গত একমাস দশ দিন ধরে দেশব্যাপী টানা অবরোধ চলছে; এর মধ্যেই চলছে হরতাল। গত দুই সপ্তাহে প্রাপ্ত কর্ম দিবসের পুড়োটাই অর্থাৎ টানা পাঁচ দিন করে দশ দিন হরতাল ছিল; আজ রবিবারও হরতাল দিয়েই নতুন সপ্তাহ শুরু হল আবার। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?
আমরা যারা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি, তাদের বেতন ভাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পণ্য ও সেবা বিক্রি থেকে অর্জিত আয় থেকে প্রদান করে থাকে। গতমাসে অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানেরই বিক্রয় বা আয় প্রায় পঞ্চাশ ভাগ কমে গেছে। অনেকের কমেছে আরও বেশী। ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো আছে আরও বড় বিপদে। কর্মীদের বেতন-ভাতা আর অফিস/দোকান ভাড়া বা স্থায়ী ব্যয় প্রদান করতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে; কেউ কেউ এই ব্যয় বহন করার সক্ষমতাও হারাবে অচিরেই।
বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা বা দুইটা সড়ক দুর্ঘটনা বা পণ্য ভেলিভারীতে ড্যামেজ মেনে নেওয়ার সক্ষমতা আছে; তাই তারা অনেক ঝুঁকি নিয়েই তাদের উৎপাদিত পণ্য দেশের কিছু কিছু এলাকায় বিপণন করছে। কিন্তু ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো তা পারছে না, তাই তাদের বিক্রয় থেকে আয় কমে গেছে অনেক। এভাবে চলতে থাকলে তারা দেউলিয়া হয়ে যেতে বাধ্য। পাশাপাশি আছে ব্যাংক ঋণের ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার চাপ। ফলে সব প্রতিষ্ঠানই একটা সময় হয়ে যাবে ব্যাংক ডিফল্টার।
আমরা যারা বিদেশে পণ্য রফতানির কাজে নিয়োজিত আছি; তারা আছি আরও বড় বিপদে। একদিকে যেমন আমরা আমাদের ক্রেতাদের বোঝাতে পারছিনা যে, আমরা আসলে কি অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সময়মত পণ্য ডেলিভারি বা জাহাজীকরণ করতে না পেরে হয়ে যাচ্ছি এলসি ডিফল্টার। গৃহীত এলসিগুলোর ‘লাস্ট শীপমেন্ট ডেট’ পার হয়ে যাচ্ছে বারবার। শেষ হয়ে যাচ্ছে ‘এলসি একস্পায়ারি ডেটও’। যা আমাদের উৎপাদিত পণ্যের পুড়োকেই ‘স্টক লট’ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বুঝিয়ে শুনিয়ে ক্রেতাদের নিকট থেকে বারবার এলসি এমেন্ডমেন্ট নিয়েও আমরা তাল রাখতে পারছিনা।
আবার ঝুঁকি নিয়ে পণ্য বোঝাই ট্রাকগুলো সী-পোর্টসহ বেনাপোল ও অন্যান্য পোর্ট গুলোতে পাঠাতে যেয়ে আগুনে পণ্য, ট্রাক, ড্রাইভার ও তাদের সহযোগীদের পুড়ে যাওয়ার ভয়ে ভিত থাকছি। ওদিকে ক্রেতারা হুমকি দিচ্ছে অর্ডার বাতিল করার। এদিকে আছে আবার আমাদের সেলস টার্গেট এচিভ করার বাধ্য বাধকটা। আছে চাকুরী হারানোর ভয়। এর বাইরে- বিদেশী ক্রেতারা একবার অন্যদেশে চলে গেলে তাকে আবারও ফিরিয়ে আনা যে কত কঠিন কাজ? আমরা যারা এই সেক্টরে কাজ করি তারা বুঝি।
কিন্তু এটা তো গেলে মাইক্রো লেভেলে, ম্যাক্রো লেভেলে দেশের অর্থনীতি আরও বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সরকারের আয় ক্রমাগত কমতে থাকবে, জিএনপি-জিডিপি কমবে, বাড়তে থাকবে ব্যাংক ও বৈদেশিক ঋণ। একটা পর্যায়ে সমস্যা হবে ব্যাল্যান্স অব পেমেন্টে। যদিও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে সরকার কোনরকমে তা থেকে পার পেয়ে যাবে কিন্তু দেশীয় ব্যাংকগুলো হয়ে যাবে দেওলিয়া বা মন্দ ঋণে জর্জরিত হয়ে যাবে তারা।
অচিরেই এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আমাদের; না হলে দেশ ও মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবারো নিপতিত হবে- যা থেকে আমরা বেড়িয়ে আসতে পেরেছিলাম অনেক চেষ্টায়।
১৫/০২/২০১৫