সাদা টয়োটা গাড়িটা মাঠের এক কোণে পার্ক করে চশমা পড়া দীর্ঘদেহী সুঠাম গড়নের ডাক্তার ভ্দ্রলোক মাটির দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। বিকেলের এই সময়টায় মাঠের কোথাও হয়ত আমরা খেলছি বা গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছি। নিজের বাবাকে দেখেও বিদ্যুৎ না দেখার ভান করত। ওই বয়সের অন্যকোন ছেলে হলে নিশ্চিত দৌড়াতে দৌড়াতে বাবার পিছু নিত, হাঁপাতে হাঁপাতে "বাবা, বাবা" বলে ডাকতে ডাকতে হাতটা জড়িয়ে ধরত্।বিদ্যুতের বেলায় তেমন কিছু ঘটতনা।
শুধু বিদ্যুৎ নয়, ওর মা, ছোট বোন বন্যা-সবাই ছিল পাড়ার আর দশটা পরিবার থেকে ভিন্ন। আমাদের প্রায় সকলের বাসাতেই মায়েদের সাংসারিক কাজের সহযোগিতার জন্য ছুটা বুয়া ছিল, মেয়েরাও মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করত। কিন্তু ওদের একটা সার্বক্ষণিক বুয়া লাগত। কারণ সকালে উনি বন্যাকে নিয়ে ধানমন্ডি ৮ নম্বর ব্রিজের দিকে হাঁটা দিতেন, সাথে থাকত কামরুন্নেসা স্কুলের এই পাড়ার ছাত্রীরা। আর বিদ্যুৎকে রিকশা ঠিক করে দিতেন আসাদগেটের-মন্তব্য সেন্ট যোসেফ। বাসায় রেখে আসতেন কাজের বুয়াকে।তখন তো আজকের মতো সুপারশপ ছিল না, নিউ মার্কেট থেকে রিকশায় বাজার নিয়ে ফিরতেন-নিজেই বাজারের ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় ওঠতেন। সংসার-বাহির, সব এক হাতে খালাম্মাকেই সামাল দিতে হতো। তারপরও ছেলে-মেয়ের প্রতি উনার কত নজর! বিদ্যুৎ-বন্যা, দু'জনই গান শিখত। ছুটির দিন সকালে গলা সাধত্। আমাদের বাসা থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। কারণ ওদের বাসা ছিল প্রথম গেটের তিনতলার পূর্বপাশে আর আমরা ছিলাম দ্বিতীয় গেটের তিনতলার পশ্চিম পাশে অর্থাৎ পাশাপাশি বাসা, দখিনের জানালা দিয়ে দু'জনই দেখতে পেতাম সামনের মাঠ,
মিরপুর রোড। কেউ কাউকে দেখতে পেতাম না, কিন্তু ওদের গান শুনতে পেতাম।
গান থেকে আবার মাঠে ফিরি। বিদ্যুতের বাবা আসার ১৫-২০ মিনিট পরে ওদের বুয়াটা আসত ওকে ডাকতে, খুশু ভাইকে বলে ও চলে যেত্। নিয়ন্ত্রিত আবেগের এমন ছেলের মা স্বাভাবিক ভাবেই নিজের আবেগকে রাশ টানতে জানেন। সুতরাং উনার সম্বন্ধে অনেকের জানার আগ্রহ থাকলেও কেউই তেমন কিছু জানতনা। আমাদের পরের গেটের নীচতলায় রতন-মামুনদের বাসায় উনার কিছুটা যাতায়াত ছিল। রতন ভাইকে উনি খুব পছন্দ করতেন। কারণ রতন ভাই খুব ভ্দ্র ছিলেন এবং বেশ পড়ুয়া ও ভাল ছাত্র ছিলেন। আমার চার ক্লাস উপরে পড়তেন, আর উনার ছোট ভাই মামুন আমার সহপাঠী ছিল। খুশু ভাইরা রতন ভাইদের উপরে দোতলায় থাকত, ক্লাসেও উনি রতন ভাইয়ের কয়েক ক্লাস উপরে ছিলেন। বিদ্যুৎ আমার দুই ক্লাস উপরে পড়লেও ওকে তুমি করেই বলতাম, পাড়ায় দুই ক্লাসের আগে-পরের সবাই সবাইকে 'তুমি' বলেই সম্বোধন করত। খুশু ভাই, রতন ভাইরা একই গেটের উপর-নীচে থাকতেন, খালাম্মা রতনদের বাসায় যেতেন কিন্তু তার আর এক পছন্দের পাত্র খুশু ভাইয়ের বাসায় যেতেননা, এর পিছনে কিছু কারণ ছিল-অন্য একদিন তা বলব।
উপরের ক্লাসে ওঠার সাথে সাথে পড়ার চাপ বাড়ে।যারা সিরিয়াস ছাত্র, তারা আস্তে আস্তে নিজেদের গুটিয়ে নেয় ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরে, পড়ার টেবিলটা হয়ে ওঠে পরম সঙ্গী। বিদ্যুতের বেলায়ও তেমনটাই ঘটল। তাই যোগাযোগটাও কিছুটা কমে আসলো, আমি আগের মতই আছি - মাঠে না নামলে কিছুই ভাললাগেনা। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বিদ্যুৎ নটরডেম কলেজে ভর্তি হলো। অনেক কথার ভীড়ে একটা কথা বলা হয়নি, বিদ্যুৎ-বন্যা দু'জনেই গানের রেওয়াজ বন্ধ করে দিয়েছে, বোধ হয় বুঝতে পেরেছে চেষ্টায় সবকিছু হয়না, গানের জন্য প্রকৃতিদত্ত কিছু লাগে। অনেক দিন হয়ে গেল, গান আর শুনিনা। কিন্তু একদিন হঠাত শুনি বিদ্যুৎ জোরে জোরে কি যেন বলছে। পরে খবর পেলাম, নটরডেম ডিবেটিং ক্লাবের ও সদস্য, বিটিভিতে ওদের দল লড়বে। তাই প্রস্তুতি হিসাবে বাসার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করে।চ্যানেল বলতে তো তখন শুধু বিটিভি। কবে, কখন বিটিভিতে কি বিতর্ক শুনেছি ও দেখেছি তা মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে, বেশ কয়েকটা দলকে হারিয়ে নটরডেম কলেজ ফাইনালে ওঠে এবং প্রতিটিতেই মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ফর্সা লম্বা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ছেলেটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফাইনালে বিজয়ী হয়ে বিদ্যুৎ ভাইয়েরা আন্তঃকলেজ চ্যাম্পিয়ন হয় সারাদেশে। এই বিশাল কৃতিত্বে আমরাও খুব গর্ব অনুভব করতাম। তারপর থেকে খালাম্মার সাথে দেখা হলে সালাম দিলে উনি হাসিমুখে কথা বলতেন, পড়া-লেখা কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতেন। সন্তানের সফলতা মাকেই তো সবচে বেশী আনন্দ দেয়।
বিদ্যুৎ বাসেই কলেজে আসা-যাওয়া করত। যেদিন প্রাকটিক্যাল ক্লাস থাকত সেদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যেত বাসায় ফিরতে। সেদিনও প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছিল। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ, খালাম্মা টিভি দেখছে, বন্যা পড়ছে। কিন্তু উনার কোন কিছুতেই যেন মন বসছে না। এমন সময় ক্রিং ক্রিং করে টেলিফোনটা বেজে ওঠলো। উনি ধরলেন, ওপাশ থেকে একটা ছেলে উনাকে দুঃসংবাদটা দিল - বাসে ঝুলছিল বিদ্যুৎ, হাত ফঁসকে পড়ে যায়, পিছনের দুই চাকা ওর পেটের ওপর দিয়ে চলে যায়। আশপাশের লোকজন দৌঁড়ে আসে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ও জ্ঞান হারায়, জ্ঞান হারাবার আগে বাসার টেলফোন নাম্বারটা বলে যায়। সেখান থেকে কয়েকজন যুবক একটা বেবী ট্যাক্সি করে ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সীতে নিয়ে আসে। উনি টেলিফোনটা রেখে ধপাস করে বসে পড়েন, বন্যা পড়া ফেলে মার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। মার এই অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, "কি হয়েছে মা?"
মেয়ের কথায় উনার সম্বিত ফেরে, মেয়েকে দ্রুত সংক্ষেপে দুঃসংবাদটা জানিয়ে বুয়ার কাছে মেয়েকে রেখে দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচে আসেন। রাস্তা দিয়ে একটা বেবী ট্যাক্সি যাচ্ছিল। উনি ওটাকে থামিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে যেতে বলেন। ট্যাক্সি চলছে, খালাম্মা ছেলের মুখটা চিন্তা করে স্থির থাকতে পারলেননা- বুকের ভিতর থেকে হু হু করে বহুদিনের জমে থাকা বহু কান্না চাপা কান্নায় রূপ নিল।
মধ্যবয়স্ক ট্যাক্সি চালক পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, "কি হইছে আপা?"
কথাটা শুনে অসহায় মায়ের ফোঁপানো কান্না আরও বেড়ে গেল।
চালক সামনের দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে স্পীড বাড়িয়ে ভট-ভট-ভট শব্দে রাস্তা কাপিয়ে ছুটে চলল।
সেই ভট-ভট-ভট শব্দে চাপা কান্নার শব্দটা চাপা পড়ে গেল। কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে অচেতন একটা ছেলের কানে এই বিকট ভট-ভট-ভট শব্দ ছাঁপিয়ে এক মায়ের চাপা কান্নার আওয়াজ পৌঁছে গেল।
ঢাকা
১৪ মে ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত