ঢাকা থেকে প্রায় চারশো কিলো দূরের এক গ্রামে কাজ পড়লো। গ্রামটা অন্যসব গ্রামের মতো বিচ্ছিন্ন না । আধুনিকতার ছোয়া সবে মাত্র লাগতে শুরু করেছে। যাতায়াতের জন্য পাকা রাস্তাও আছে। তাছাড়া খোলা হাওয়ায় কিছুদিন শান্তিতে থাকতে পারবো চিন্তা করে খুশি মনেই রাজি হয়ে গেলাম। যেদিন বের হবো সেদিন সকালে একটা লাগেজে কয়েকদিনের থাকার জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা হলাম। ফুরফুরে মেজাজে যখন অফিসের গাড়িতে চড়ে বসলাম তখনো জানতাম না আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
যেতে অনেকক্ষণ লাগবে। ড্রাইভার আলির সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করলাম।
-আলি মিয়া তোমার তো এইদিকে যাওয়া আসা আছে,ঠিক না?
-জি স্যার আমি মাঝেমাঝেই এই জায়গা দিয়ে যায়। খুব খারাপ জায়গা।
গল্পের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসলাম।
-কি রকম খারাপ জায়গা বলোতো?
-থাক স্যার দরকার নেই। আপনি ভয় পাবেন?
শুনে শব্দ করে হেসে উঠলাম।
- আচ্ছা তাহলে বলার দরকার নেই। আমি ভেবেছিলাম এখানে ডাকাতি-টাকাতি হয়।তাই বলছিলাম আরকি।
-চুরিডাকাতি নয় স্যার, এর থেকেও খারাপ। আমরা এখন যে জায়গা দিয়ে যাচ্ছি সেটা একসময় বড় গ্রাম ছিল। কলেরায় গ্রামটা পুরো সাফ হয়ে যায়।তারপর থেকে অনেকেই নাকি এখানে মৃত ব্যক্তিদের দেখেছে।
শুনে আবারো হেসে উঠলাম।হাসতে হাসতেই আলিকে বললাম
-শুনো সবকিছুই ভুজুংভাজুং ছাড়া কিছু নয়। দীর্ঘসময় গাড়ি চালিয়ে যখন মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায় তখন এইসব গল্প শুনে বিরক্তি দূর করার চেস্টা করে।
-কে জানে আপনিতো অনেক শিক্ষিত মানুষ। তাই এগুলো আপনার কাছে গল্প মনে হয়।বলে আলি গাড়ি চালানোয় মনযোগ দিল। আমিও চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেস্টা করলাম। মিত্রপুরে পৌছুতে বিকাল হয়ে গেলো। অফিস থেকে আগেই একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। বাড়ির মালিক আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। ঢাকার মতো এখানকার লোকজন এখনো নষ্ট হয়ে যায়নি৷ বেশ ভালো খাতির যত্নই পেলাম। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে যখন ঘুমুতে গেলাম বুঝতেই পারলাম না কখন ঘুমিয়ে পড়েছি৷
পরদিন সকালে নাস্তা করে কাজ করতে বেরোলাম। সাথে ড্রাইভার আলিও আছে।কখন কি দরকার ভেবে পরে আর ফিরে যায়নি। গ্রামের নানা বিষয়ে জরিপ করেই সময় কেটে গেলো। দুপুরে ভাড়া করা বাড়িতে ফিরে বিশ্রাম করে বিকালে আরেকটু কাজ করে সন্ধ্যায় রিপোর্ট লিখতে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক পুরো অন্ধকার হয়ে এলো। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছি। তখনি মনে হলো দূর থেকে চিৎকার এর শব্দ পেলাম। প্রথমবার কানের ভুল ভেবে চুপ করে রইলাম। তারপর আবার চিৎকার হলো। এবার বেশ জোরেই। দেখলাম আলিও তার বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। তারপর চিৎকার হতেই লাগলো। মনে হলো যেন ভীষণ ঝগড়া লেগেছে কোথাও। কয়েকমিনিট পরে দরজা ঠোকার শব্দ পেলাম। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেখলাম বাড়িওয়ালা আসলাম দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে করুণ গলায় বলে উঠলো "স্যার এখনই এজায়গা ছেড়ে চলে যান। নইলে বিপদ আছে"। আমি কি হয়েছে বলতেই আসলাম বলল" স্যার গ্রামের ছেসড়া জগু আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মদ খেয়ে মাতলামি করছে। তারাই এমন পশুর মতো চিৎকার করছে। আমরা গ্রামের লোক আমাদের কোন ক্ষতি করবেনা কিন্তু আপনেরা বাইরের লোক। জগু নিশ্চয় আপনাকে ধরতে আসছে। " বলেই চলে গেলো। আমি কিছুটা হতভম্ব। আলি আমাদের সবকথা নিশ্চয় শুনেছে। দেখলাম সে সবকিছু লাগেজে ভরতে শুরু করেছে। কাছেই কোথাও ভয়ানক শব্দে কেউ চিৎকার করে উঠলো। শুনে আমিও জিনিস গোছাতে লাগলাম। দুজনে সবকিছু গুছিয়ে যখন গাড়িতে উঠে বসলাম তখন জগুর দলটা খুব কাছে এসে পড়েছে। আলি পাগলের মতো গাড়ি চালিয়ে দশমিনিটে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে নিয়ে এলো। দুজনেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম। আলিকে বললাম "বড় বাঁচা বেঁচে গেছি আজকে আলি। জগুর হাতে ধরা পড়লে নিশ্চয় প্রানে মেরে ফেলতো "। " তা ঠিক বলেছেন স্যার। আর এই গ্রামে আসা যাবেনা।" বলল আলি৷ তারপর পুরো মনযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই গ্রাম ছেড়ে অনেক দূর এসে পড়লাম৷ আজকের মতো ভয় আর কখনো পাইনি। বেঁচে ফিরে এসেছি এটাই বড়৷ তখনি প্রচন্ড শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠলাম। কিছুক্ষণ পরেই গাড়ি প্রচন্ড কেপেঁ উঠে থেমে গেল। আলী তো ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। "স্যার শেষ পর্যন্ত জগুর মতো মাস্তানের হাতেই মরলাম" কেদে ফেলল আলী। আমি ততোক্ষণে নিজেকে অতি কষ্টে শান্ত করে সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনে তাকালাম। তখন রাত গভীর হয়ে গেছে। যতোদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। জগুটগুর কোন চিহ্ন পেলাম না। খুশি হয়ে আলি বললাম "এটা মনে হয় গাড়িরই কোন সমস্যা আলী, জগুদের তো দেখছি না। আর তাছাড়া আমরা মিত্রপুর থেকে অনেক দূরে আছি। মনে হয়না তারা এতোদূর পর্যন্ত পিছু নেবে"। শুনে মনেহয় আলি প্রাণ ফিরে পেলো। ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নেমে ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে গেয়েই চিৎকার করে উঠলো। আমি দৌড়ে সামনে গিয়ে গেলাম।
-কি হয়েছে আলি?ইঞ্জিনকি খারাপভাবে নষ্ট হয়েছে?
-না স্যার ইঞ্জিনের কিছু হয়নি। সামনের টায়ারের দিকে তাকান।
টায়ারের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলাম। মাইগড। বিশাল কিছু মনে হয় নক দিয়ে এটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে। এতো বড় প্রাণীও হয়? আলিকে শান্তনা দিতেই বললাম " নিশ্চয় রাস্তা দিয়ে শেয়াল যাচ্ছিল। গাড়ির চাকার সাথে ধাক্কা খেয়ে চাকা নষ্ট হয়ে গেছে। শুনে আলি বললো "শেয়ালের নক এতো বড় হয়?আর যে গতিতে যাচ্ছিলাম হাতির সাথে ধাক্কা খেলেও হাতি অচল হয়ে যাবে। শেয়ালের লাশ কোথায়?" অগত্যা চুপ করে গেলাম। আমার নীরবতা সম্ভবত আলীকে আরো ভয় পাইয়ে দিয়েছে। "এবার কি হবে স্যার? " আলি জিজ্ঞেস করলো। "কি আর হবে। কোথায় আছি সেটাইতো বুঝতে পারছিনা। আশেপাশে গ্যারেজ আছে কিনা কে জানে?" এক নিশ্বাসে বললাম। আলি কয়েক মুহূর্ত চারপাশে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল" স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে"। আমরা ওই খারাপ জায়গায় রয়েছি"। এবার আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। আলী কাদো কাদো হয়ে বলল "এইজন্যই তো বলি কি করে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। স্যারগো আমরা খুব খারাপ কিছুর কপ্পরে পড়েছি। আমাকে বাঁচান।" বলেই ফুপাতে লাগলো। আলিকে আর কি বলবো আমার নিজেরই তো ভয়ে হাতপা ঠান্ডা হয়ে গেছে। "আচ্ছা আলি তুমিতো প্রায় ই রোড দিয়ে যাও তুমি কি জানোনা গ্যারেজ আছে কিনা"? বললাম আমি।" আছেতো স্যার। কিন্তু ওইটা আরো পাচঁ মাইল দূরে"। "তাহলে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেনো চলো" বলেই হাটতে লাগলাম। যেভাবেই হোক এই অশুভ জায়গা থেকে বের হতে হবে। আলীকে পাশে নিয়ে হাঁটছিলাম। এম্নিতেই বেঁচারা একটু ভীতু। এইসব ঘটনার পর সে যে হার্ট ফেইল করেনি সেটাই আশ্চর্য। ভয় আমিও কম পাচ্ছিনা। অজানার ভয়। অন্ধকারের ভয়। কতদূর এসেছি জানিনা। নিশ্চয় বেশিদূর নয়। ভয়ে পা চলছিলো না। আলি একদম চুপ। নীরবে পাশে পাশে চলছে। মাঝে মাঝে কেপেঁ উঠছে। তখনি ঘটল ঘটনা। হঠাৎই ভীষণ শীতল এক হাওয়ার স্রোত মনে হলো আমাকে ছুয়ে গেলো। অস্পষ্ট গলায় বললাম আলি?আলি কেদে ফেললো।"কি হচ্ছে স্যার?।" কথা শেষ করতে পারলো না। বিশাল দানব আকৃতির এক জন্তু হাওয়ার বেগে সামনে দিয়ে দৌড়ে গেল৷ এক মূহুর্তের জন্য চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । এই অন্ধকারেও তাঁর বিশাল নকগুলো ধাতুর মতো জ্বলজ্বল করছিল। আলিও বোধহয় জন্তুটাকে দেখতে পেয়েছিলো। কেননা সে তখনি মাগো বলে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করে। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠিক নিজের ঘাড়ের উপর ভীষণ শীতল এক নিশ্বাস অনুভব করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার দরকার ছিল না। বুঝলাম আমার বিদায় আসন্ন। আবার সামনে থেকে আলীর চিৎকার ভেসে এলো। সে ছুটতেই রয়েছে। এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো অতিপ্রাকৃত জন্তুটা ভীষণ রেগে গেলো। যেনো তার শিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। ভয়ংকর গর্জনে তোলপাড় শুরু হলো চারদিকে। স্পষ্ট দেখলাম জন্তুটা তেড়ে গেল আলীর দিকে। অতঃপর দুজনেই অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো৷
পরদিন সকালে নিজেকে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যথা। কিছুদূর এগোতেই দেখলাম একটা কিছুকে ঘিরে ছোট্ট ভীড়। ভীড় টেলে ভেতরে ঢুকে যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হীম হয়ে গেলো ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আলির লাশ পড়ে রয়েছে। তার চোখে প্রচন্ড আতংকের চাপ স্পষ্ট।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৪:৩২