চলন্ত বেবী ট্যাক্সির ভিতরে হু হু করে বাতাস ঢুঁকছে, বিদ্যুতের মা তার ভিতরের হু হু কান্নাটা নিয়ন্ত্রণ করে নিজেকে স্থির করেন। কান্নাটা তাঁর মনকে হালকা করেছে, প্রশান্ত মনে উনি পরবর্তী কঠিন কাজ গুলোকে মনে মনে সাজিয়ে নেন। ট্যাক্সিওয়ালাকে যা ভাড়া তার চে পঞ্চাশ টাকা বেশী দিলেন - এটা উনার স্বভাবের সাথে যায়না। কারো কাছ থেকে করুণা নিতে যেমন উনি পছন্দ করেননা, তেমনি কাউকে করুণা করারও উনি পক্ষপাতী নন-ভিক্ষুককে শেষ কবে ভিক্ষা দিয়েছেন, তা মনে করতে পারলেননা। রাতের আধো আলোয় মেডিকেলের গেটের দিকে এগোতে এগোতে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভিক্ষুকদের দিলেন। করুণা, সাহায্য- আজ একজনের একটু করুণা, সাহায্য উনার বড় প্রয়োজন।
হাসপাতালের বেডে ছেলের মুখটা দেখে উনি অবাক হয়ে গেলেন-মনে হলো গভীর ঘুমে মগ্ন, শরীরে কোথাও আঘাতের লেশমাত্র নেই, নেই কোন রক্তের দাগ। তরুণ ডিউটি ডাক্তার উনাকে জানালেন যে, পেটের ভিতরে খুব সম্ভব রক্তপাত হচ্ছে, তাই রোগী অজ্ঞান। উনি একজন শিক্ষক পরিচয় দিতেই ডাক্তার ছেলেটা উনাকে ডাক্তারদের বসার রুমে নিয়ে গেলেন। টেবিলের উপর টেলিফোনটা দেখে একজনকে ফোন করে দুঃসংবাদটা জানানোর জন্য খালাম্মার মনটা অস্থির হয়ে ওঠল। কি বলে টেলিফোনটা করার জন্য ছেলেটাকে অনুরোধ করবেন ভাবছেন, তখন ছেলেটাই বিষয়টা সহজ করে দিলঃ
- আপা, আপনার বাসার সবাই খবরটা জানে?
- না বাবা, আমি ফোন পেয়ে ছুটে এসেছি, কাউকে এখনো জানানো হয়নি। কয়েকটা ফোন করা দরকার।
- এই ফোন থেকে ফোন করুন, এই ফাঁকে আমি রোগীদের একটু দেখে আসি।
খালাম্মা ব্যাগের ভিতর থেকে ছোট্ট টেলিফোন ইনডেক্সটা বের করে বিদ্যুতের বাবার বাসার নম্বরটা বের করেন। একদিন উনিই নম্বরটা দিয়েছিলেন, খালাম্মা রাখতে চাননি - কি হবে রেখে? তখন খুব মৃদুস্বরে উনি বললেনঃ
- জানি এটা তোমার কাছে অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু ছেলে-মেয়ে বড় হচ্ছে, ওরা তো ওদের বাবার সাথে কথা বলতে চাইতে পারে।
খালাম্মা কারো উপর জোর করতে চাননা, নম্বরটা দু'ভাইবোনকে দিয়েছিলেন। আর মনে মনে আশা করেছিলেন, ওরা ফোন করবেনা।
কিন্তু বন্যা প্রায়ই উনার সামনেই বাবার সাথে আলাপ করে। বিদ্যুতও উনার চোখের আড়ালে ফোন করে- ও মাকে দুঃখ দিতে চায়না।
শত দ্বিধা ঝেড়ে ডায়াল করেন, ক্রিং-ক্রিং-ক্রিং - যেন কতকাল বেজে চলেছে,
-হ্যালো, ওপাশ থেকে বাচ্চা একটা মেয়ের গলা ভেসে এলো।
কি বলবেন ভাবতে ভাবতেই আবারও
-হ্যালো, কে ?
-আমি, বিদ্যুতের মা বলছি।
-ও অ্যান্টি, ভাইয়াকে একটু দাও না - একটু আব্দারের সুর।
-কেন?
-বাহ্, ভাইয়া সেদিন এত সুন্দর ডিবেট করলো, আমার খুব ইচ্ছে করছে কথা বলতে।
আর কি কোন দিন আমার বিদ্যুৎ, তোমার ভাইয়া ডিবেট করতে পারবে? কথাটা ভেবে গলার কাছে কি যেন একটা দলা বাঁধে।
উনার নীরবতায় ওপাশ থেকে কচিকন্ঠে অস্থিরতা ঝরে,
-অ্যান্টি, কথা বলছোনা কেন?
নিজেকে সামলে নিয়ে কথাগুলো বলতে যেয়ে উনার গলা কেঁপে গেলঃ
-তোমার ভাইয়া তো তোমার সাথে এখন কথা বলতে পারবেনা, অ্যাক্সিডেন্ট করে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
-কি, বলে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে রিসিভারটা টেবিলের উপর রেখে ছোট্ট মেয়েটা ছুটে গেল।
খালাম্মার মনে হলো, কয়েক শতাব্দী পর ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে এলোঃ
-হ্যালো।
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও খালাম্মা ব্যর্থ হলেন, কোথায় ছিল এত কান্না, একটা ফোঁপানো কান্নার আওয়াজ ওপর প্রান্তের লোকটাকে বিরাট বিপদের আশংকায় অস্থির করে তুললো।
-কি হয়েছে, তুমি কোথায়।
-বিদ্যুৎ অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, আমরা ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সীতে।
খুব শান্তভাবে ডাক্তার বললেনঃ
-আমি আসছি।
খালাম্মার মনে হলো, কেউ যেন উনার সমস্ত শক্তি কেড়ে নিয়েছে; উনি চেয়ারে পুরোপুরি হেলান দিয়ে রুমের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ডিউটি ডাক্তার ছেলেটা কখন রুমে ফিরেছে উনি টের পাননি, একজন রোগীর এটেন্ডেন্স ডাক্তারকে ডাকতে এসেছে - তার রোগীর অবস্থা খুব খারাপ, ছেলেটা আবার রোগী দেখতে গেল। প্রতিটি মূহুর্ত খালাম্মার কাছে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টেলিফোনটা নিয়ে এবার ছোট বোনকে ফোন করে নিজেকে দৃঢ় রেখে দুঃসংবাদটা দিলেন এবং বাসায় গিয়ে বন্যাকে আজকের রাতের জন্য সংগ দিতে বললেন। ছোট বোনটাকে ফোন করলে সহজে ছাড়তে চায়না, ও কথা বলতে খুব ভালবাসে - আজ তার ব্যতিক্রম হলো।
কখন যে বিদ্যুতের বাবা আর ডিউটি ডাক্তার ঘরে প্রবেশ করেছে, খালাম্মা টের পাননি-আজ উনি বেশ অন্যমনস্ক। ছেলেটার কথায় সম্বিত ফেরেঃ
-আপা, স্যার যে আপনার স্বামী, সেটা আমাকে বলবেননা?
-না, মানে .. বলে উনি ইতস্তত করতে থাকেন।
মনে মনে বলেন, বাবা, পরিচয় কেন দেই না, সে তো আমি জানি।
খালু উনাকে এই অস্বস্তি থেকে রেহাই দিতে বলেনঃ
-আসলে ও কাউকে ব্যতিব্যস্ত করতে চায়না, তাই ..।
-স্যার, ঠিক বলেছেন।
খালাম্মা প্রসংগ পাল্টানঃ
-ও কে দেখেছ?
-হ্যা।
-কেমন দেখলে?
একটা চেয়ারে আস্তে পরে বসেন ডাক্তার সাহেব, চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ ভাবেন, কি জবাব দেবেন বুঝতে পারছেননা।
একটা অস্বস্তিকর নীরবতা সমস্ত ঘরময়।
নিজেই নীরবতা ভাঙ্গেনঃ
-ভাল না। তবে এখন থেকেই সবরকম চেষ্টা করতে হবে।
ডিউটি ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ
-ওর জন্য দুই ব্যাগ রক্ত যোগাড় করা যায়?
যদিও উনি নিজেই এখন ঢাকা মেডিকেলের সার্জন হিসাবে আছেন, তাও অন্য ডাক্তারের দায়িত্বে নাক গলাতে চাননা।
-জ্বি স্যার, আমি সন্ধানীর মাধ্যমে এখনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
-ধন্যবাদ ডাক্তার।
তারপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ
-তুমি ইচ্ছে করলে আমার রুমে বসতে পার?
-না, আমি বিদ্যুতের কাছাকাছি থাকতে চাই।
-কিন্তু এখানে সারারাত বসে থাকলে তো তুমিই অসুস্থ হয়ে যাবে। দেখি বিদ্যুতের জন্য একটা রুমের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
বলে উনি উঠে দাঁড়ালেন।
সাদা ধবধবে বিছানায় অচেতন বিদ্যুৎ শুয়ে আছে, পাশেই একটা স্টান্ডে রক্তের ব্যাগটা ঝুলছে, একটা চেয়ারে বসে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়া রক্তের দিকে সম্মোহিতের মত খালাম্মা তাকিয়ে আছে-তাঁর ছেলের জীবন প্রতিটা ফোঁটার সাথে মিশে আছে। ডাক্তার সাহেবও একটা চেয়ারে বসে আছেন। নানা চিন্তা উনার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছেঃ এই ব্যাগটা শেষ হলে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া পূর্ণ হবে। কিন্তু ছেলের প্রেশার এখনো খুব কম, পালস অত্যন্ত দ্রুত চলছে- রোগীর কোন লক্ষণই ভাল নয়। আজ রাতের মধ্যেই একটা অপারেশন করে ইন্টারনাল রক্তপাতটা বন্ধ করা না গেলে ছেলেকে বাঁচানো যাবেনা।কিন্তু এত রাতে এত গুরুতর একটা রোগীকে মেডিকেলের কোন ডাক্তার অপারেশন করতে চাচ্ছেননা। তাহলে উপায়? আমি বাবা, গুরু দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হবে। তার আগে ওর মার সাথে একবার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করা প্রয়োজন। ছেলের মার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সাহেবের মায়া হলো, চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর কাঁধে হাত রাখল, ঘাড় বাঁকা করে চশমার আড়াল থেকে অসহায় দু'টি চোখ ডাক্তার সাহেবকে দেখছে।
কিভাবে কথাটা শুরু করবেন বুঝতে পারছেননা, নিজের ছেলের প্রতি যে অধিকার, একদিন নিজেই তা হারিয়েছেন। কিন্তু ভালবাসাটা তো হারিয়ে যায়নি। অব্যক্ত ব্যথায় মনটা কেঁদে ওঠে, কিন্তু তাঁর চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুও গড়ায়না, হৃদয়টা দুমড়ো-মুচড়ো একাকার হয়ে যায়। খালাম্মাই নীরবতা ভাঙ্গেনঃ
-কিছু বলবে?
-আজ রাতেই বিদ্যুতের একটা অপারেশন করতে হবে, না হলে ওকে বাঁচানো যাবেনা।
-ঠিক আছে, ব্যবস্থা কর।
- আমি বেশ কয়েকজন ডাক্তারের সাথে আলাপ করেছি, তারা অপারেশনটা আগামীকাল করতে চায়।
-তা হলে আমার ছেলের কী হবে?
-আমি যদি করি, তোমার আপত্তি আছে?
উনি চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে দু'হাত দিয়ে ডাক্তার সাহেবের ডানহাতটা চেপে ধরলেন, একটা কৃতজ্ঞতাবোধ উনার দু'চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠের একটি 'না' উচ্চারণ ডাক্তার সাহেবকে তার পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে দিল।
স্নায়ুর চাপটা এমনভাবে কোন অপারেশনের আগে ডাক্তার সাহেব অনুভব করেননি। কারণ তাদের কোন স্মৃতি তার কাছে ছিলনা। আর নিজের ছোট্ট শিশুর তোয়ালে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট শরীর; মায়াময় ছোট্ট ছোট্ট হাত, পা, আঙুল; মনকাড়া হাসি থেকে শুরু করে এলোমেলো পায়ে হাঁটাহাটি, আধোআধো বোল - সমস্ত স্মৃতিরা ফিরে এসে ডাক্তারকে অসহায় করে তুলছে। উনি বুঝতে পারছেন, এভাবে আবেগী মন নিয়ে অপারেশন করলে বড় ধরণের অঘটন ঘটতে পারে। তৎক্ষনাত উনার মনে স্ত্রীর করুণ মুখটা ভেসে ওঠল, জীবনে যাকে কিছু দিতে পারেননি, দুঃখ ছাড়া। আজ তার প্রিয় পুত্রকে তার কোলে ফিরিয়ে দিতে পারলে সে কত খুশি হবে, হয়ত তার সব অন্যায়গুলো ক্ষমাও করে দিতে পারে। ছেলের স্মৃতিটাকে মন থেকে মুছে ফেলে স্ত্রীর করুণ মুখটা স্মরণ করতে করতে ডাক্তার দৃঢ় পায়ে অপারেশন রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলো, ওখানে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে একজন অসহায় মা আর ভিতরে জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন সন্তান।
খালাম্মা স্বামীকে আসতে দেখলেন লম্বা করিডোর দিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে, কিন্তু উনার সামনে গেলেননা-উনার চিত্ত অস্থির হয়ে ওঠুক, এমন কিছু উনি করতে চাননা।
অপারেশন টেবিলে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ডাক্তার সাহেব, সাথে দুই সহকারী। কোথা দিয়ে তিন ঘন্টা কেঁটে গেল উনি টের পাননি। আর রুমের বাইরে আর এক জনের সময় যেন কাঁটতেই চায়না। ফজরের আজানের সময় বুঝলেন পৃথিবীতে আবার ভোর আসছে, আলো আসছে - উনার জীবনে আলোর দেখা পাবেন কিনা জানেননা।
কিছুক্ষণ পরে অপারেশন রুম থেকে মুখঢাকা স্বামীকে বেরিয়ে আসতে দেখলেন, য্ন্ত্রচালিতের মত ওর দিকে এগিয়ে গেলেন। অসম্ভব একটা আকুতি নিয়ে উনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ও এগিয়ে এসে ওর হাত ধরল, মুখের আবরণটা অন্য হাত দিয়ে খুলে ফেলল, কি বলবে বুঝতে পারছেননা, অসংখ্যবার অসংখ্য সান্ত্বনার বাণী শোনানো ডাক্তার আজ নীরব। পিছন থেকে কখন যেন ওর সহকারী দু'জন এসে হাজির, স্যারের অবস্থা বুঝতে পেরে একজন পেশাদার ডাক্তারের মত বলে ওঠেঃ
-ভাবী, অপারেশন সফল হয়েছে কিন্তু ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা।
ঢাকা
২৬ মে ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৬ দুপুর ১২:০০