প্রাতঃভ্রমণ, ধানমন্ডি লেক, পরমায়ু সংঘ - সব মিলিয়ে নিকট অতীতের যে সুর প্রাণে বাজে, তার উৎস কিন্তু দূ-----র দূ-----র অতীতে লুকিয়ে আছে। আজ সেই দূ-----র দূ-----র অতীতের স্মৃতিগুলো যেন স্বচ্ছ কাঁচের অ্যাকুরিয়ামের ভিতরের নানা বর্ণের মাছেদের মত আমার অতি কাছের। অতি কাছের, অতি প্রিয় সেই স্মৃতিতে আজ জায়গা করে নিয়েছে কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টার, খেলার সাথীরা এবং আমার ও সাথীদের প্রাণপ্রিয় খুশু ভাই।
তখন ১২ টা বিল্ডিং নিয়ে গড়ে উঠেছিল সরকারি এই কলোনী (এখন আরো কিছু যোগ হয়েছে) - আমরা থাকতাম মিরপুর রোডের পাশে ২ নং বিল্ডিংয়ে, এবং বাসার সামনে, দক্ষিণে ছিল সুন্দর মাঠ (এখনো আছে)। শীতকালে টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট, বছরের অন্য সময়ে ফুটবল এবং আরো অনেক খেলার আয়োজনের যিনি মধ্যমণি তিনি আমাদের খুশু ভাই। খেলার সরঞ্জাম কেনার জন্য তখন সিঁকি (২৫ পয়সা), আধুলি (৫০ পয়সা), টাকা - যে যার সামর্থ্য মত দিত - স্বল্প আয়ের বাবাদের সন্তানদের শখের খেলা-ধূলার আয়োজনটা বেশ কষ্টের ছিল। সব টাকা-পয়সা জমা থাকত খুশু ভাইয়ের কাছে। খুশু ভাইয়ের বাবার আয় ভালই ছিল (আজ মনে হয়), সকলের চাঁদা দিয়েও যখন আরাধ্য খেলার বস্তুটা কেনার মত টাকা হতো না, তখন বাকীটা উনি দিয়ে দিতেন। তারপর কোন এক বিকেলে একদল বালককে সাথে নিয়ে এক কিশোর রওনা হত শুক্রাবাদের দিকে। এখন যেখানে নিউমডেল ডিগ্রি কলেজ, সেখানে ওকিস স্পোর্টস নামে একটা খেলার সরঞ্জাম বিক্রির দোকান ছিল। দল বেঁধে আনন্দের সাথে, মনে করি একটা ফুটবল কিনে আনলাম। তারপর মনের আনন্দে তাতে লাথি। কিন্তু সেই আনন্দ বেশী দিন স্থায়ী হতো না। কারণ তখনকার বলের উপরে থাকত চামড়া আর ভিতরে টিউবের ব্লাডার। বলের মুখে কিছুটা জায়গা ফাঁকা থাকত, ব্লাডারটা সেই মুখ দিয়ে ভিতরে ঢুঁকিয়ে পাম্প করে বলের সাইজে আনা হতো এবং মুখটা ফিতা দিয়ে ভাল করে বেঁধে দেওয়া হতো।
কয়েকদিন পরেই ব্লাডারের বাতাস কমে যেত, আর সেটাকে পাম্প করার জন্য রিকশার দোকানে যেতে হতো-বাতাস করার পয়সা কে দিবে, এনিয়ে ঝামেলা হত। আর বর্ষা কাল আসলে তো আরও মুশকিল, বলে পানি ঢুঁকে গোল বল অচিরেই নারিকেলের আকার ধারণ করত - একদিকে শট নিলে অন্যদিকে চলে যেত। এত সব অসুবিধার পরও কিন্তু বলে লাথি দিয়ে বালকেরা আনন্দে আত্মহারা থাকত। কিন্তু সেই আনন্দও কোন এক বিকেলে লিক হওয়া ব্লাডারের মত চুপসে যেত যখন বলে অনেকক্ষণ পাম্প দেওয়ার পরও বলটা চুপসে থাকত। অতঃপর রিকশার মিস্ত্রী ব্লাডারটা পানিতে চুঁবিয়ে আবিষ্কার করত যে ব্লাডার ছিদ্র হয়ে গেছে। এবার তাতে তালি দেও, তালি দেওয়ার টাকা-পয়সার ব্যবস্থা কর। কিন্তু তালি দিয়ে আর কয়দিন, আবার একই সমস্যা - এবার অন্য জায়গায় তালি, ব্লাডার বেচারার প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর উপরের চামড়া বাবাজীরও দফা-রফা, সূতোর সেলাই ছিঁড়ে বল হা হয়ে যায়, রৌদ-বৃষ্টিতে ভিজে বেচারার রং চেনা দায়। অচিরেই আবার চাঁদা তুলে নতুন বল কেনার চেষ্টা চলতে থাকে।
কিন্তু বলহীন সেই বিকেলগুলো যেন আর কাঁটতেই চাইত না। তাই সেই সময়টায় খুশু ভাই আমাদের অন্যভাবে ব্যস্ত রাখতেন। উনি সেই বয়সেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন এবং উনার ক্কেরাত অত্যন্ত মধুর ছিল। উনি আমাদের নিয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন, মসজিদ ছিল ১০ নং-এ (এখনো আছে)। কলোনীর অভিভাবকরাও তাই উনাকে খুব ভালবাসতেন, উনার সাথে আছে শুনলে অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। কলোনীর মসজিদে বালকের দল উনার সাথে নামাজ আদায় করে, সেই সাথে যুক্ত হয় কিছু দুষ্টুমি। সবাই রুকুতে গেছে, আমাদের বালক দলের কোন এক সুবোধ বালক তার পাশের জনকে দিল ধাক্কা, সে দিল তার পাশের জনকে, হুটোপুটি লেগে গেল, সেই সাথে বালকদের চাপা হাসি, মৃদু কথাবার্তা। নামাজ শেষ হতেই মুরুব্বীরা তোড়ে আসতেন, বেয়াদব কোথাকার, নামাজের মধ্যে, .........।
খুশু ভাই লজ্জায় মরে যেতেন, ২ নং বিল্ডিংয়ের মাঠে নিয়ে লাগাতেন কঠিন ঝাড়ি। সবাই মাথা নত করে উনার শাসন হজম করতাম।
কি আর করা, আপাততঃ মসজিদে দল বেঁধে যাওয়া বন্ধ। বিকেলে মাঠে গোল হয়ে খুশু ভাইয়ের চারিদিক ঘিরে বসি আমি,ফরহাদি (খুশু ভাইয়ের ছোট ভাই),কচি, সজল(কচির ছোট ভাই), খোকন,বল্টু, ...... । খুশু ভাই বলেন, "তোরা যদি আর দুষ্টামি না করিস তবে তোদের এক জায়গায় নিয়ে যাব নামাজ পড়তে"। সবাই সমস্বরে জানালাম "আমরা আর দুষ্টামি করব না"। উনি তখন বল্লেন, "আগামীকাল থেকে আমরা ধানমন্ডি লেকের পাড়ের মসজিদে নামাজ পড়তে যাব"। সবাই খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম।
লেক পাড়ের সেই সব স্মৃতি নিয়ে আগামী পর্বে হাজির হবার আশা রাখি, যদি আল্লাহ ইচ্ছে করেন।
৭ মে ২০১৬
ঢাকা
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৪