গতপর্বে “জোছনা ও জননীর গল্প”- এর ভূমিকায় কিছু কথা ছিল, কেউ চাইলে নীচের লিঙ্কে যেয়ে পড়তে পারেন। আজ উপন্যাস শুরুর আগে লেখক "পূর্বকথা"-য় যা বলতে চেয়েছেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করব।
জোছনা ও জননীর গল্প - ভূমিকা (১ম পর্ব)
একটি বিশেষ সময়কে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ ভূখন্ডের মানুষকে নিয়ে যে উপন্যাসের সৃষ্টি, তাকে বুঝতে হলে সেই সময়কে নিয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাকে জানতে হবে, লেখকের মনোজগতের সাথে নিজেকে একাত্ম হতে হবে। হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস শুরুর আগেই “পূর্বকথা”-য় তার আলোকপাত করেছেন।
তেইশটি বসন্ত পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি অনার্স দিয়ে লেকচারার হিসাবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই যোগ দেওয়ার জন্য লেখক অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান, এমনি সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। একজন আদর্শ ভালো ছাত্র হিসেবে বন্ধুহীন লেখক কারো সাথে-পাঁচে নেই- ঊনত্তুরের গণআন্দোলনের তীব্র উত্তেজনাও এই যুবককে ছুঁতে পারেনি। পাবলিক লাইব্রেরী, শরীফ মিয়ার চায়ের ক্যান্টিন, বাংলা একাডেমী – লেখকের একান্ত আপন পরিমন্ডল। সুবোধ বালকের মত সন্ধ্যার আগে আগেই মহসিন হলের বইয়ে ঠাঁসা রুমটায় ঢুঁকে পড়েন, বাইরের তুমুল উত্তেজনার কিছুই তাঁকে স্পর্শ করেনা, উনি বিভোর হয়ে গানের জগতে ডুবে যান- কেন পান্থ এ চঞ্চলতা?
তরুণ লেখকের পরিচিত সাজানো সেই জগত পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল ১৯৭১ সালে। লেখক চমৎকার একটা উপমা দিয়ে সেই সময়টাকে তুলে ধরেছেন, “ছায়াঘেরা শান্ত দিঘির একটা মাছকে হঠাৎ যেন নিয়ে যাওয়া হলো চৈত্রের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া স্থলভূমিতে।“ বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে লেখকের দিনগুলো কাঁটতে লাগল – এমনকি মৃত্যুকে অতি নিকট থেকে তিনি দেখলেন।
সেই সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসও লিখলেন, কিন্তু পুরোসময়টাকে বন্দী করে বিরাট মাপের একটা উপন্যাস লেখার তাড়না হৃদয়ের ভিতর থেকে উপলব্ধি করলেন।
একজন লেখক যখন লেখতে শুরু করে, তখন অনেকটা নিজের জন্যই লেখেন। লেখনীর মাধ্যমে তিনি তাঁর চিন্তাকে অন্যের মাঝে ছড়িয়ে দেন, পাঠক হৃদয়ে একটা জায়গা করে নিতে চান। তারপর একসময় লেখক যখন পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেন, তখন পাঠকের ভালবাসার প্রতিদান দিতে চান, যে দেশের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠেছেন- সেই দেশের জন্য, সেই দেশের মানুষের জন্য, তাঁর মনে একটা দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় তাঁর সেই দায়বদ্ধতার কথা শুনিঃ
“একসময় মনে হলো, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় ধরে রাখার জন্য একটা উপন্যাস লেখা উচিত।মানুষকে যেমন পিতৃঋণ-মাতৃঋণ শোধ করতে হয়, দেশমাতার ঋণও শোধ করতে হয়। একজন লেখক সেই ঋণ শোধ করেন লেখার মাধ্যমে।“
ভোরের কাগজে ধারাবাহিক ভাবে “জোছনা ও জননীর গল্প” নামে উপন্যাসটা ছয়-সাত পর্ব লেখার পর বিরতি। অন্য আরো অনেক কাজের ভীড়ে উপন্যাসটা আর লেখা হয়ে ওঠেনা। হাতে ঢের সময় আছে - এই ভেবে সময় গড়াতে থাকে। তারপর একদিন হঠাত আবিষ্কার করেন, হাতে সময় খুব অল্প – ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য শুয়ে আছেন ট্রলিতে, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। চেতনার পরিচিত জগত থেকে অবচেতনের জগতে, মৃত্যুর দিকে যেতে যেতেও লেখকের সমস্ত মন জুড়ে অসম্পূর্ণ উপন্যাসের জন্য আহাজারি- আবার পৃথিবীতে ফিরে কাজটা সম্পূর্ণ করার জন্য লেখক মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
দেশে ফিরে দুর্বল শরীর নিয়েও উনি লেখা চালিয়ে গেলেন, দেশমাতার ঋণ যে তাকে শোধ করতেই হবে। একদিন তা শেষ হলো, অসীম আনন্দে লেখক আপ্লুত হলেন।
সেই আনন্দের মাঝে তিনি স্মরণ করলেন মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের, যা তাকে প্রভূত সাহায্য করেছে এই কালজয়ী উপন্যাস রচনায়। স্মরণ করলেন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের উপন্যাসের পরিশিষ্টে।
বিশেষভাবে স্মরণ করলেন গুলতেকিনকে, যিনি এই বই প্রকাশের বিশ বছর আগে, তাঁর এক জন্মদিনে পাঁচশ পৃষ্ঠার নীল মলাটের স্পাইরাল বাইন্ডিং করা একটা খাতা লেখককে উপহার দিয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন প্রতিদিন একপাতা করে হলেও যেন উনি মুক্তিযুদ্ধের কথা লেখেন, মুক্তিযুদ্ধের বড় একটা উপন্যাস সৃষ্টি করেন।
নীল মলাটের নীল বেদনা নিয়ে “জোছনা ও জননীর গল্প” মাসুম রহমানের কালো প্রচ্ছদ কভারে নয়মাসের অন্ধকার স্মৃতি ধারণ করে, বিজয়ের মধুর দিনের উজ্জ্বলতা নিয়ে সোনালী ছাপার অক্ষরে খুদিত হয়ে, পাঠকের হাতে এলো ২০০৪ সালের একুশের বইমেলায় অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলামের হাত ধরে।
মহাআনন্দের এই দিনে গুলতেকিন, পরম করুণাময় আল্লাহ ও দেশকে স্মরণ করে তাঁর উক্তিঃ
“সারা জীবনই গুলতেকিনকে অসুখী করেছি। মনে হয় আজ সে খুশি হবে।“
“পরম করুণাময় আমাকে এই গ্রন্থটি লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি জানাচ্ছি আমার অসীম কৃতজ্ঞতা । দল-মত-ধর্ম সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটি সুখী সুন্দর বাংলাদেশের কামনা করে পূর্বকথা শেষ করছি।“
দেশমাতার ঋণ শোধ করে বইটা উৎসর্গ করলেন যথার্থ ব্যক্তিকে, মা ও শহীদ বাবাকে।
চলবে.....
ঢাকা
২২ আগস্ট ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:২০