মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বাধিক মহামারীতে মৃত্যু ও অর্থনীতিতে চরম বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিটি একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও তার জনপ্রিয়তায়ও খুব একটা হের্ ফের হয় নাই। এতো কিছুর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের এক বিশাল অংশের প্রচন্ড আনুগত্য সবাইকে বিস্মিত করে | এই বিশাল উগ্র সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক সহ চরম বর্ণবাদী, ধর্মীয় উগ্রবাদী এবং কিউএনন নামক ষড়যন্ত্র তত্বে বিশ্বাসী একটি বিশেষ গোষ্ঠী ।
সম্প্রতি ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল হিল আক্রমণের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এতে অনেক কিউএনন ষড়যন্ত্র তত্বে বিশ্বাসীদের অংশগ্রহণ। এই ষড়যন্ত্র তত্বে বিশ্বাসীরা মনে করে শয়তানের উপাসক ও শিশু যৌন নিপীড়ক একটি বিশ্বব্যাপী গোপন সংগঠনের বিরুদ্ধে তাদের হিরো ডোনাল্ড ট্রাম্প লড়াই করে যাচ্ছেন । ট্রাম্পের যে কোনো কেলেঙ্কারি বা দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তার উগ্র সমর্থকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার বেশ কার্যকরী উপায় হিসাবেই কিউএনএনের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ব কাজ করছে |
এই কিউএনন ষড়যন্ত্র তত্বের সূত্রপাত হয় ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় হিলারি ক্লিনটনকে জড়িয়ে নানান ষড়যন্ত্র তত্ব ও রাজনৈতিক গুজব অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে যা 'পিজাগেইট' নাম পরিচিতি লাভ করে। 'পিজাগেইট' নামক ষড়যন্ত্র তত্ব অনুসারে হিলারি ক্লিনটন সহ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে একটি চক্র সারা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এদের সাথে শিশু যৌন নিপীড়কদের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এই সকল গুজব ও ষড়যন্ত্র অনেক কট্টর ডানপন্থীই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মাসে এডগার এম ওয়েলচ নামক এক ব্যক্তির ওয়াশিংটন, ডিসির এক পিৎজা পার্লারে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করে এবং দাবি করে ওই রেস্তোরার বেইজমেণ্টে একটি সংঘবদ্ধ শিশু নিপীড়ক যৌন চক্র তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাস্তবে যদিও ওই রেস্তোরার বেজমেন্টে এই ধরণের কোনো গোপন আখড়ার সন্ধানই পাওয়া যায় নাই ।
কিউএনন ষড়যন্ত্র তত্বের মুলে রয়েছেন এক রহস্যময় ব্যক্তি যিনি 'কিউ' নামেই পরিচিত। "কিউ" ছদ্মনামে ওই ব্যক্তি ৪চ্যানের মতো বিভিন্ন কুখ্যাত ইন্টারনেট বোর্ডে নানান ষড়যন্ত্র তত্বের পোস্ট দেয়ার মাধ্যমে অনেকের মনে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়। কিউএনন তত্বের অনুসারীরা মনে করে 'কিউ' সরকারের মধ্যে প্রভাবশালী একজন যার রাষ্ট্রের নিরাপত্তার 'ইন্টেলিজেন্স' সম্পর্কিত স্পর্শকাতর তথ্যে উচ্চস্তরের প্রবেশাধিকার রয়েছে। সে সময়ে সময়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ব অনলাইনে ছড়িয়ে দেয় যা তার অনুসারীরা 'ব্রেডক্রাম্বস' বলে থাকে।
এই তত্বের সূত্রপাত হওয়ার পর থেকে কিউ বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ব নিয়ে এপর্যন্ত প্রায় ১৮০০ বার্তা পোস্ট করেছে যাতে জড়ানো হয়েছে ট্রাম্পবিরোধী অনেক চলচ্চিত্র তারকা, ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিবিদ এবং এমনকি সিমেক্স নামের বহু মিলিয়ন ডলার মেক্সিকান সিমেন্টের মতো সংস্থাগুলিকে। এর অনুসারীদের সর্বশেষ এজেন্ডা হচ্ছে কোরোনাভাইরাসের হুমকির বৈধতা নিয়ে আন্দোলন এবং এই মহামারীর কারণ হিসাবে নানান ষড়যন্ত্র তত্বের প্রচারণা। এই এজেন্ডার অংশ হিসাবে এরা 'প্ল্যান্ডেমিক' নামক একটি মুভি তৈরী করে যাতে গুপ্তচরবৃত্তির কিংবা বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জন্য মনুষ্যসৃষ্ট জীবাণুঅস্ত্র এবং 'ফাইভ জি' সেলুলার নেটওয়ার্ককে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তির কারণ হিসাবে দেখানো হয়।
মহামারীর বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই গোষ্ঠী তাদের মাস্ক বিরোধিতার সঙ্গে মুসলিমদেরকেও জড়িয়েও আক্রমন করতে ছাড়ে নাই। কিউএননের এক মেমে দেখানো হয়েছে মার্কিন মহিলার চার বছরের এক কাল্পনিক রূপান্তর যার শুরু মেডিকেল মাস্ক পরার মাধ্যমে, এর পর কাপড়ের মুখোশ এবং সর্বশেষে 'বুরখা' পরার মধ্য দিয়ে। এদের অনুসারীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে মুসলিমরা ডেমোক্রেটদের মাধ্যমে এই মাস্ক থেকে বুরখা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে একদিন শরিয়া আইন চালু করে ছাড়বে ।
মার্কিন ইতিহাসের চরম বিতর্কিত রাষ্ট্রপ্রধানের সিংহাসন ত্যাগ এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু, এই কিউএনন ষড়যন্ত্র তত্ব কাল্পনিক হওয়া সত্বেও এই তত্বের অনুসারির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাস্ট্র ছড়িয়ে তা অন্যান্য দেশেও পরিচিতি পাচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে তুরস্ক ও ব্রাজিলের মতো রাষ্ট্রও। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে তাদের সরব উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে যা রীতিমতো আশংকাজনক। ট্রাম্পের প্রস্থান কি রুখতে পারবে কিউএননের অনুসারীদের মতো মধ্যযুগীয় মানসিকতার বর্ণবাদীদের ফিনিক্স পাখির মতো পরবর্তী উত্থান থেকে ?
ছবি: অন্তর্জাল
তথ্য সূত্র:
১ ) ট্রাম্প সমর্থকদের উপর কিউএনন সহ বিভিন্ন তত্বের প্রভাব
২) পিজা গেইট বন্ধুকধারীর চার বছরের কারাদণ্ড
৩) মাস্ক থেকে শরিয়া আইন - কিউএনোনরা মুসলিম বিরোধী মতবাদ ছড়াচ্ছে