ছোটগল্প: রমণীর মন
সাইয়িদ রফিকুল হক
আজ রাস্তায় খুব ভিড় ছিল। এমন ভিড় এই শহরে তিনি অনেকদিন পরে দেখেছেন।
অফিস-ছুটির পর অনেক কষ্টে মোতালেবসাহেব বাসায় ফিরেছেন। গায়ের জামাকাপড় এখনও খোলেননি।
তবে ধীরেসুস্থে জামাকাপড় খুলে তিনি একটু বিশ্রাম নেওয়ার প্রস্তুতিগ্রহণ করছিলেন।
শীতকাল বলে তিনি আজ একটুও ঘামেননি। নইলে, বাসের ভিতরে মানুষের ভিড়ের চাপে তিনি ঘেমে-নেয়ে একেবারে একাকার হয়ে যেতেন। এজন্য তিনি অনেক কষ্টে বাসায় ফিরেও মনে মনে বিরাট স্বস্তি অনুভব করলেন।
আজ রাস্তায় খুব ভিড় ছিল। এই ভিড় দেখলে মোতালেবসাহেবের ভালো লাগে না। তিনি গ্রামের ছেলে। শুধু চাকরির সুবাদে এই ঢাকা-শহরে এসেছেন। মানুষের এতো ভিড় তার কখনওই ভালো লাগে না। তিনি সবসময় খুব নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করেন। তার দুটি ছেলেমেয়ে না থাকলে এতোদিনে তিনি কবে গ্রামে ফিরে যেতেন। অবশ্য তার স্ত্রী গ্রামের মেয়ে হলেও এখন আর গ্রামে ফিরতে মোটেও রাজী নয়। সে এই শহরে চিরদিন থাকার পক্ষপাতী। এই নিয়ে তাদের মধ্যে অবশ্য কখনও ঝগড়া-ফাসাদ হয় না।
মোতালেবসাহেব বরাবর শান্তশিষ্ট মানুষ। তিনি কখনও স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেন না। তার স্ত্রী মুখরারমণী হওয়া সত্ত্বেও সবকিছু মেনে নিয়েছেন মোতালেবসাহেব। ফলে তার স্ত্রী ঝগড়া করার তেমন একটা সুযোগ পায় না। কিন্তু সে মোতালেবসাহেবকে সবসময় কড়া-কড়া-কথা শুনিয়ে বেশ আনন্দ পায়।
আজ মোতালেবসাহেব বাসায় ফিরতেই তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার মুখভার করে তাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগলো, “ঘরে কোনো বাজার নাই! আজ কয়েকদিন তো কোনো বাজারই করো না! এভাবে সংসার চলে!”
মোতালেবসাহেব সবেমাত্র গায়ের জামাটা খুলে একটু ধীরস্থির হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা আর হলো না। সংসারের শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে মোতালেবসাহেব গায়ের জামাটা আবার গায়ে চাপিয়ে একটা ব্যাগ হাতে বাজারে ছুটলেন।
এখন সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ার কারণে ভুলক্রমে মোতালেবসাহেব চশমাটাও বাসায় ফেলে এসেছেন। বাজারে গিয়ে তিনি আজ বুঝলেন, চশমা কত প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু শুধু চশমার জন্য অনেকদূর হেঁটে এখন তার বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করলো না।
মাছবাজারের সব মাছই তার কাছে ভেজাল মনে হলো। তবুও আজ মাছ তাকে কিনতে হবে। ভালো দেখে একটাকিছু বাছাই করার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করতে লাগলেন। শেষমেশ অনেক খুঁজে তিনি একটা বড়সড় কাতলমাছ কিনে ফেললেন। কাতলমাছ তার ছেলেমেয়ের খুব পছন্দের। অবশ্য তিনি নিজেও এগুলো খুব পছন্দ করেন। তবে যেদিন থেকে তিনি ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছেন সেদিন থেকে নিজের পছন্দগুলো অবদমন করে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছেন। সংসারে শুধু একটু শান্তি বজায় রাখার জন্য তিনি আরও অনেককিছু করেন। এগুলো আজকালকার মোতালেবসাহেবদের করতে হয়।
মাছ-কেনার পর্ব শেষ করে তিনি পছন্দমতো তরকারি কিনলেন কয়েক কেজি। তার ব্যাগ দুটো এখন সদাইপাতিতে ভরে উঠেছে। তিনি আস্তে-আস্তে এবার বাসার দিকে হাঁটতে লাগলেন। তার হাতের ব্যাগ দুটো বেশ ভারী হয়েছে। তবুও তিনি রিক্সা নিলেন না। তিনি বুঝলেন, তার একটু হাঁটাও প্রয়োজন। সপ্তাহে পাঁচদিন তাকে নিয়মিত ব্যাংকে যেতে হয়। আর ফিরতে-ফিরতে সন্ধ্যাউত্তীর্ণ হয়ে যায়। আবার কখনও-কখনও রাতও হয়। অনেক সময় বাজারের সময় থাকে না। আজ তবুও তিনি একটু আগে অফিস থেকে বের হয়েছিলেন বলে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পেরেছেন।
সপ্তাহে শুক্র-শনিবার তিনি নিয়মিত বাজার করেন। কিন্তু গত সপ্তাহে শনিবার তার ব্যাংক খোলা থাকায় তিনি সপ্তাহের বাজারটা করতে পারেনি। এজন্য নাসরিন আক্তার আজ তাকে কথা শোনাতে দেরি করেনি।
এতোদিন সংসার করেও মোতালেবসাহেব আজও একজন রমণীর মন বুঝে উঠতে পারলেন না। তিনি যতোই সহযোগিতা করেন না কেন—তার স্ত্রীর দিক থেকে যেন অসহযোগিতার মাত্রা বাড়তে থাকে।
বাসায় ফিরে এবার যেন মোতালেবসাহেব একটুখানি হাঁফছেড়ে বাঁচলেন। তিনি ড্রইংরুমে বসে কিছুক্ষণ টিভি দেখার পরিকল্পনা করতে লাগলেন। অফিসের কাজে তিনি আজকাল টিভি দেখারও সময় পান না। কাজের মেয়েটি তাকে এককাপ চা দিয়ে গেল।
তিনি টিভিটা অন করে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।
তার মতো যারাই এখন ব্যাংকে চাকরি করেন তাদেরই সন্ধ্যার পরে কিংবা রাতে বাসায় ফিরতে হয়। তারউপরে আবার বাসায় ফিরে স্ত্রী-সন্তানদের ফাইফরমাশ খাটতে হয়। এগুলো মোতালেবসাহেব এখন তার দৈনন্দিন রুটিনওয়ার্ক হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
মোতালেবসাহেব একটা অনুষ্ঠান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় স্ত্রীর চিৎকার ও চেঁচামেচিতে তার মনোসংযোগে বিরাট ব্যাঘাতসৃষ্টি হলো। তিনি অনেক চেষ্টা করেও অনুষ্ঠান দেখায় আর মন বসাতে পারলেন না।
তার মনটা হঠাৎ নিভে যাওয়া একটা প্রদীপের মতো মনে হচ্ছে। মোতালেবসাহেবের কাছে জীবনটা এখন পোড়া-কয়লার মতো মনে হচ্ছে। আর এই পোড়া-কয়লাখণ্ডটিতে যেন এখনও আগুন জ্বলছে!
তিনি স্ত্রীর কথা শোনার চেষ্টা করলেন। তার স্ত্রী চেঁচিয়ে বারবার বলছে: বাজার করতে-করতে বুড়ো হয়ে গেল! তবুও বেগুনে পোকা! ধনিয়াপাতা একটু পাকা-পাকা! আর এই রাতে কেউ এতোবড় কাতলমাছ কিনে আনে!
সবমিলিয়ে আজ মোতালেবসাহেবের পারফরম্যান্স প্রায় শূন্যের কোঠায়। তিনি টিভি বন্ধ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ দুচোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবতে লাগলেন।
মোতালেবসাহেব তবুও মনখারাপ করলেন না। স্ত্রীর ওপর রাগ করলেন না। তিনি মনে-মনে শুধু হাসলেন। আর ভাবলেন: এই শীতের সন্ধ্যারাতে তিনি এতো কষ্ট করে বাজার করে আনলেন—তবুও তার ভাগ্যে একটা ধন্যবাদ জুটলো না! হায়রে রমণীমন!
একসময় চিৎকার ও চেঁচামেচি থেমে গেল। মোতালেবসাহেব বুঝলেন, জগতে তুচ্ছ বিষয়গুলো নিয়ে এতো লংকাকাণ্ড বাঁধিয়ে কোনো লাভ নাই। তারচেয়ে একটুখানি চুপ করে থাকা ভালো। আর একপক্ষ একটু ছাড় দিলে পৃথিবীটা অহেতুক নানারকম প্রলয়কাণ্ড থেকে বেঁচে যাবে।
তিনি টিভিটা অন করে আবার তার পছন্দের অনুষ্ঠান মন দিয়ে দেখতে লাগলেন। আর আপনমনে হাসতে লাগলেন। তিনি অফিসের কত লোককে বশ করে রেখেছেন। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে কিছুতেই একটুখানি অধীন করে রাখতে পারছেন না। সবখানে মানুষের অতিআধুনিকতার ভয়াবহ এক উত্থান ঘটেছে। মানুষ, মূর্খতার কারণে এখন সৌন্দর্যকে বিসর্জন দিতে শিখেছে। আর তাই, সেখানে বাসা বেঁধেছে অসুন্দর ও কুৎসিত বিষয়গুলো।
আরও ঘণ্টাখানেক পরে মোতালেবসাহেব জানতে পারলেন, বাজার থেকে গরমমসলা আনা হয়নি। তিনি আবার বাজারে ছুটলেন। তবুও যদি সংসারে শান্তি বজায় থাকে।
তিনি লুঙ্গিপরা অবস্থায় কোনোরকমে একজোড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে বাজারে এসেছেন। সাধারণতঃ তিনি লুঙ্গি পরে বাইরে খুব-একটা বের হন না। কিন্তু একটুখানি আগে হঠাৎ তার মানসিক অবস্থা এমন হয়েছিলো যে, তিনি আর প্যান্টপরার কথা ভাবতে পারেননি।
রাতে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর সঙ্গে খেতে বসলেন মোতালেবসাহেব। এখানেও মোতালেবসাহেব আক্রমণের শিকার হলেন।
নাসরিন স্বামীর ওপর রাগ দেখিয়ে ছেলেমেয়েকে শুনিয়ে বলতে লাগলো, “তোদের বাবার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই। এই রাতে কেউ এতবড় কাতলমাছ কিনে আনে! আবার বেগুন এনেছে পোকায় খাওয়া।”
এমন সময় পিছন থেকে কাজের মেয়ে বুবলি বললো, “খালাম্মা, মাত্র দুইটা বেগুনে পোকা। আর সব...।”
কথাটা শোনামাত্র নাসরিন মেয়েটির দিকে এমনভাবে তাকালো যে মেয়েটি সেখানে আর থাকার কোনো সাহস পেলো না।
মোতালেবসাহেব এবার একটুখানি হেসে বললেন, “ছোটমাছ কিনলেও বিপত্তি। বড়মাছ কিনলেও আপত্তি। আর রাতের বেলা বেগুন কিনেছি। দুই-একটায় পোকা থাকতেই পারে। তাছাড়া, আমি সেসময় তাড়াহুড়া করে বাজারে গিয়েছিলাম বলে চশমাটা নিতে পারিনি। তাই, বেগুনের পোকাটা দেখতে পাইনি।”
মেয়েটি এবার বাবার পক্ষ নিয়ে বললো, “মা, তুমি সবসময় তুচ্ছবিষয় নিয়ে এতো কথা বলো কেন? এর আগে বাবা ছোটমাছ কিনতো বলে তুমি রাগ করতে। তোমার ভয়ে বাবা ছোটমাছ কেনাই বন্ধ করে দিয়েছে। এখন এতোবড় একটা কাতলমাছ এনেছে! তাতেও তুমি রাগ দেখাচ্ছো। আর মাছ তো তুমি কাটোনি। মাছ কেটেছে বুবলি।”
মেয়ের কথা শুনে নাসরিন আক্তার আর-কিছু বললো না। কলেজপড়ুয়া মেয়ে তার। সে এখন অনেককিছুই জানে এবং বোঝে। তাকে সহজে আঘাত করতে পারলো না। কিন্তু নাসরিন আক্তার একটা সুযোগ খুঁজতে লাগলো।
তনিমা খুব বুদ্ধিমতী-মেয়ে। সে মায়ের আচরণে সন্তুষ্ট নয়। ইদানীং সে মায়ের ভুলও ধরতে শিখেছে। শুধু সে নয়, তার স্কুলপড়ুয়া ছোটভাইটিও এবিষয়ে বোনকে অকপটে সমর্থন করে। এসব মিলিয়ে নাসরিন আক্তার এইমুহূর্তে মেয়েকে তেমনকিছু বলার সাহস পেলো না। এজন্য সে কিছুটা মনখারাপ করে খেতে লাগলো। আর মাঝে-মাঝে তনিমার দিকে তাকাতে লাগলো।
তনিমা মায়ের চাহনি দেখে হেসে ফেললো। আর সে খুব হাসতে লাগলো। তারপর সে একটু শান্ত হয়ে বললো, “মা, তুমি কি আমাকে মারবে? আমার দিকে বারবার এমনভাবে তাকাচ্ছো কেন?”
কথাটা শেষ করে সে আবার হাসতে লাগলো। সে খুব আমুদে মেয়ে। মা-বাবার সঙ্গে সে সবসময় একটা সহজ ও বন্ধুসুলভসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। মা-বাবা দুজনকেই সে খুব ভালোবাসে। তবে বাবার প্রতি যেন তার ভালোবাসাটা একটু বেশি।
তনিমার মুখে এসব কথা শোনামাত্র নাসরিন এবার ক্ষেপে উঠে বললো, “তুই না আজকাল খুব ফাজিল হয়েছিস। বড়দের ব্যাপারে বেশি কথা বলবি না। তোকে আমি এই শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি। আসলেই তুই খুব ফাজিল হয়েছিস!”
মায়ের মুখে এমন কড়া কথা শুনে তনিমা আবারও হাসতে লাগলো। আর সে বললো, “মামণি, তুমি একটু সহজ হও। এখনকার দিনে মায়ের সঙ্গে অত দূরত্ব বজায় রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া, বাবাতো কখনও আমাদের সঙ্গে এতো রাগ করেন না। তোমার এতো রাগ কেন, মা?”
একথা শুনে নাসরিন আরও ক্ষেপে যায়। সে যেন কিছুটা কাণ্ডজ্ঞানহারা হয়ে বলে উঠলো, “তোদের কাছে আমি তো সবসময় খারাপ। আর তোদের বাবা যত সাধুপুরুষ। তোরা সব তো তার মুরীদ। আমার ভালো কথাও এখন তোদের আর ভালো লাগবে না।”
তনিমা যেন আজ সত্যি-সত্যি বিদ্রোহিনী হয়ে উঠলো। আর সে ফস করে বলে ফেললো, “মা, তুমি আমাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে জানো না। জানলে, তুমি আমাদের বাবাকে সবসময় এতো আন্ডারস্টিমেট করতে না। তুমি মানো আর না মানো—আমাদের বাবা আসলেই একজন সাধুপুরুষ। এলাকার লোকজনও বাবাকে তা-ই মনে করেন। তুমি দেখলে না, গতমাসে বাড়িওয়ালা-চাচা কী বলে গেলেন! বাবার মতো ভালোমানুষের জন্য এবছর আমাদের বাড়িভাড়া বাড়েনি।”
নাসরিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে সরোষে বললো, “ভাত খাচ্ছিস খা। তুই এতো ইঁচড়ে পাকা হয়েছিস কেন? তোর মতো ফাজিল-মেয়ে আমি আর দেখিনি!”
তনিমা বললো, “তোমার সঙ্গে মনখুলে কয়েকটিমাত্র কথা বলেছি। মামণি, এতে তুমি আমার মধ্যে ইঁচড়ে পাকার কী দেখলে? আর নিজের মেয়েকে কেউ এভাবে বকে?”
নাসরিন এবার নিজের প্লেটে ভাত তুলে নিয়ে বললো, “তুই শুধু ইঁচড়ে পাকা নয়—খুব ফাজিলও হয়েছিস।”
নবীন ওর মায়ের কথা শুনে হাসতে-হাসতে বললো, “মামণি, আপুনি তোমার সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করেছে। তাইতে তুমি এতো রাগ করছো কেন?”
এতে নাসরিন আরও রেগে বললো, “আমার সঙ্গে কেউ-কখনও ইয়ার্কি-ফাজলামি করবি না, খবরদার। আমি এসব একদম পছন্দ করি না।”
মোতালেবসাহেব এমনিতে কথা বলেন কম। কিন্তু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তার কথা বলার ধরন দেখলে মনে হবে না যে, তিনি কম কথা বলেন। ওদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত রাজ্যের কথা জুড়ে দেন। আর বন্ধুর মতো ওদের সঙ্গে মনখুলে কথা বলেন তিনি। তবে ওদের পড়ালেখায় যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে সবসময় তার সতর্কদৃষ্টি থাকে।
তিনি স্ত্রীর অহেতুক রাগ দেখে খুব শান্তভাবে বললেন, “দেখো, ছেলেমেয়েরা তোমাকে ভালোবাসে বলেই তোমার সঙ্গে একটুআধটু হাসি-ঠাট্টা করে। এতে তোমার রাগলে চলবে না। তোমাকে ওদের বন্ধু হতে হবে। আমি সারাদিন অফিসে পড়ে থাকি। তুমিই তো হবে ওদের প্রকৃত বন্ধু। তোমাকে ওরা কতটা কাছে পায়। তুমি যদি এভাবে ওদের ওপর রেগে যাও—তাহলে, ওরা কীভাবে বাসায় আনন্দে দিন কাটাবে! তোমাকে আরও সহনশীল হতে হবে, নাসরিন। আর তোমাকে ওদের মনের ভাষাটা বুঝতে হবে। আজকের দিনে এটা খুবই জরুরি।”
নাসরিন আক্তার তবুও রেগে বলে, “সারাদিন আমার তো আর কাজ নাই, ওদের নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে। আর সংসারটা বুঝি একলাএকলি চলবে! আর নয়তো তুমি এসে বুঝি আমাকে সাহায্য করবে।”
স্ত্রীর এরকম মুখঝামটা মোতালেবসাহেবের এখন ভালো লাগলো না। তিনি মনখারাপ করে ভাত খাওয়া রেখে স্ত্রীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তবে স্ত্রীকে কোনো শক্ত কথা বলতেও তার মন সায় দিলো না। তিনি ভদ্রলোকের মতো কিল খেয়ে কিল চুরি করলেন।
মোতালেবসাহেব বুঝলেন, এখন এর সঙ্গে আলাপটা আর জমবে না। তিনি শান্তভাবে আগের মতো খাবার খেতে লাগলেন। তিনি আজও তার স্ত্রীর মতিগতি বুঝতে পারলেন না।
ছেলেমেয়েদের সত্য বোঝার মনমানসিকতা দেখে মোতালেবসাহেব যারপরনাই আনন্দিত হলেন। ওরা যে আজ ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে—এজন্য তিনি মনে মনে বিরাট গর্ব অনুভব করলেন। এই জীবনে এটি তার পরম পাওয়া বলে মনে হলো।
পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে মোতালেবসাহেব একটা ঘটনা দেখে বেশ অবাক হলেন। আর খুব ভাবনায় পড়ে গেলেন। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা নয়!
তার অফিস-কলিগ মোবাশ্বেরসাহেব টেবিলে কাজের ফাঁকে-ফাঁকে কেমন যেন ঝিমাচ্ছে। তাকে দেখে তার মনে হলো—ভদ্রলোক হয়তো গতরাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেননি। কিন্তু এমন হবে কেন? তিনি তো কিছুটা প্রেসারের রোগী! ঘুম ঠিকমতো না হলে তো তিনি বিরাট বিপদে পড়বেন!
লোকটার জন্য তার খুব মায়া হলো। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করতে-করতে ভদ্রলোক এখন তার বন্ধুর মতো হয়ে গেছেন। তারা দুজন দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যাংকের এই শাখাতে কাজ করছেন। তাদের সহযোগী অনেকেরই বদলি হয়েছে। কিন্তু তারা দুজন এখনও এখানে বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন।
টাকাপয়সা গোনার কাজে এখন মোবাশ্বেরসাহেব খুব ব্যস্ত। তার সঙ্গে দূর থেকেই একটু কথা বলার চেষ্টা করলেন মোতালেবসাহেব। কিন্তু মোবাশ্বেরসাহেব একবারও তার দিকে তাকালেন না।
আজ বৃহস্পতিবার হওয়ায় এখানে কাজের চাপ যেন একটু বেশি। তাছাড়া, এলাকাটা ব্যবসাকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রায় বৃহস্পতিবারে এখানে ভিড় জমে।
পাশাপাশি বসলে তবুও এখনই তার সঙ্গে একবার কথা বলা যেতো—ভাবলেন মোতালেবসাহেব। কিন্তু মোবাশ্বেরসাহেব এখন তার থেকে কমপক্ষে দশ ফুট দূরে অবস্থান করছেন। শেষমেশ তিনি ভাবলেন, তার হাতের কাজ একটু কমলে আর কখনও খানিকটা সুযোগ পেলে ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে আসল ব্যাপারটা জানবেন।
এসব ভেবে মোতালেবসাহেব মনোযোগ দিয়ে হাতের কাজ করতে লাগলেন। দেখতে-দেখতে তিনি কাজের চাপে একেবারে যেন হাঁপিয়ে উঠলেন। ঘণ্টাখানেক পরেও তিনি মোবাশ্বেরসাহেবের সঙ্গে কোনো কথা বলার একটু সুযোগ পেলেন না।
তিনি মনখারাপ করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলেন।
একগাদা হাতের কাজ শেষ করে মোতালেবসাহেব যখন উঠলেন তখন তাদের ‘লাঞ্চ-আওয়ার’ শুরু হয়ে গেছে। তিনি আর কালবিলম্ব না করে নিজের আসন ছেড়ে উঠে দ্রুত মোবাশ্বেরসাহেবের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর তাকে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে খপ করে তার ডানহাতটা ধরে বললেন, “ভাই, বাইরে চলেন। আজ দুজনে হোটেলে খাবো। আমি বাসা থেকে আজ দুপুরের খাবার আনিনি।”
এতে মোবাশ্বেরসাহেবও উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন, “আরে, আমিও তো আজ খাবার আনিনি। ঠিক আছে, চলুন। আজ দুই ভাই বাইরে খাবো।”
মুহূর্তের মধ্যে তারা ব্যাংকের বাইরে চলে এলেন।
ব্যাংকের পাশে একটা বড়সড় হোটেলে এসে তারা দুজন বসলেন।
মোতালেবসাহেব তার মনের মধ্যে দীর্ঘসময় চেপে রাখা প্রশ্নটি এবার মোবাশ্বেরসাহেবের দিকে ছুঁড়ে দিলেন, “আপনাকে কাজের ফাঁকে-ফাঁকে আজ একটু ঝিমাতে দেখলাম, মনে হলো! ব্যাপার কী?”
প্রশ্নটি শুনে মোবাশ্বেরসাহেব মনভার করে বলতে লাগলেন, “আর বলবেন না, ভাই। বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। আজ কয়েকদিন যাবৎ তাদের আনাগোনায় নিজের অবস্থা এখন ত্রাহি-ত্রাহি। এদের জন্য গতরাতে ভালোভাবে ঘুমাতেও পারিনি। মেহমান একদল যাচ্ছে আর আরেকদল আসছে! এভাবে নিয়মিত এদের যাওয়া-আসা চলছে। এরা শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তাই, এদের মুখফুটে কিছু বলতেও পারছি না। সত্যি কথা কি, এদের জ্বালায় গতরাতে আমি ঘুমানোর জায়গাটাও পাইনি। তবুও আমার স্ত্রীর এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আর এদের সমাদর করতে-করতে আমার স্ত্রী আমার জন্য আজ দুপুরের খাবার দিতেও ভুলে গেছে! এই হলো আমার বর্তমান-অবস্থা।”
মোতালেবসাহেব সব শুনে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “জগতে রমণীদের মন বোঝা সত্যি কঠিন। আমরা কিছুতেই যেন তাদের মন বুঝতে পারি না।”
সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
২০/০১/২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১২:৪৭