প্রধান চরিত্রের পাশাপাশি পার্শ্বচরিত্রের প্রতিও হুমায়ূন আহমেদ সমানভাবে যত্নশীল। তাঁর উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই তাই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আজকের পর্বে ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর সাথে নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেবের আলাপচারিতায় তাঁর চরিত্রের এমন কিছু দিক প্রকাশ পেয়েছে, যাতে কখনো তাঁকে ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর চেয়ে উজ্জ্বল মনে হয়েছে।
তাই নীলগঞ্জ হাইস্কুলের দুই শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর, প্রধান শিক্ষক মনসুর সাহেব ও তাঁদের ঘিরে থাকা আরো কিছু মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা নীলগঞ্জ নামের একটা গ্রামের গল্প আজ আমি বলবো।
আগের পর্বগুলোঃ
জোছনা ও জননীর গল্প – ভূমিকা
জোছনা ও জননীর গল্প- পূর্বকথা
জোছনা ও জননীর গল্প- মুক্তিযুদ্ধের শুরুর কথা
ঘটনাপ্রবাহ
ঢাকা শহর থেকে ফেরার সময় ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী একটা পতাকা কিনে নিয়ে এসেছিলেন স্কুলের জন্য। আগেরটার রঙ জ্বলে যাওয়ায় উনি ১২ টাকা দিয়ে সিল্কের বড় গাঢ় সবুজ রঙের জাতীয় পতাকাটা কেনেন এবং স্কুলের মাঠে পত পত করে পতাকাটার উড়ার দৃশ্যটা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল যেন একটা সবুজ রঙের টিয়া পাখি উড়ছে, গভীর আনন্দে তাঁর চোখে পানিও এসে গেল, এমনি সময়ে স্কুলের দপ্তরি মধু এসে তাতে ছেদ টানে – উনাকে হেডস্যার ডাকছেন। সেই আনন্দটুকু সঙ্গে করে উনি হেডস্যারের রুমে গেলেন এবং বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করলেন, উনার প্রিয় হেডস্যার উনার এই আনন্দটাকে নির্মম ভাবে আঘাত করলেন।
জাতীয় পতাকাকে হেডস্যার অপ্রয়োজনীয় আখ্যায়িত করে এর জন্য ইরতাজউদ্দিন যে টাকা খরচ করেছেন তা স্কুল ফান্ড থেকে দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন।
সাথে ইরতাজউদ্দিনকে অনুরোধ করেন উনার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য দোয়া করার জন্য।
সকালের এই ঘটনায় ইরতাজউদ্দিন অত্যন্ত মর্মাহত এবং জোহরের নামাজের পর পাকিস্তানের সংহতি ও মঙ্গলের জন্য দীর্ঘ প্রার্থনা করেন। হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীর জন্য দোয়া করতে ভুলে যাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে যায় এবং আবার নফল নামাজ পড়লেন।
সেইদিনটা ছিল পহেলা মার্চ ১৯৭১ এবং এইদিন দুপুরে ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেন।
ঘটনাবহুল এইদিনের সন্ধ্যাটা ইরতাজউদ্দিনের জন্য ছিল আরো ঘটনাবহুল। মধু এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায় হেডস্যারের বাসায় খাওয়ার জন্য। সেখানে হেডস্যার তাঁর বড় শ্যালককে লেখা চিঠি গড় গড় করে মুখস্ত পড়ে শোনান-যার সার কথা ছিল উনি যদি ভাল মনে করেন তবে পাবনা মেন্টাল হাসপাতালে তাঁর বোনকে ভর্তি করাতে পারেন। ইরতাজউদ্দিন এর বিরোধিতা করেন এবং উনাকে পরামর্শ দেন ভাবিকে নীলগঞ্জে নিয়ে আসার জন্য।
বিধিবাম, কুকুর খাবারে মুখ দিয়েছে। তাই ইরতা্জউদ্দিন মধুকে সঙ্গে নিয়ে আবার নিজের বাসার দিকে রওনা হয়। কিন্তু প্রচন্ড ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁরা আশ্রয় নেন থানায়। সেখানেই ওসি সাহেবের সন্তান-সম্ভবা স্ত্রী তাঁদের খুব যত্ন করে খাওয়ান। তৃপ্তি করে আহারের পর ইরতাজউদ্দিন উনার জন্য মন থেকে দোয়া করেন, দোয়ার কথাগুলো ওসি সাহেবের স্ত্রীর চোখে অশ্রু এনে দেয়।
ঝড় থামার পর বাড়ি ফিরে ইরতাজউদ্দিন অবাক হয়ে যান, সেখানে তাঁর বাড়ির চিহ্ন মাত্র নেই।
ইরতাজউদ্দিনের এত দুঃখের মধ্যেও মধুর শ্লোক থেমে থাকেনি। নির্বাক ইরতাজউদ্দিন, আনন্দিত স্বরে মধু শ্লোকের উত্তর জানায় – ঝড়।
একান্তে দেখা - মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী
গতপর্বে ইরতাজউদ্দিনকে পারিবারিক মন্ডলে একজন স্নেহপ্রবণ মানুষ হিসাবে আমরা দেখতে পাই, এপর্বে অফিসিয়াল কাজ-কর্মের মধ্যে থেকেও হেডস্যারের সাথে তাঁর আত্মিক সম্পর্কটা জানিয়ে দেয় যে, নরম-সুন্দর মনের একজন মানুষ, সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারে।
পতাকা নিয়ে হেডমাস্টার মনসুর সাহেবের সাথে তাঁর মনোমালিন্য হলেও উনার স্ত্রীর অসুস্থতায় বিমর্ষ হয়েছেন। জোহরের নামাজে উনার জন্য দোয়া করতে ভুলে গিয়ে মর্মযাতনায় ভুগেছেন, আবার নফল নামাজে বসেছেন।
স্ত্রীর ব্যাপারে বড় শ্যালককে লেখা চিঠিটা যে হেডমাস্টার সাহেব মন থেকে লেখেননি, সেই সুক্ষ্ণ বিষয়টা ইরতাজউদ্দিন বুঝতে পেরেছিলেন এবং সৎ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ওসি সাহেবের স্ত্রীর রান্না খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে তাঁর জন্য এমন সুন্দর দোয়া করলেন যে, তার চোখে পানি এসে গেল। এই স্বল্প পরিচয়েও তিনি তাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন মানুষকে আপন করার ক্ষমতা তাঁর অসীম।
শুধু মানুষের প্রতিই নয়, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি তাঁর ভক্তি, শ্রদ্ধা দেখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মন গলে যায়।
সামান্য ভাত,ডাল আর আলুভর্তা দিয়ে রাতের খাবারের আয়োজন করতে যেয়ে উনিও খুশি; কারণ নবিজী যে দু’টা খেজুর খেয়ে অনেক রাত পার করেছেন। এরমধ্যে আলু তিনটা আবার পচা। তাতে কী, আলহামদুলিল্লাহ বলে রান্নায় লেগে যান। আল্লাহ্পাক শুকুরগুজারি বান্দা পছন্দ করেন – সেই তালিকায় তিনিও থাকতে চান।
আল্লাহপাক অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। তাই তিনি রান্নার জন্য ভিজানো ডাল তুলে আবার শুকাতে দেন।
বোধকরি আল্লাহ্পাকের প্রতি অসম্ভব টান থেকেই তাঁর মনে পাকিস্তানের পতাকাটা জায়গা করে নিয়েছিল অন্য আরো অনেকের মত, বাঙালীর প্রতি বৈষম্যের ইতিহাসটাও সেই পতাকার রং ফিকে করতে পারেনি। তবে পরবর্তীতে আমরা দেখব, পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা তাঁকে বদলে দেয়, তাঁর বুক জুড়ে আঁকা হয়ে যায় লাল-সবুজের পতাকা।
একান্তে দেখা – হেডমাস্টার মনসুর সাহেব
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব এমএ. বিটি. গোল্ড মেডেলিস্ট। এত বিদ্বান একজন লোক, সুদূর পাড়াগাঁয়ের এক স্কুলে পড়ে আছেন, কতটা আদর্শিক দৃঢ়তা থাকলে সেটা সম্ভব, সেটা আমাদের বুঝতে হবে।
অত্যন্ত কড়া স্বভাবের, স্কুল অন্তঃপ্রাণ এই হেডমাস্টারকে একদিনই শুধু হাসতে দেখা গেছে, যেদিন মেট্রিক পরীক্ষায় এই স্কুলের একজন ছাত্র ফোর্থ স্ট্যান্ড করেছিল।
ব্যক্তিগত জীবনটা উনার দুঃখে ভরা, মাথাখারাপ হওয়ায় বাবার কাছে থাকেন উনার স্ত্রী। যখন ভাল থাকে, বাবা পাঠিয়ে দেয় নীলগঞ্জে। ছাত্রদের কাছে ‘অমাবস্যা স্যার’ নামে পরিচিত এই স্যারের চেহারায়ও তখন ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে – স্ত্রীর প্রতি তাঁর ভালবাসাটা কী সুন্দর!
সোহাগী নদীর পাড় ধরে তিনি স্ত্রী নিয়ে হাঁটেন প্রায় প্রতিদিনই। কখনো নববধূর মতো ঘোমটা টেনে লাজুক মেয়ের মত বটগাছের গুঁড়িতে বসে থাকেন হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রী, আর উনি আশেপাশে হাঁটাহাঁটি করেন। বড়ই মধুর এই দৃশ্য ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় হেডমাস্টার সাহেবকে আবারো অমাবস্যা গ্রাস করে।
তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে হেডমাস্টার সাহেবের চিন্তা-ভাবনা বলে দেয়, উনি যথেষ্ট সচেতন একজন মানুষ। একটা মাত্র উক্তিতে সেসময়ের আপামর জনসাধারণের মনের কথাটা উনি প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ
“এক সময় এই পতাকাটাকে নিজের মনে হতো, এখন হয় না ।“
যে কথাগুলো বারবার পড়লেও পুরনো হয় না - এপিগ্রাম
১। বয়োকনিষ্ঠ একজন মানু্ষের কাছ থেকে কঠিন কথা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায় ।
২। গ্রামের মানুষ ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে অহঙ্কার করতে ভালোবাসে।
৩। এক সময় এই পতাকাটাকে নিজের মনে হতো, এখন হয় না ।
৪। নবিজী দু’টা খেজুর খেয়ে অনেক রাত পার করেছেন।
দু’টি কথা
পহেলা মার্চ, ’৭১ – এ আকস্মিক এক ঝড়ে মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরীর ঘর উড়ে যায়, সমগ্র বাঙালী জাতির জীবনে যে প্রচন্ড ঝড় আগামীতে আঘাত হানবে, এ যেন তারই পূর্বাভাস।
শাহেদের গল্পটা নিয়ে আসছি আগামী পর্বে।
চলবে.....
ঢাকা
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:৩০