তাদের সম্পর্কটা কেউই মেনে নেয় নি। ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলো তারা। তাহলে কি তাদের ভালোবাসাটা অপরাধ ছিলো? না, তারা ছিলো দুইজন দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। যে ধর্ম মানুষ থেকে মানুষকে আলাদা করে রাখে, সেখানে ভালোবাসা এক করে দিয়েছিলো এই দু’টি আত্মাকে।
বলছি মিতু আর টুটুলের কথা। মিতু আমার একদম ছোটবেলাকার বান্ধবী। খুব ছটফটে আর হাসি-খুশি স্বভাবের ছিলো মেয়েটা। তার সেই দুরন্তপনাটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে? চোখের ভাজে গভীর কষ্টের ছাপ পরে গেছে। টুটুলের অকালে চলে যাওয়াটা সে মেনে নিতে পারছে না কিছুতেই।
ঘটনার সুত্রপাত আজ থেকে তিন বছর আগে।
টুটুল ছিলো আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। টুটুল আর মিতুর পরিচয়টা হয় মূলত আমার মাধ্যমেই। আমাদের স্কুলের রি-ইউনিয়ন চলছিলো। টুটুলও গিয়েছিলো আমার সাথে। সেখানেই তাদের পরিচয়। তারপর ফেসবুকে যোগাযোগ, ফোনে কথাবার্তা, মেসেজ আদান প্রদান; এভাবেই তাদের মধ্যে একটা গভীর বন্ধুত্ব তৈরী হয়ে যায়। আর আমি তো আছিই। আমরা তিনজন, যেন এক আত্মাতে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের কলেজ আর মিতুর কলেজটা পাশাপাশি হওয়াতে যোগাযোগটাও ছিলো সহজ, আর আড্ডাও জমত বেশ। প্রায় আমাদের মাঝে ছোট ছোট খুনসুটি লেগেই থাকত। তবে মিতু আর টুটুলের ক্ষেত্রে একটু বেশিই। মাঝে মাঝেই দেখতাম দু’জন রাগ করে কথাবার্তা বন্ধ; কারণ অদৃশ্য। আবার বেলা গড়াতে না গড়াতেই সব ঠিক। প্রথম বিষয়টা বুঝতে পারি নি। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, তাদের সম্পর্কটা বন্ধুত্ব থেকেও আরো গভীরতার দিকে এগিয়ে গেছে, অনেক আগেই।
তাদের সম্পর্কের কথাটা মিতুর কাছেই শুনি প্রথম। সে কিছুই লুকোত না আমার কাছে। তাই এটাও না বলে সে থাকতে পারে নি। প্রথম দিকে এই সম্পর্ক নিয়ে তাদের মাঝে কোন চিন্তা-ভাবনা না থাকলেও পরবর্তিতে নানান চিন্তা ভর করতে থাকে। মিতু আমাকে প্রায়ই বলত, তাদের এই সম্পর্ক কেউ মেনে নিবে না। কারণ সে মুসলমান আর টুটুল হিন্দু। টুটুল প্রায়ই বলত, সে মিতুর জন্য সব ছাড়তে রাজি আছে। কিন্তু সমস্যা বাঁধে তখনই যখন মিতুর ফ্যামিলির সবাই এই সম্পর্কের কথাটা জেনে যায়। মিতুর বাবা ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে একেবারেই আপোষহীন একজন মানুষ। তিনি কিছুতেই এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না। মিতুকে বাসায় বন্দি করা হলো। আমাকেও অনেক কথা হজম করতে হলো। এর পর থেকে প্রায় ন’মাস কেটে গেছে, মিতুর সাথে কোন যোগাযোগ হইনি। এর মাঝে এইচ.এস.সি পরিক্ষা শেষ করে আমি চলে এলাম ঢাকায়; আর টুটুল চট্টগ্রাম।
হঠাৎ একদিন ক্লাস শেষে ভার্সিটির বাসে করে বাসায় ফিরছি। ফোন এল; ওপাশ থেকে ভেসে এলো মেয়ে কন্ঠ। বুঝতে পারলাম মিতু।
বলল, “দোস্ত কোথায় আছিস? আমাকে এসে নিয়ে যা। আমি মহাখালী বাসস্টপে দাড়িয়ে আছি।” পরিমরি করে ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডে।
কি কাহিনী?? বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে মিতু। চট্টগ্রাম থেকে টুটুল আসছে। আজই বিয়ে করবে। আমি এতদিন পর বন্ধুকে দেখে খুশি হব নাকি মিতুর এমন ক্রিয়াকলাপ থেকে আশ্চর্য হব, বুঝতে পারছিলাম না। যাহোক, এসেই যখন পরেছে, সব দায়িত্ব এখন আমাকেই নিতে হবে। টুটুলকে ফোন দিলাম। বলল বের হয়ে পরেছে। বিকেলের মধ্যেই পৌছে যাবে। এখন মিতুকে কোথায় নিয়ে যাই বুঝতে পারছিলাম না। একে তো ব্যাচেলর, তার উপর থাকি মেসে। ভাবলাম আসেপাশে কোথাও ঘুরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে দিই, পরেরটা পরে দেখা যাবে।
এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলেছে, কিন্তু টুটুলের কোন খবর নেই। ফোনটাও বন্ধ পাচ্ছি। সাতটা বাজতে চলেছে।
সোয়া সাতটার দিকে ফোন এলো টুটুলের নাম্বার থেকে, “হ্যালো, কে বলছেন?”
বুঝতে পারলাম টুটুল না, অন্য কেউ। “আপনি যার ফোন থেকে ফোন দিয়েছেন আমি তার বন্ধু।‘
ওপাশ থেকে বলল, “তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিক্যালে চলে আসুন। আপনার বন্ধু এক্সিডেন্ট করেছে।”
মিতু জানতে চাইল কি হয়েছে। আমি কিছু বলার সাহস পেলাম না। মিতুকে নিয়েই ছুটলাম ঢাকা মেডিক্যালের দিকে। ফোনের সেই লোকটা তখনোও ছিলো বলে খুজে পেতে কষ্ট হলো না। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। টুটুলের নিথর দেহটাই যে কেবল পরে ছিলো হাসপাতালের বিছানায়। আমি শক্ত করে মিতুর হাতটা চেপে ধরলাম। ওর দিকে তাকাতেই ভয়ে আমার হাত পা জমে গেলো। মেয়েটা একদম পাথর হয়ে গেছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বেডে পরে থাকা টুটুলের দিকে। নিঃশাস্বও পরছে না। আমি আলতু করে ঝাকি দিতেই, ফোঁপরে কেঁদে উঠলো মিতু। আমিও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না।
পরদিনই বাসা চ্যাঞ্জ করেছি। মিতু এখন আমার সাথেই আছে। বাড়ির দরজা এখন তার জন্য বন্ধ। চেষ্টায় আছি, যেভাবেই হোক তাকে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এরই মাঝে তার প্রতি কেমন জানি একটা মায়া পরে গেছে। ওর শুকনো মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না। আজ বড্ড ভালবাসতে ইচ্ছে করছে তাকে। কিছু বলতেও পারছি না। তার প্রতি এই হঠাৎ ভালোবাসাটা যদি সে করূণা ভেবে বসে......
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৫২