বিজয় সদ্য ইউনিভার্সিটি থেকে বের হয়েছে। অন্য কোথাও চাকরি না পেয়ে সামান্য স্যালারীতে পুলিশ কন্সটেবলে যোগ দেয়। সেদিন সে দুপুরে থানায় বসে ফারুক বাবুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল। বাইরে বেশ শীত। এই দুপুরেও সূর্য দেখা যাচ্ছেনা কুয়াশার ফলে। আড্ডার বিষয় যথারীতি খুনখারাবি। ফারুক বাবুর নিজের দেখা খুনের বর্ণনা শুনতে শুনতে চা'য়ে গলা ভিজাচ্ছিল বিজয়। আলস্যে কিছুটা ঘুম ঘুম পাচ্ছিল তারঁ। হঠাৎ দরজা প্রচন্ড শব্দে খুলে যাওয়ায় তারা দুজনেই বেশ চমকে উঠলো। দরজা দিয়ে দৌড়ে পুরো রক্তাক্ত অবস্থায় এক মেয়ে ভেতরে ঢুকলো। বিজয়ের কাছে এসেই কান্নায় ভেঙে পড়লো মেয়েটা। "আমার বোনটাকে মেরে ফেলেছে ওরা স্যার,মেরে ফেলেছে" বলেই আরো জোরে কাদতে শুরু করলো। বিজয় তো পুরো শকড। ফারুক বাবুর ও একই অবস্থা। নিজেকে কোনমতে সামলে বিজয় বললেন-"কে তুমি আর তুমিতো রক্তে ভেসে যাচ্ছ? আসো সামনেই একটা ক্লিনিক আছে।" কথাটা শুনে মেয়েটা আবারো ফুপিয়ে উঠলো "আমি সুমি স্যার আর ওইটা আমার রক্ত নয় স্যার আমার বোনের রক্ত। আপনি দয়া করে আমার সাথে চলুন।" শুনে বিজয় মেয়েটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। মেয়েটা বলেছে তারঁ বাসা জয়পুর গ্রামে। কাছেই বেশিক্ষণ লাগবে না। যেতে যেতেই মেয়েটার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিলো সে। মেয়েটার বোন তরুলতা " তরুলতার আজ বিয়ে ছিল। কিন্তু তরুলতার উপর গ্রামের কয়েকজনের নজর ছিল। তারা তরুলতার বিয়ের দিনে তাদের বাড়িতে হামলা করে তরুকে কুপিয়ে মেরে ফেলে। " কাদতে কাদতে সুমি নামের মেয়েটা বলছিল বিজয়কে। শুনে বিজয়ের ও কিছুটা কষ্ট হলো৷ দুপুর তিনটায় সে আর মেয়েটা জয়পুর গ্রামে পৌছুলো। গিয়ে দেখলো আসলেই রক্তারক্তি কান্ড। সুমির মা বাড়ির সামনে চিৎকার করে কাদছেন। সুমির সাথে সে তাদের ঘরে ঢুকে দেখলো তরুলতার রক্তে মাখা লাশ পড়ে আছে। বিয়ের সাজ এ সাজানো। সুমি বোনের লাশ দেখে কাপঁতে শুরু করলো। "তোমাকে এখানে থাকতে হবেনা সুমি।যাও বাইরে যাও। আমি আসছি"। সুমি বের হয়ে গেলো। ফের তরুলতার দিকে তাকালো বিজয়। সাংঘাতিক নির্মমভাবে তাকে মারা হয়েছে। ডান হাতটা প্রায় আলগা হয়ে গেছে। বিজয় একটু ঝুকে ভালো করে তাকালেন। যে হাতটা প্রায় কেটে গেছে সে হাতের আঙুলে তার চোখ স্থির হয়ে গেলো। অসাধারণ সুন্দর এক আংটি শোভা পাচ্ছে সে আঙুলে। এতো সুন্দর আংটি আগে সে দেখেনি। আংটিটা দেখেই ভেতরে লোভ জেগে উঠেছিল বিজয়ের। ঘরে কেউ নেই। এতো ঘটনায় সুমি কিংবা তার মা নিশ্চয় আংটিটা লক্ষ্য করেনি। যদি আংটিটার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন জাগে তাহলে নিশ্চয় তারা ভাববে মাস্তান ছেলেগুলো আংটিটা নিয়ে গেছে। এইসব ভেবেই বিজয় ধীরে ধীরে মৃত তরুর হাত থেকে খুলে নিল আংটিটা। আর সেদিনই তারঁ সর্বনাশের খাতা খুলল
ঐদিন সব ঝামেলা শেষ করে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরছিলো বিজয়। বাসায় ফেরার তাড়া না থাকলেও সে বেশ দ্রুত হাটঁছিল। মনের ভেতরে এক চাপা অস্বস্তি। এতোক্ষণে নিশ্চয় সুমিরা গ্রামের লোককে সাথে নিয়ে তরুকে কবর দিয়ে ফেলেছে৷ যাক বাঁচা গেলো। চাকরি করে আর কত টাকা পান, এই আংটিটা বেঁচে তারঁ তিনমাস চলে যাবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ি ফিরছিল বিজয়। চারপাশ বেশ অন্ধকার। এই অন্ধকারেই কোনভাবে বাসায় ফিরলো বিজয়।
এরপর সপ্তাহখানেক হয়ে গেলো। কিছু হয়নি। সব কিছু আগের মতো। দুই সপ্তাহ পরে একটু দেরি করেই থানায় গেলো বিজয়। তাকে দেখেই ফারুক আর অন্য কলিগরা লাফিয়ে উঠলো। "আরে দোস্ত বিজয়" বলে উঠলো ফারুক "সুমি মেয়েটার কথা মনে আছে?আরে যার বোন কিছুদিন আগে মার্ডার হলো?" শুনে চমকে উঠলো বিজয়। আবার কি হলো? "তুই শুনিস নি?তরুলতা মেয়েটার লাশ কে যেন চুরি করে নিয়ে গেছে রে কবর কুড়ে" এক নিশ্বাসে বলল ফারুক৷" একটা মানুষ কতটুক বিকৃতমনা হলে লাশ চুরি করে বুঝ এবার"। বিজয় সব শুনলো। যদিও তারঁ কিছু আসে যায়না তবুও লাশ চুরির ঘটনা শুনে বিজয়ের একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। সন্ধ্যা হতেই বিজয় থানার ওসিকে বলে ছুটি নিয়ে দ্রুত পায়ে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলো। অর্ধেক পথ পেরোতেই অন্ধকার হয়ে এলো। আজ যেনো রাস্তা শেষ হচ্ছেনা ভাবলো বিজয়। আরো কিছুদূর এগোতেই তারঁ হাপানী শুরু হয়ে গেলো৷ ঘড়ি দেখলো বিজয়। ঘড়ি দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। সাড়ে আটটা। অথচ থানা থেকে বেড়িয়েছে সাড়ে ছ'টায়। বাসায় ফিরতে আধ ঘন্টার বেশি লাগেনা৷ আর এখন দু'ঘন্টা হতে চলেছে৷ নিশ্চয় সে রাস্তা ভুল করেছে। কিন্তু দশ বছর যে রাস্তা দিয়ে চলাচল করেছে সে রাস্তা ভুল করা সম্ভব? এইসব ভাবতেই ভয় ঝেকে ধরলো তাকে। বার বার তরুলতার মৃত মুখটা চোখে ভাসছে৷ ফলে ভয়টা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। দূর থেকে শেয়াল ডেকে উঠলো। বিজয়ের মনে হলো সে হার্টফেইল করবে। খুব ভয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে সে প্রায় দৌড়ে চলছিল। এভাবে কতক্ষণ চলছিল সে জানেনা। যখন কিছুদূর সামনে শতবর্ষ পুরোনো আম গাছটা দেখতে পেল তখন তার বুকে পানি এলো। বেঁচে গেছি তাহলে। প্রতিদিনই বাসায় যাওয়া আসার পথে এই গাছটা পড়ে। আরেকটু সামনে যেতেই ভুল বুঝতে পারলো। এটা কোন আমগাছ নয়। কুয়াশা জমে জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে। দূর থেকে গাছের মতো দেখাচ্ছিল৷ আবারো প্রচন্ড ভয় অনুভব করলো বিজয়। একি হচ্ছে?এটা কি তার আংটি চুরির ফল? পা আর নড়ছে না। বিজয়ের মনে হলো সে তারঁ পা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ তার পায়ের নিচের মাটি কেপেঁ উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই সে এক ভাঙা কবরে পড়ে গেল। প্রচন্ড আতংক তার শরীর অবশ করে দিয়েছে৷ আকাশে এতোক্ষণে চাঁদ উঠেছে৷ চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে এক পুরোনো ভাঙা কবরে পড়ে আছে। পায়ে হাটার শব্দ হচ্ছে । ধীরে ধীরে শব্দটা এগিয়ে আসছে৷ প্রচন্ড আতংক নিয়ে দেখলো কবরের পাশে এক নারীমূর্তি এসে দাড়িয়েছে। হৃৎযন্ত্র বন্ধ হলো বিজয়ের।
পরদিন সকালে জয়পুরের লোকজন তরুলতার কবরে বিজয়ের লাশ পায়।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:০০