখে জল আসে।
সে ড্রাইভারের পিছনে বাসের ডানদিকে পর-পর তিনটি আসনজুড়ে লালকালিতে লেখা দেখলো—এই নয়টি সিট—মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত! কিন্তু সেখানেও বসে আছে একশ্রেণীর বেশরম, অসভ্য ও দাঁতাল পুরুষ। এদের, মেয়েদের সিট ছেড়ে উঠতে বললেও এরা ওঠে না। বরং এরা আরও নির্লজ্জ হয়ে গায়ের জোরে নানারকম কুৎসিত যুক্তিপ্রয়োগ করার অপচেষ্টা করে থাকে।
এসব দেখে-দেখে আর ভেবে-ভেবে আফসারের চোখে সত্যি-সত্যি একসময় জল এসে গেল। তার বুকটা ফেটে যেন অমনি একটা দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে এলো—আজও আমরা মানুষের মতো মানুষ হতে পারলাম না। শুধু একেকটা পোশাকি মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! এখানে, মানুষ কোথায়? আর আজ আমাদের মনুষ্যত্বই বা কোথায়?
সে যখন আপনমনে এসব ভাবছিলো, তখনও বুঝতে পারেনি, সামনে তার জন্য এরচেয়ে বড় ঘটনা ও চমক অপেক্ষা করছে।
বাসে ওঠা ও নামার সময় চাপাচাপিটা একটু বেশি হয়। এইসময় চরদখলকারীদের মতো বাসের সিটদখলকারীরা খুব বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
একটা লোক কলাবাগানের কাছে নামবেন। সেজন্য তিনি আগেভাগে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাসে ওঠার মতো নামার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিরাট ঝক্কিঝামেলা। লোকটা উঠে সামান্য দাঁড়ালেন। এমন সময় তার সিটটা দখল করার জন্য কয়েকটা লোক মল্লযুদ্ধে নেমে পড়লো। এদের হাবভাব দেখে আফসারের মনে হলো—এইমাত্র যেন পৃথিবীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল!
সে কারণটা বুঝলো আর-একটু পরে। এখানে, পাশাপাশি দুজন রমণী বসে রয়েছেন। তাদের পাশের এই সিটটা দখল করার জন্যই একদল অমানুষ তার চোখের সামনেই মল্লযুদ্ধ শুরু করে দিলো। সে দেখলো, এখানেও কয়েকজন বয়স্কলোককে পাশ কাটিয়ে তাদের ঠেলেঠুলে কোণঠাসা করে এক কর্পোরেট অফিসের হোমরাচোমরাগোছের একটা সেখানে বসে পড়লো।
তার বুকটা আবার ভরে উঠলো হতাশায়।
সে গেটের কাছের বাসের হ্যান্ডেলটা ধরে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে—এই লোকগুলো মানুষ হয়েই আজ এতো হিংস্র আর আগ্রাসী! এরা যদি নামকাওয়াস্তে মানুষ না হয়ে বনের হিংস্র নেকড়ে কিংবা হায়েনা হতো—তাইলে এদের নৃশংসতায় পৃথিবীতে বুঝি কোনো প্রাণিই বাঁচতে পারতো না।
আফসার ধীরে ধীরে বাসের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠাঁই পেলো। এখনও বাসে অনেক ভিড়। তবুও এখানে দাঁড়িয়ে তার এখন কিছুটা ভালো লাগছে।
সায়েন্স-ল্যাবের কাছে এসে কয়েকজন যাত্রী নামলো। আর উঠলোও আরও কয়েকজন।
এক মহিলাযাত্রী বাসে উঠেই তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলোতে বসে থাকা পুরুষদের দিকে চেয়ে ভদ্রভাবে বললেন, “ভাই, এগুলোতো লেডিস-সিট। দয়া করে সিট ছেড়ে দিন।”
মহিলাসিটে বসা লোকগুলো তার কথা শুনে পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। যেন কেউ তার ভাষা বুঝতে পারছে না। তারা একেবারে ভাবলেশহীন। আর কেউ সিট ছাড়ার নাম করে না। একটা লোক সিটে এমনভাবে বসে রইলো যে, সে যেন বিবাহের যৌতুক হিসাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে এটি পেয়েছে!
এসব দেখে অনেকের মাথা ঠিক থাকে না। দুই-চারজন প্রতিবাদী সবজায়গায় দাঁড়িয়ে যায়।
আফসারের পাশে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক এই অবস্থাটা দেখে মহিলাসিটে বসা লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে একটু জোরের সঙ্গে বললেন, “ভাই, আপনারা মহিলাসিটগুলো ছাড়েন না কেন? আপনারা কি সোজা কথাটাও বুঝতে পারেন না?”
কথাটা শোনার পর কারও কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। হঠাৎ আফসারের সামনের সিটে বসা মোটাসোটা স্বাস্থ্যবান এক লোক বলে উঠলো, “কীসের সিট ছাড়বে? বাসের সিটে যে যেমন বসতে পারে। মহিলারা যখন আমাদের সিটে বসে থাকে তখন কিছু হয় না! কিছু লোকজন না বুঝেই আজকাল মহিলাদের পক্ষে দালালি করে।”
কথাটা ভয়ানক অশ্লীল এবং সামাজিক পরিবেশে শিষ্টাচারবহির্ভূত।
আফসার বুঝলো, বাসে এখন শূয়রও চড়ে! তার ইচ্ছে করছিলো, এই লোকটাকে এখানে, এইমুহূর্তে জুতাপেটা করতে। কিন্তু বাসের পরিবেশবিনষ্ট হতে পারে ভেবে সে নিজের ক্রোধসংবরণ করলো।
মহিলাদের পক্ষে কথা বলা সেই ভদ্রলোক এতে মনে খারাপ না করে তার কথার জবাবে অশ্লীলকথা বলা সেই লোকটিকে খুব আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কী করেন?”
লোকটি তখন খেঁকিয়ে উঠলো, “কী করি মানে? আমি বিদেশে থাকি।”
ভদ্রলোক বললেন, “কোন দেশে?”
সেই খেঁকিয়ে ওঠা আবার বললো, “মিডল ঈস্টে!”
তখন সেই প্রতিবাদকারী ভদ্রলোক আফসারের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “বুঝলাম। এগুলো মিডল ঈস্টের পশু! এখনও মানুষ হয়নি।”
আফসার এইসময় ভদ্রলোককে সমবেদনা জানানোর জন্য বললো, “এরা মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে গিয়ে শুধু পয়সাটাই চিনেছে। মুনষ্যত্ব চেনেনি। আর আরবদেশে নারীদের সম্মান করাটা ওদের সিস্টেমের বাইরে! এজন্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা লোকগুলো এরকম চাঁছাছোলা ও অভদ্র হয়ে থাকে।”
বাসে আরও কিছুসংখ্যক লোক মানবিক কারণে মহিলাদের সিটগুলো ছেড়ে দেওয়ার জন্য ওই বসা লোকগুলোকে অনুরোধ করলো। কিন্তু মহিলাদের সিটগুলো জবরদখলকারীদের মনে এতে কোনো প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি হলো না। এদের কেউই দখলকৃত সিটগুলো ছেড়ে উঠলো না। মধ্যপ্রাচ্যের ওই শ্রমিকের মতো আরও কিছু লোক এদের সমর্থনও করলো!
আফসার ক্ষুব্ধমনে ভাবলো, এই শূয়রগুলোকে বাসে ওঠার পারমিশন দিয়েছে কে?
অনেক যুদ্ধের পর আফসার ঠিকসময়েই অফিসে পৌঁছুতে পারলো।
সে অফিসে ঢুকে দেখলো, তার পাশের টেবিলে তারচেয়ে বয়সে অনেক সিনিয়র গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। তার জন্য আফসারের খুব মায়া হলো। আর তার মনটা কেমন যেন করতে লাগলো।
লোকটা তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। হয়তো বাসের জন্য তিনি এখনও রাস্তায় যুদ্ধ করছেন।
আফসার যখন গুলজারসাহেবের কথা ভাবছিলো—তখন তিনি এসে অফিসে ঢুকলেন। এতে আফসারের মনটা আনন্দে ভরে উঠলো।
সে ভাবলো, যাক, ভদ্রলোক হয়তো আজ বেঁচে যাবেন। মাত্র দশ মিনিট লেট হয়েছে তার।
আফসার অফিসের কাজ শুরু করার আগে লক্ষ্য করলো, তাদের সিনিয়র-অফিসার তরুণী-সুন্দরী মাহজাবিন রশিদ এখনও অফিসে এসে পৌঁছায়নি। ইদানীং সে নিয়মিত দেরি করে অফিসে আসে। কিন্তু এতে তার অফিসিয়ালি কোনো সমস্যা হয় না। সমস্যা যতো তাদের। তারা দিনরাত খেটে মরলেও তাদের দোষ। আর তাদের কাজেকর্মে একটু পান থেকে চুন খসলে অমনি বসদের নানারকম নীতিকথা শুরু হয়ে যায়। দেশটা যে রসাতলে যেতে বসেছে তাতে আফসারের মনে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার খুব দুঃখ হয়—এটা যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ! এতো মানুষের আত্মত্যাগ কখনও বৃথা যেতে পারে না। কবে ঘুরে দাঁড়াবে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা?
মাহজাবিন এখনও আসেনি। আফসার আজ এটা খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করতে থাকে। চল্লিশ মিনিট পার হওয়ার পরও সে এলো না।
আফসার এবার নিজের কাজে মন দিলো। সে কাজের মাঝে ডুবে যেতে চাইলো। কিন্তু বাসের লোকগুলোর কথা মনে পড়তেই তার মনটা কেমন যেন তিতা হয়ে গেল! তবুও সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে মন বসালো।
আফসার নিজের কাজ করছিলো। এমন সময় সে দেখলো, এমডি’র খাসপিয়ন এসে গুলজারসাহেবের কাছে খুব আস্তে কী যেন বললো। আর অমনি গুলজারসাহেব উঠে তার পিছনে বেরিয়ে গেলেন।
ঘণ্টাখানেক পরে মাহজাবিন খুব স্টাইল করে কড়া পারফিউম ছড়িয়ে অফিসে এসে ঢুকলো। এইসময় প্রায় সবাই তাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। মেয়েটির যৌবন ভূমিকম্পের মতো! যেন সে এখনই একটিমাত্র কম্পনে দুনিয়ার সবকিছু লণ্ডভণ্ড ও তছনছ করে দিবে!
আফসার বুঝতে পারলো, অফিসে কারও-কারও কাছে তার কেন এতো কদর!
সে আবার কাজে মন বসালো। মাহজাবিনের যৌবন তার হৃদয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারেনি। এজন্য সে নিজেকে মনে মনে ধন্যবাদ জানালো। তারপর আফসার তার ডানপাশে চেয়ে দেখলো, গুলজারসাহেব এখনও আসেননি। সে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি গেলেন কোথায়?
একটু পরে খুব মনমরা হয়ে গুলজারসাহেব প্রায় ছলছল চোখে তার পাশে এসে বসলেন।
আফসার সঙ্গে-সঙ্গে হাতের কাজ ফেলে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো, “কোথায় গিয়েছিলেন? আর কী হয়েছে আপনার?”
গুলজারসাহেব বাঁহাতে চোখদুটো মুছে বললেন, “আজ অফিসে আসতে একটু লেট হয়েছে। বস আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। আর তার রুমে ডেকে খুব খারাপ ভাষায় আমাকে ধমকালেন।”
তারপর তিনি আরও মনখারাপ করে আফসারের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি কি রোজ-রোজ দেরি করে আসি! আপনিই বলুন তো!”
কথাটা বলে তিনি শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন।
আফসার নিজেও ছলছল চোখে তাকে সান্ত্বনা জানালো।
আজ সে আরেকবার বিধ্বস্ত হলো। এবার সে যেন ভেঙে পড়লো। সে ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে থাকে। মানবতা ও ন্যায়বিচার কি দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে নাকি? আফসারের মনটা একসময় বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এইমুহূর্তে দুনিয়ার সমস্ত অনিয়ম ও ভণ্ডামি তার ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করছিলো।
একটু পরে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় আফসার দেখলো, মাহজাবিন রশিদ তাদের বসের কাচের দেওয়ালঘেরা রুমের মধ্যে বসে বসের সঙ্গে কী-সব আলাপ করছে, কথা বলছে, আর খুব হাসছে! আর সে কেবলই হাসতে-হাসতে একেবারে লুটিয়ে পড়ছে। আর তার সামনে রয়েছে ধূমায়িত কফির মগ! দুজনে একসঙ্গে কফি-মগে চুমুক দিয়ে কী অপূর্ব স্বাদ অনুভব করছে!
মাহজাবিনের যৌবন তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তার যৌবনঝড়ে লণ্ডভণ্ড তার বড়কর্তা।
আর এপাশে একজন সৎ, বিশ্বস্ত ও আদর্শবান অধস্তন কর্মচারী আজ একটু বিলম্বে অফিসে এসেছে বলে তাকে জঘন্য ভাষায় তিরস্কার করেছে তারই ছেলের বয়সী, ছোকরাবয়সী একটা এমডি। তিনি মনঃকষ্টে শিশুর মতো কেঁদেছেন। হয়তো ভিতরে-ভিতরে এখনও গুমরে-গুমরে মরছেন!
আফসারের দিনভর কেবলই মনে হলো—গুলজারসাহেব এই ছোকরা-বসের পিতার বয়সী একজন মানুষ। তবুও তাকে লাঞ্ছিত করতে তার বুকে বাধলো না! সমাজটা এখন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
একসময় আফসারের চোখ ফেটে যেন জল এলো।
হ্যাঁ, আফসার এখন কাঁদছে। তার চোখে জল।
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
১৯/১২/২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৪৯