শুরু হয় ‘আস্ক আউট’ দিয়ে। এরপর ‘হ্যাং আউট’ করা। তারপর বিভিন্নভাবে চলে ‘মেক আউট’ পর্যায়। এরপর যেটা হয় সেটা কেউ জোরেশোরে বলে না। কারণ সেটা হলো ‘গেট আউট’। আর, এসব কিছুর মধ্য দিয়ে আরো একটা জিনিস জীবন থেকে আউট হয়ে যায়, সেটা হলো সুখ!
-এই ‘আউটিং কালচার’ হলো আমাদের তরুণ সমাজের বর্তমানের ‘ফ্যাশন’। আগে এটা ভার্সিটি গিয়ে শুরু হতো, আর এখন স্কুল থেকেই ছেলেমেয়েরা বের হয় আরেকজনের হাত ধরে! সমস্যাটা হলো, সবার কাছে এটা এখন খুব জরুরি একটা ব্যাপার। ‘হ্যাং আউট’ করার মত কেউ না থাকলে যেন জীবন ব্যর্থ। যারা ইতিমধ্যে একটা সম্পর্কে আছে তারা যে একেবারে সুখী-ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চিন্ত তাও নয়। কেউ কেউ নিত্য-নতুন ভাঙাগড়ার খেলা খেলে। কেউ আবার নানান কৌশলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে, হিন্দি ছবির কার্যকলাপ অনুকরণ করে জীবনে বৈচিত্র্য খুঁজে। আর, তাদের হাত ধরাধরি- পাশাপাশি বসে হাসাহাসি- ঘোরাঘুরি আর ওড়াউড়ি অন্যদের ভীষণ সুড়সুড়ি দেয়। এজন্য ‘মেক আউট’ করাটাকে ফরজ ভেবে আমাদের তরুণ-তরুণীরা যোগ্য সঙ্গী সন্ধানে একেবারে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে!
‘তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’ -এই আমন্ত্রণবাণী কপালে লাগিয়ে শুরু হয় সাজগোজ-ব্রান্ডেড পোশাকের পেছনে টাকার শ্রাদ্ধ, আর আড্ডা-ফেসবুকের পেছনে সময়ের শ্রাদ্ধ। ‘একটা না একটা তো হবেই’ -এই ভেবে শুরু হয় সবার দরজায় করাঘাত। বুদ্ধিমানরা আবার একইসঙ্গে কয়েকটাও চালিয়ে যান: ‘রূপধারী’টা থাকে সাথে নিয়ে ঘুরার জন্য, ‘গুণধারী’টা থাকে হোমওয়ার্ক-অ্যাসাইনমেন্ট করে দেয়ার জন্য, আর পয়সাওয়ালাটা থাকে বিয়ে করার জন্য!
আর প্রথমদিকে সবকিছুই ভালো লাগে। প্রেমিক পরীক্ষায় ফেল করলেও মনে হয়- ভালো মানুষ হওয়াটাই বড় কথা, ক্যারিয়ার আর এমন কী! আবার, প্রেমিকা যখন রাস্তায় নামতে ভয় পায়, তখন সিএনজি-র পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে মনে হয় আমার প্রেমিকার ভাবসাব-ই আলাদা, একেবারে খানদানি! কিন্তু বিয়ের পর কী হয়? আজকাল তো বিয়ে পর্যন্তও যেতে হয় না, এর মধ্যেই ‘বহুগমন’ হয়ে যায়। কারণ প্রাথমিক মোহ কেটে গেলেই রঙিন চশমা আর চোখে থাকেনা। তখন মনে হয়, অমুক বান্ধবী কত্ত সুখে আছে, কারণ তার স্বামীর দুইটা গাড়ি, ঘুরতে ওরা বিদেশ যায়। আর বিয়ের পর স্বামী হয়ে কিন্তু আর স্ত্রীর সিএনজির পেছন ঘুরতে ভালোলাগে না। স্ত্রীর রান্না না পারা-রিক্সা করতে না পারাকে আর আহ্লাদ লাগেনা, ‘ভড়ং’ মনে হয়। ঐ যে শেক্সপিয়র লিখেছিলেন না, উচ্ছৃঙ্খল ছেলের সাথে প্রেম করে দেখে বাবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করছেন, মা, ঐ গরুটার মধ্যে তুই এমন কী দেখতে পাস্? মেয়ে বলছে, বাবা, আমার হৃদয় দিয়ে তুমি একবার ওকে দেখ! তো, বাবা বললেন, মা-গো, তুই আমার মস্তিষ্কটা দিয়ে একবার ওকে দ্যাখ্!
আসলে বয়সটাই যেন কেমন! ভেতরে হরমোনের এত দৌড়াদৌড়ি হয় যে বাইরে নিজেকে স্থির রাখাই দায়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ডোপামাইন নামের এক নিউরোট্রান্সমিটার এসময়টাতে মস্তিষ্ককে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করে। এর প্রভাবে শরীর-মনে সৃষ্টি হয় বাঁধভাঙা আনন্দ, সীমাহীন অনুপ্রেরণা, আর অসাধারণ প্রাণপ্রাচুর্য। যৌবনের এ বিস্ফোরণ আপনাকে দেয় বড় কিছু করার শক্তি। এ হরমোন কেউ কেউ ব্যয় করেন সৃষ্টিশীল কাজে, হয়ে উঠেন কালজয়ী প্রতিভা, সফল মানুষ। আর আমরা কী করি? আমারা এই উদ্যমকে ব্যয় করি আরেকটা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, নিজের কামকে চরিতার্থ করার জন্য। যেসময়টাতে যোগ্য হওয়ার কথা- সেসময় আমরা বিভোর থাকি বাক্ওয়াস আর বেয়াড়াপনার মধ্যে- ঘর ছাড়বো, বাড়ি ছাড়বো, জীবন দেবো, তবু প্রেম ছাড়বো না। আরে রাজ্যই হলো না, সিংহাসন ছাড়বে কী করে? এসময় আমাদের অবস্থাটা হয় ‘ঢাল নেই, তলোয়াড় নেই, নিধিরাম সর্দার’ -এর মতন! এজন্য পৃথিবীতে যারা অনেক উচুঁতে উঠেছেন তারা শুরু করেছেন তরুণ বয়স থেকেই। কারণ মধ্য তিরিশ হলো ঝিমিয়ে পড়ার বয়স। আর যখন প্রস্তুতি নেয়ার কথা তখন আমরা ব্যস্ত থাকি প্রিয়জনের সুখ-কল্পনায়। এরপর যখন হাজারটা পিছুটান তখন এগিয়ে যাবার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগটা কি থাকে?
আর সবচেয়ে দুর্ভাগা তারা যারা বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন। এক তরুণীর কথা শুনেছিলাম: কক্সবাজারে ছুটি কাটাতে গিয়ে এক ছেলের সাথে দেখা। যেটা হয়- এক দেখাতেই ভালোলাগা। এর পরের তিনদিন তো যেন স্বপ্ন একটা! কত কথা, কত গান, কত আনন্দ! তিনদিনের মধ্যেই হাত ধরাধরি, বালুকাবেলায় পায়চারি। চারদিনের দিন ফেরার সময় এলো। মেয়ে তো আহ্লাদে আটখানা- আজকে নিশ্চয়ই ছেলেটা তাকে জানাবে ভালোবাসার কথা, ঢাকায় ফিরে দেখা করার কথা, অথবা বিয়ের কথা! কিন্তু যখন দেখা হলো, যা শুনেছিলো তা এখনও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার সুদর্শন রাজপুত্র শেষ মুহূর্তে তাকে বলেছিলো, ‘মাত্র তিনদিনে কি সবাইকেই এমন প্রশ্রয় দাও?’
আপনি যদি ধর্ম নাও মানেন, তাহলেও অন্তত বাস্তব যুক্তিটাকে তো মানতে হবে। যারাই সম্পর্কে শরীরকে জড়িয়েছেন, প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই বিয়ের পর তারা বিশ্বাসহীনতায় ভুগেছেন। সন্দেহে জর্জরিত হয়েছেন। একসময় ভেবেছিলেন আমাকে ভালোবাসে বলেই তো বিয়ে নামক প্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে সবকিছু দিয়েছিলো। আর আজকে কী ভাববেন? বিয়ের প্রতি তো কোনো ভক্তি তার নেই, প্রথাকে তো সে মান্য করে না- আবারও যদি তেমন কিছু করে? কোন সামাজিকতা তাকে আটকে রাখবে?
জীবনে সবকিছুর দরকার আছে। কোনোটা বাদ দিয়ে কোনোটা না। কেবল বৈষয়িক সাফল্য যেমন আপনাকে সুখী করবে না, তেমনি স্রেফ প্রেম বা জৈবিক বাসনাই জীবনের সবকিছু না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনি ঠিক সময়ে ঠিক কাজটা করছেন কিনা। এবং সিদ্ধান্তটা ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিচ্ছেন, নাকি আবেগের বশে হঠকারী হয়ে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছেন? অন্যরা সবাই ‘গো আউট’ করছে দেখে যদি আপনারও হাত-পা নিশপিশ করে তারমানে হলো আপনি বাইরেটা দেখেই হাবুডুবু খাচ্ছেন; অন্যরা মদ খেয়ে মাতাল হচ্ছে, আর আপনি মাতালদের দেখেই মজে যাচ্ছেন! -এই তফাতটা আপনার কাছে যখন পরিস্কার হবে তখন আর আপনার পা-পিছলানোর সম্ভাবনা থাকবেনা। আজকাল ভালো থাকাটা খুব কঠিন, কারণ চারপাশে বহু খারাপের প্রলোভন। আর কঠিন বলেই কিন্তু ঝাঁকে ঝাঁকে আমরা নেতা পাইনা, পাই এক-আধজনকে যারা জীবনে এগিয়ে থাকেন, সমাজকে বদলে দেন। সিদ্ধান্ত আপনার- পথপ্রদর্শক হবেন, নাকি পালের মধ্যে একটা ভেড়া হয়েই জীবন কাটিয়ে দিবেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:০৭