রোজিনা বেগম অস্থির হয়ে ওঠেন , হাঁটেন, পানি খান মুখে পানির ছিটা দেন দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে খোলা হাওয়ায় দম নেন। তারপর বিছানায় ফিরে শুয়ে ঘুুমের চেষ্টা করতেই আবারও ছেঁকে ধরে সেই অসংখ্য মানুষের মুখ, তাদের জীবন যাপন তাদের বিদেশের চলাচল, দেশের গমগম অবস্থা। বুকের ভিতর ছটফটানি ধরফরানি তৈরি করে। নিজেদের কিছুতেই স্থির রাখতে পারেন না। কেন ঐ মেয়েটা ওমন রঙিন ছবিটি দিল? কেন ঐ বয়স্ক মহিলাটিকে এখনও বাচ্চা কিশোরি লাগে। কেনো তার ছবিতে এত লাইক পড়ে। শুনেছি সে শাশুড়ি হয়ে গেছে অথচ তরুণির মতন চালচলন। কি ভাবে ফিগারটা এখনও এমন ধরে রাখল ।
ওহ! ছটফট করে উঠে পাশের মানুষটিকে দেখেন। লোকটা কি, বিরক্তির চোখে তাকিয়ে ভাবেন; বিছানায় শুয়েই ঘরঘর রেল গাড়ি চালাতে শুরু করেছে। না একটু ভাব ভালোলাগার কথা বলার সময় আছে, না আছে আদর সোহাগ। জীবন শুধুই নিরানন্দ কর্মময়। সবাই ব্যস্ত সারাক্ষণ। ছেলে মেয়ে কারো সময় নাই দুচারটা কথা বলার। অনেক সময় দেখা হয় না, কখন যায় কখন আসে। খাবার বেড়ে বসে থাকার দিনও চলে গেছে। শুধু অপেক্ষা ।
ভাগ্য এই হাতের মোবাইলটা সব সময় সচল আছে। রাতে বালিশে মাথা রেখেও চোখ পড়ে থাকে এই মোবাইলের ভিতর দিয়ে নানা রঙের মানুষের জীবনের দিকে। সেখানে নিজের জীবনটাকে বড় পানসে মনে হয়। বিশাল দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে আসে বুক চিরে নিজের অজান্তে রোজিনা বেগমের।
পাশের মানুষের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বালিশের পাশ থেকে তুলে নেন মোবাইলটা হাতে। বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে সোফায় গিয়ে বসেন। প্রথমে দেখেন পরখ করেন কারা কারা চেটে অন আছে এই রাতেও।
প্রায় একশর কাছাকাছি বন্ধু লিষ্ট দেখে স্বস্থি পান। কেউ ঘুমায়নি। সবাই জেগে আছে। সবাই ফেসবুকিং করছে। তাহলে উনি কেন বৃথা ঘুমানোর চেষ্টা করছেন।
দেখি তো এই মহিলাটির সাথে কথা বলা যায় কিনা? মহিলার মনোহরন সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে তাকে রিকোয়েষ্ট পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু মহিলাটি কি করে কোথায় থাকে। স্বামী বাচ্চা বিয়ের কোন খবর দেয়া নাই এ্যাবউটে।
মাঝে মাঝে দারুণ প্রেমের কিছু কথা লেখে আর অসম্ভব সুন্দর ছবি আপলোড করে। মুগ্ধ হয়ে উনার টাইমলাইনে কত ঘন্টা কত সময় কেটে গেছে তাও উনার সম্পর্কে কিছু জানা হলে না। কোথায় থাকেন কি করেন। দু চার দিন হাই বলে কোন উত্তর পাননি। আচ্ছা দেখি তো আজ এই সময়ে আর একবার কথা বলে। যদি কথা না বলে তবে তাকে আনফ্রেণ্ড করে দিব। এমন ভাবনা ভেবেই চ্যাট বক্স ওপেন করে হাই লিখতে গিয়ে মত বলে লিখেন। আপনি এতো সুন্দর আপনাকে শুধু দেখি। আপনার সাথে খুব কথা বলার ইচ্ছে হয়। আপনার সম্পর্কে জানতে খুব ইচ্ছে করে। যদি কিছু বলতেন ভালোলাগত।
টক টক করে কয়েক লাইনে লেখাগুলো পাঠানোর পরে অবাক করাা কাণ্ড! মহিলাটি উত্তর দিলেন এতদিন বাদে। আই এ্যম ইন ওর্য়াক, ক্যান উই টক লেইটার।
বেটি শয়তান। ফেসবুক ওন রেখে কাজ করছো। এতরাতে কি কাজ? দেমাগী বেটি অসুন্দর কইরা আমাকে না করলা না। ওহ বুঝছি রাইতের কাম করো তুমি। নিজের মনে বিরবির করে কথা বলে রাগ ঝাড়ার চেষ্টা করে আবার চোখ বুলান ওন চ্যাটের নামগুলোতে। এস রহমান ওন আছেন দেখি উনার সাথে কথা বলি খানিক।
- ভাবী, আসসালামালেকুস
- ওলেকুম। সাথে সাথেই উত্তর আসে।
-ঘুমাননি এখনও
-না এই যাব যাবো করছি। কিছু নতুন ছবি দেখছি
- কার ভাবী?
- আমাদের আহমদ সাহেবের মেয়ের।
- কোনটা যার বিয়ে হলে, না কি যেটা বিদেশ থাকে?
আরে ভাবী আর বইলেন না। যেটা বিদেশ থাকে হেয় তো বিদেশে গিয়া পুড়াই বিদেশী হইয়া গেছে। চুলে সোনলি রঙ, চোখে নীল কন্টাক লেন্স। আর কাপড় যা পরে না উদাম গা আর হ্যাফ প্যান্ট।
নিজে যে প্রতি মাসে একবার পার্লারে যেয়ে চুল কাট ছাট রঙ করেন সে সব কথা একদমই মনে পরল না। উনার চুলের কয়েকটা রঙিন হাইলাইট স্টিক যেন নড়ে উঠে দেখাতে চাইল এ বয়সে তুমিও তো রঙ মাখো তবে অন্যদের নিয়ে বলছো কেন?
দাঁড়ান প্রফাইলটা সামনে আনি। কি যেন নাম মহা আগ্রহে জানতে চান রোজিনা বেগম।
- ওর নাম ইতু।
- না ফেসবুকের নাম বলেন ভাবী?
- উড়িনা ইতেলা আহমেদ।
-হম পাইছি; ওরেহ বাবাহ ভাবী, খুক খুক হাসিতে অস্থির হয়ে উঠেন রোজিনা বেগম।
দাঁড়ান ভাবী আপনারে ফোন দিতাছি। লিইখা কথা বলে মজা পাইতাছি না।
-দেন।
-হ্যালো
- জী ভাবী, দেখছেন কাণ্ড মা বাপ লইয়া সী,বীচে বইসা আছে বিকিনি পইরা।
- আহমদ সাব, হ্যাফপ্যান্ট পরছেন। খালী গা মাথায় হ্যাট সান বাথ পুরাই টাসকিত বিদেশি স্টাইল।
- মিসেসে কি পরছেন? বুঝতে পারছেন? নাহ কি যেন ঢোলা পাতলা জামার মতন মনে হচ্ছে। বাঙালিরা সব বিদেশি হয়ে গেছে হা .হা. হা......বাপ মার এই অবস্থা হইলে মাইয়া তো এক ডিগ্রি উপরে থাকবই।
হাসি আনন্দের মহান খোরাক এমন ভাবনার ঢেউ তুলে অন্যের সমালচনা করার সময় উনাদের একবারও মনে হলো না। বিয়ের পর উনার বাঙালি হয়েও পাকিস্থানি সেলোয়ার কামিজ পরেন। ভারতিয় লেহেঙ্গা বা বিদেশি র্স্কাট টপসও পরেন। ঘরে সারাক্ষণ ম্যাক্সি নামের লম্বা ড্রেস পরে থাকেন। ঘুমানোর সময় নাইটি।
- ঠিক বলছেন, উনারা কবে গেলো বিদেশ?
- এই তো দুই মাস আগে।
- একবারে গেছেন না কি বেড়াতে?
- মনে হয় বেড়াতে গেছেন। ভাবী শুনেন, কাউরে বলবেন না। একটা কথা শুনেছি, মাইয়াটা মনে হয় বিদেশি ছেলের সাথে লটঘট বাজাইছে। এই জন্য বাপ মা তাড়া হুড়া করে গেছে।
- ও মা তাই না কি? কী কন ভাবী! কই থাইকা শুনলেন।
- আরে ভাবী, এসব কথা কী আর চাপা থাকে এখন? দেশ আর বিদেশ এখন এক হয়ে গেছে না। আর এই ফেস বুকে চোখ রাখলে কত কিছু জানা যায়। তাছাড়া আমার ননদের দেবর থাকে ওদের বাড়ির কাছেই। মাইয়াটা ঐ দেবরের সাথে বেশ কিছু দিন মাখামাখি কইরা ছাড়ান দিছে। ওরা বলে পড়ালেখা করতে গেছে। কিসের পড়ালেখা? খালি ঢলাঢলি প্রেম।
ছেলেটার মাথা খাইছে ঐই ইট্টুহানি মাইয়া ইতু। যখন ছাড়ান দিয়া গেছে তখন তো ঐ ছেলে ঘুমের অসুধ খাইছে। যমে মানুষে টানাটানি করে সুস্থ হওয়ার পরে ভাই তার ছোট ভাইরে দেশে আইনা বিয়া করাইয়া লইয়া গেছে।
বউটারে আমি ইতুর ছবি দেখাইয়া সাবধান কইরা দিছি স্বামীরে যেন এই মাইয়ার থাইকা দূরে রাখে।
- আপনি তো সাংঘাতিক কাম করছেন ভাবী।
- করন লাগে ভাবী। মানুষের ভালার লাইগা করন লাগে। আল্লাহ আছে না সব দেখছে। আমি যদি না কই জাইনা শুইনা পাপ হইব না। বউটা আমার দূর সম্পর্কের আত্মিয় লাগে।
- তাইলে তো আপনার বিশাল দ্বায়িত এটা ভাবী।
- কিন্তু এই ছিলান মাইয়া গুলো মানুষের সংসার হাড় ঝালাপালা করে দিল। আমি তো আমার সাহেবরে চোখে চোখে রাখি। কার সাথে ফ্রেন্ড হইল আর কার সাথে চ্যাট করল একবেলা চেক করি।
- কেমনে করেন ভাবী।
- তার পাসওর্য়াড জেনে নিছি।
- ভাই কইছেনি আফনারে?
আরে দূর কইলে কি দেয়? আর আমি বা তারে আমার ডিটেকটিব হওয়ার খবর আগে দিমু কেন। যদি কোন দিন পাই কিছু; সামাল বালাম সমেত হাজির করে হুজুরে ধরমু।
- ঠিক, তো কেমনে পাইলেন ভাইয়ের পাসওয়ার্ড?
- হে মনে রাখতে পারে না তো, তাই সব লিখে রাখে একটা ডায়রিতে। ওখান থেকে পাইছি।
- ও মাই গড, দেখন ভাবী কি ছবি আইছে।
- কি ভাবী?
জলিল ভাইর ছোট পোলা, আদিল মর্তুজা, বিশাল দুধওয়ালি এক মাইয়ার লগে ঢলাঢলি করতাছে, আবার ক্যাপশান দিছে, তোমার ঐ বুকের তলে বিলীন হতে চাই।
যৌথ হাসিতে পরম আনন্দ উপভোগ করেন দুজনে। ছবিটা মোল্লা জলিল ভাইর চোখে পরলে কি অবস্থা হবে এই ভাবনায় থেমে থেমে হাসতে হাসতে কথা আটকে যায় দুজনের।
দুজনের একজনেরও মনে পরে না। তাদের ছেলে মেয়েরাও মর্ডান ড্রেস আপ করে। তাদের পাত্তা না দিয়ে নিজের মতন বয় ফ্রেন্ড র্গাল, ফ্রেন্ড করে। ক্লাব পার্টিতে তারা যা করে তা ভালো না লাগলেও নিয়মের বেরিতে আটকাতে পারেন না। অন্যদের সমালোচনা আর নিয়মের বাইরে চলে যাওয়ার বিষয় দেখে সমালোচনায় মুখর হয়ে অযুত আনন্দে উদ্ভাসিত হতে থাকেন দুজন।
- ভাবী, মাঝ রাতে হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গেলো। রাত তিনটা হয়ে গেছে। ঘুমাইতে যাই।
- হু আমি ও যাই গুড নাইট ভাবী।
এইবার ঘুম আসবে। সবাইকে নিয়ে কথা বলে হাসাহাসি করে। কাল সকালে কাদের এই খবর দেয়া যাবে মনের মধ্যে এমন লিষ্ট ঘুমের টনিকের কাজ করবে।
বিছানায় ঢুকে আদিল মর্তুজার ছবির ভঙ্গীতে নিজের বিশাল বক্ষের কাছে স্বামীকে টেনে এনে, জড়িয়ে ধরে ছবির মতন নিজেকে কল্পনা করে কিশোরির পুলকে ঘুমানোর চেষ্টা করেন রোজিনা বেগম।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৬ রাত ১১:৫৩