রাত বাজে তিনটা অথচ আকাশের আলো দেখে মনে হয় যেন ভোর হয়ে যাচ্ছে। অথচ আজ অমাবশ্যার রাত। সবচেয়ে আঁধার রাত। রাতজাগা পাখির গানের শব্দ, পতঙ্গের উড়াউড়ি, ঘুরে ঘুরে তারা উড়ে আর বারি খায় কাঁচের উপর । যত ছোট পতঙ্গ হোক শব্দ বেশ জোড়ে হয়। ওদের ছোট শরীরও বেশ শক্ত পোক্ত বোঝা যায়।
অজস্র তারার নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি । এমন ঘোর অমাবশ্যার রাতেও ফিকে আলো ঘিরে আছে আমাকে। খানিক অন্ধকারে থাকার পর চারপাশে সব কিছু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি যেন ফিকে আলোয়।
আমাকে ঘিরে উড়ছে অজস্র জোনাকি। জোনাকিরা অদ্ভুত সবুজ আলো জ্বালছে। ডাকছে সঙ্গীনিকে। এবার বেশ খড়া বৃষ্টি তেমন হচ্ছে না। চারদিন আগে বৃষ্টি হওয়ার পরই জোনাকিরা জেগে উঠেছে মাটি থেকে।
খুব ছোটবেলা জোনাকি দেখতাম। তাদের জামার ভাঁজে রাখতাম। ধরে এনে বোতলে রাখতাম। আলোর বোতলটা হাতে নিয়ে ঘুরতাম। আমার নানা বাড়িতে এত জোনাকি দেখেছি যেন আলোর দেয়াল, আলোর ঘর অন্ধকারের মাঝে। সেই সুন্দর দৃশ্যটা চোখের সামনে প্রায় মনে হয়। তেমন ভাবে জোনাকি অনেক বছর দেখিনি। ভুল করেও যেন ওরা চলে আসে না আর বুদ্ধদেব বসুর কবিতার সুরে বলতে পারি না -
এ কী
জোনাকি!
তুই কখন
এলি বল তো!
একলা
এই বাদলায়
কেন কলকাতায় এলি তুই?
জোনাকি শুধু স্মৃতির পাতায়। মগজের কোষে। কিন্তু গত কিছু বছর ধরে আবার জোনাকি দেখছি, এই সময়ে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ধরা দেয় আমার কাছে। এক দুদিন রাতের ঘুম বাদ দিয়ে, আমি জোনাকির আলোর খেলা দেখি রাতের গভীরে মিতালী করে।
গত বছর একদিন মাঠ জুড়ে তাদের আনন্দের উড়াউড়ি দেখছিলাম। বিশাল লম্বা একটা আলোর দেয়াল ছোটবেলার স্মৃতির মতন আমার সামনে চলে এসেছিল। ঘুম বাদ দিয়ে আমি তাদের সাথে কাটিয়ে উপভোগ করেছিলাম। এখনও জোনাকি, ধরে ছেড়ে দেই চুলের ভিতর আলোর মালা জ্বালিয়ে তারা হাঁটে।
ভাবছিলাম ঘুমাতে যাবো নাকি সূর্য গ্রহণ দেখার জন্য ভোর পর্যন্ত জেগে থাকব। সূর্যটা জাগার সাথে সাথেই তার গায়ে গ্রহণ লেগে যাবে। বছরের প্রথম সূর্য গ্রহণ হবে আজ।
বছর পাঁচেক আগে একদিন দেখেছিলাম বিকালবেলা সূর্য গ্রহণ। এবার হবে ভোরে।
খুব ছোটবেলায় একবার মনে আছে দুপুরবেলা সব ছায়া অন্ধকার হয়ে রাত নেমেছিল যেন। তখন এমন সানগ্লাস ব্যবহারের চল ছিল না। বাবা এক্সেরে প্লেট হাতে দিয়ে বলেছিলেন, সূর্যটাকে দেখতে। চারপাশে আলোর রিং মধ্যিখানে অন্ধকারের একটা বল। দুপুর সময়টা হয়ে হয়েছিল সন্ধ্যার মতন। বাড়ির সব মানুষ উঠানে আমরা সূর্যগ্রহণ দেখছি। এই স্মৃতিটাও জ্বলজ্বল করে মনে। একটু একটু করে মধ্যিখানের কালো ছায়াটা সরে গিয়েছিল আবার দিন ফিরে এসেছিল, উজ্জল ঝলমলে রোদের দিন। বাবা আগ্রহ ভরে প্রকৃতির এই বৈচিত্রগুলো দেখাতেন বলেই মনে হয় এখনও সেই বৈচিত্র দেখার আগ্রহে তাকিয়ে থাকি। একটা জ্ঞানের চোখ খোলা থাকে প্রকৃতির দিকে কি হয়, কেমন পরিবর্তন দেখার জন্য।
আমার ছেলেটার বয়স তখন হয় তো তিন সাড়ে তিন। এক সন্ধ্যায় সে ঘুম থেকে উঠল। আমিও খুব ক্লান্ত থাকতাম, বাচ্চা সামলে গৃহস্থালী কাজ করে সে সময়। ওর পাশে শুয়ে ছিলাম। ও চােখ মেলে বিছানার সাথে জানালা দিয়ে বাইরে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল চুপচাপ, তারপর হঠাৎ করেই বলে উঠল, "মা দেখেছো কি চমৎকার আকাশ"। আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর শব্দ শুনে। চমৎকার আকাশ। এত সুন্দর শব্দটা ও কখন শিখল। আসলে আকাশে একটা অদ্ভুত নীলভ উজ্জ্বল আলো ছিল ঠিক সন্ধ্যার মূহুর্তে সেদিন। স্মৃতিটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে। বাচ্চারাও কি রকম উপলব্ধি করতে পারে তা জেনেছিলাম। প্রকৃতগত ভাবে উপলব্ধির একটা বিষয় থাকে বাচ্চাদের মধ্যে। সে জিনিসটা শিখেছিলাম সেদিন।
সে ছেলে যখন স্কুলে যায় তখন একবার সূর্যগ্রহণ হবে। ওর জীবনের প্রথম সূর্যগ্রহণ। ছেলের স্কুল খোলা তাই স্কুলে চলে গেল ও কে বলে দিলাম ক্লাসের বাইরে গিয়ে যেন নতুন এই বৈচিত্রকে উপভোগ করে, সূর্য গ্রহণটা বাস্তবে দেখে। প্রস্তুতি হিসাবে সানগ্লাস এবং একটি এক্সরে প্লেটও ওর ব্যাগে দিয়ে দিলাম। সরাসরি যেন সূর্যের দিকে না থাকায় তা বলে দিলাম।
স্কুল থেকে আসার পর বলল, ক্লাস থেকে ওদের বের হতেই দেয়নি। এই হলো আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। আর বিদেশে বাচ্চাদের আগে থেকে ভিডিও দেখিয়ে শিখিয়ে মাঠে নিয়ে হাতে কলমে বৈচিত্র শিক্ষা দেয়, যা আমি দেশে থেকেও সে শিক্ষা আমার বাবার কাছে পেয়েছিলাম।
বড় বড় মশাগুলোর জন্য বেশি সময় বাইরে থাকতে পারলাম না। একটা লেখা শুরু করলাম জেগে থাকার জন্য। কিন্তু খুব ঘুম পাচ্ছিল চারটার দিকে শুয়ে পরলাম। একটু খানী গভীর ঘুমও দিয়ে দিলাম কিন্তু ঠিক সাড়ে পাঁচটায় আমার দেহ ঘড়ি আমাকে জাড়িয়ে দিল। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, আলো করে জেগে উঠা সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে গ্রহণের কালো ছায়ায়। মেঘলা একটা সকাল নেমে এলো পৃথিবীর বুকে। সূর্য উঠতে উঠতে যেন হারিয়ে গেল আবার। তারপর ফিরে এলো আবার একটু একটু করে চাঁদের ছায়া সরে যাওয়ার পরে। এটা খুব আশ্চর্যের যখন পুরো চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে না। অমাবশ্যা রাত, তখনও চাঁদ ছায়া দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যকে। আজ নতুন চাঁদ জাগবে। নতুন করে শুরু হবে তার যাত্রা। সূর্যটা গ্রহণ থেকে বেরিয়ে এখন অনেক আলোয় পৃথিবী আলোকিত করে রেখেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০২১ সকাল ১১:১৫