somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

ফিরতি ট্রেনের হুইসেল

০৩ রা জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শরতের ভোরে শিউলি ঝরার মতো শেষ হয়ে যায় ছুটির দিনগুলো। দুই ঈদ ছাড়া আমাদের বিশেষ কোনো দীর্ঘ ছুটি নেই। এই ছুটিগুলোর অপেক্ষায় সারা বছর মুখিয়ে থাকি। কত যে জল্পনা-কল্পনা থাকে ছুটির দিনগুলোকে ঘিরে! এই ঈদের ছুটিতেও এর কমতি ছিল না। কিন্তু ছুটিদের কী যে এত তাড়া, ভাবনার পূর্ণতা পাওয়ার আগেই তনুমন নাড়িয়ে ফিরতি ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে দেয়। ফিরতে হয় অচেনা মানুষের ভিড়ে খানিক চেনা শহরে। তারপর শুরু হয় আটটা-পাঁচটার পাঁচালি আর কীবোর্ডের খটখটানিতে বোকাবাক্সে বন্দিজীবন।

ছুটির শেষ দিন, ভোর হলেই রুটিরুজির তাগিদে ফিরতে হবে জাদুর শহরে। বিষণ্ন মন নিয়ে শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিই বিছানায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার মতো আকাশেরও আজ বেজায় মন খারাপ। কালো মেঘে ছেয়ে আছে গোটা আকাশ। ভেবেছিলাম, বাসের টিকিট কাটার ঝক্কি এড়াতে বেলা বাড়ার আগে রওনা করব। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা, তাতে এ বেলায় আর বের হতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।

এসব ভাবতে ভাবতেই শুরু হলো অঝোর শ্রাবণ। বেলা গড়াচ্ছে, কিন্তু থামছে না ধারাবর্ষণ; ঝরছে অবিরাম। মনে হচ্ছে আজন্মের কান্না কেঁদে তবেই শান্ত হবে আকাশ। মেঘের গুড়ুম গুড়ুম আর বৃষ্টির রিমঝিম মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমারও এরকম করে কারো গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, এভাবে কাঁদলে হাজার বছরের জমিয়ে রাখা ভাবাবেগ আর বেদনাগুলো ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে না।


তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর, আকাশের মন ভালো হলো। মেঘ কেটে দেখা দিল আলোর রেখা। দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে, সম্পর্কের মায়া কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য বাস-স্টপ। গাড়ি চলছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রোদের তাপ। কুলকুল করে ঘেমেনেয়ে ওঠার অবস্থা। বাস-স্টপের কাছাকাছি এসে খানিকটা যানজটের দেখা পেলাম। গাড়িতে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ পড়ল, মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক তার বিশ-একুশ বছরের ছেলেকে কপালে চুমু খেয়ে বিদায় দিচ্ছে। বাবা-ছেলের এমন মুহূর্ত দেখে, আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। তিনিও আমাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতেন। নিজ হাতে গাড়িতে তুলে দিতেন ব্যাগপত্র।


বাস-স্টপে পৌঁছে দেখি, কাউন্টারে বিশাল লাইন অজগর সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেক দূর। দৌড়ে গিয়ে লাইনের শেষ মাথায় দাঁড়ালাম। একে একে লোক এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। মনে হচ্ছিল, লাইন তো নয় যেন নকিয়া মুঠোফোনের সেই ভয়ংকর সাপ; যে প্রতি সেকেন্ডে এক ধাপ করে বড় হয়ে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ, কিন্তু সামনে থেকে মানুষের সংখ্যা কমছে না। মনে মনে ধরেই নিয়েছি, সন্ধ্যার আগে টিকিটের দেখা মিলবে না।


কচ্ছপ গতির চেয়েও ধীর গতিতে লাইন এগোচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়ে সাথে থাকা ব্যাগপত্র আর রোদের তাপে সবাই হাঁসফাঁস করছে। আমি আশেপাশে মানুষের ছুটে চলা দেখছি। যারা টিকিট পেয়েছেন, তারা একে একে বাসে উঠে যাচ্ছেন। সবার হাতেই ব্যাগভরতি ভালোবাসা—বাসা থেকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাগানের সবজি, গাছের আম-কাঁঠাল, নারিকেল; বাদ যায়নি রান্না করা গরুর মাংসও। এমন পাগলামি মা ছাড়া আর কে-ইবা করতে পারে।

এসব দেখতে দেখতে প্রায় কাউন্টারের কাছাকাছি চলে এসেছি। আশা করছিলাম, আর দুই বাসের টিকিট শেষ হলে টিকিট হাতে পাওয়ার সৌভাগ্য হবে। হঠাৎ এক অপরিচিত ভদ্রলোক এসে বললেন, ‘আপনি কী একা?’ আমি হ্যাঁ বলতেই তিনি বললেন, ‘ভাইয়া আমি আসলে চারটি টিকিট কেটেছিলাম। কিন্তু আমাদের একজন এখনো এসে পৌঁছায়নি।’ সে আসতে আসতে বাস ছেড়ে দেবে। আমি তার সাথে যাব। আরেকজন ভদ্রলোককে বলেছি, তিনি রাজি হয়েছেন। আপনি চাইলে একটি টিকিট নিতে পারেন।’ আমি ভদ্রলোকের কাছে গাড়ি আর সিট নাম্বার জানাতে চাইলাম। তিনি যাত্রী ছাউনীর দিকে তাকিয়ে একটি মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মিতু সিট নাম্বার কত?’ মেয়েটি মুখ তুলে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলল, ‘এফ থ্রি, এফ ফোর, জি থ্রি আর জি ফোর।’


কী নির্মল সে হাসি! সৃষ্টিকর্তা কিছু কিছু মানুষকে অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। যে ক্ষমতা বলে তারা পৃথিবীতে মুগ্ধতা ছড়ায়। এই মেয়েটির হাসি সেই ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এক পলকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সমস্ত ক্লান্তি উবে গেল কর্পূরের মতো।
টিকিটের মূল্য মিটিয়ে বাসে উঠেছি। এফ থ্রি, এফ ফোরে ভুবন ভোলানো হাসির মেয়ে আর তার মা বসেছেন। তাদের ঠিক পেছনে আমি আর সেই ভদ্রলোক। সিটে বসে মনে হলো, কিছু কিনে নিয়ে বসা যাক। পাশের ভদ্রলোককে বললাম, ‘ভাইয়া আপনি বসুন আমি পানি নিয়ে আসছি।’ বাস থেকে নেমে যাচ্ছি, এমন সময় পেছন থেকে মেয়েকণ্ঠে ‘ভাইয়া’ ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই মেয়েটি। কাছে যেতেই হাতে টাকা দিয়ে বলল, ‘আমার জন্য এক বোতল পানি আনবেন, প্লিজ।’ বিষয়টি এত দ্রুত ঘটল—পানির জন্য টাকা নেব কি নেব না এসব ভাবার ফুরসত হলো না। পরে ভাবলাম, একজন অচেনা মেয়ে কাছ থেকে এই অবস্থায় টাকা না নিলেই বরং এটি দৃষ্টিকটু হতো।


রাস্তা একদম ফাঁকা। কোনো যানযট নেই। বাস দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে জাদুর শহরের দিকে। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে স্মৃতিদের পেছনে চলে যাওয়া দেখছি। দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে আমার চিরচেনা শহর, চেনামুখ, পরিচিত ডাক। ‘স্যার টিকিট?’ শব্দ শুনে সম্বিত ফিরে পেতেই মেয়েটি চেকারকে টিকিট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিন; এই চারটি সিট আমদের।’ চারটি টিকিট একত্রে কাটায় তাদের কাছেই ছিল টিকিট। চেকার চলে যাওয়ার পর মেয়েটি পেছন ঘুরে একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় নামবেন ভাইয়া?’ বললাম, ‘মহাখালি রেল গেইট।’ শুনলাম তারা নামবে খিলক্ষেত।


বাস প্রায় খিলক্ষেত চলে এসেছে। আমার ভাবনার ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি করছে নানা রঙের কথার তুলি। এই মেয়েটির সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না; ভুল করেও দেখা হবে না। এসব জানার পরেও তার জন্য ভেতরের কোথাও একটু মৃদু টান অনুভূত হচ্ছে। কেমন মায়া মায়া গন্ধ টের পাচ্ছি। আমার এই এক বাজে স্বভাব। কেউ দুগাল হেসে কথা বললেই মায়ায় জড়িয়ে যাই। ভাবলাম, এসব অযাচিত চিন্তা রেখে বরং বাস্তবে ফিরে আসা যাক।


কিছুক্ষণ পর বাস খিলক্ষেত এসে থামল। মেয়েটি আমার দিকে একাবার তাকিয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, মেয়েটির মুখ মলিন হাসির লেশ মাত্র নেই। তার এই মূর্তি দেখে মনেই হচ্ছে না, সে ওমন ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে ঢেউ তুলতে পারে শান্ত নদীর বুকে। আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে, পেছন থেকে তাকে ডাকার। অন্তত এতটুকু হলেও বলার, ‘ভালো থাকবেন’। কিন্তু অজানা এক শক্তি দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছি। সবসময় সব কথা বলতে নেই। কিছু কথা কিছু অনুভূতি নিজের জন্য রেখে দিতে হয়। এই না বলা অনুভূতি আর কথামালাগুলো রেখে দিলাম আমার একান্ত স্মৃতির দেরাজে।

ছবিঃ গুগল
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×