মাহতাবের ঘুম ভেঙ্গে গেছে, পাশেই আবছা অন্ধকারে এক পাশ ফিরে শোওয়া আফতাব ভাইয়ের পিছন দিকটা দেখতে পাচ্ছে।কয়টা বাজে? আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে টেবিলের কাছে যায়, দু’দিন আগে নিউমার্কেট থেকে কেনা হাতঘড়িটা হাতে নেয়-কাল বেল্টের সাদা ডায়ালের সস্তা ঘড়িটা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে ওকে সময় জানাতে পারে না। তবুও প্রিয় জিনিসটা হাতে নিয়ে ও চেয়ারে বসে, ওটার গায়ে হাত বুলায়-আজ এসএসসি পরীক্ষার হলে ওকে সময় জানাবে এই হাতঘড়িটা। ফজরের আজানের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় মাহতাব, দ্রুত ঘড়িটা টেবিলে রেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানার দিকে যেতে টেবিলের সাথে পা আটকে শব্দ হয়, পাশের ঘর থেকে বাবার গলা শোনা যায়-কে?
-আমি, বাবা।
বাবার ঘুম খুব হালকা।
প্রতিদিন ভোরে মাহতাব ঘুম ভাঙ্গলেও চুপ করে বিছানায় ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে, বাবা হালকা করে ওর গায়ে হাত দিয়ে ডাকে, মার ডাকটা ও স্মরণ করতে পারে না-বাবার এই ডাকটা তাই ওর খুব প্রিয়।
আজ আর তা হলো না।
প্রতিদিনের রুটিন মাফিক বাবা মসজিদের যায়, মাহতাব ঘরেই নামাজ পড়ে, কোরআন শরীফ পড়ে।
টানাপোড়নের মধ্যবিত্তের সংসারে সবাই ব্যস্ত থাকে, কেউ চাকুরিতে বের হবে, কেউ কলেজে । মাহতাবের পরীক্ষারে হলে যাওয়ার মত ফুরসত কারো নেই। ১০ টায় পরীক্ষা শুরু হবে, ৮ টায় ও বের হবার জন্য তৈরী হয়, হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে ৬ টা বেজে বন্ধ হয়ে আছে। বাবার অফিস ৮ টায়, উনি ৭ টায় চলে গেছেন। আফতাব ভাইকে ও ঘড়িটা দেখায়, উনি চেষ্টা করেন, ঠিক হয় না। বড় আপা, মেজ আপাকে আফতাব ঘটনা জানায়। হলে ঠিক সময়ে পৌঁছানোটা জরুরি। তাই মাহতাব মন খারাপ করে ঘড়ি ছাড়াই বের হয়।
হলে পৌঁছে যায় সাড়ে আটটায়। মুকিত,মাহবুব,মামুন,মঞ্জু,লৎফর – আরো অনেক সহপাঠী, সবার সাথেই কেউ না কেউ এসেছে। মাহতাবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। সবার হাতের দিকে ওর দৃষ্টিটা বার বার ঘুরে ফিরছে, কার হাতঘড়ি কেমন তাই দেখে ফিরছে। উচ্ছ্বল কিশোরদের পদচারণায় মুখরিত স্কুল প্রাঙ্গণটা মাহতাবের খুব ভাল লাগছে, শুধু কিসের যেন একটা অভাব ওর মনে ছায়া ফেলে।
পরীক্ষা শুরুর আধা ঘন্টা আগে শিক্ষকরা সকল অভিভাবককে স্কুল গেটের বাইরে চলে যেতে বললেন। সবাই যে যার সিটে বসে আছে। এমন সময় শ্রেণী কক্ষের দরজা দিয়ে সাদা পায়জাম পাঞ্জাবি পরিহিত শুভ্র দাঁড়ির বাবাকে দেখে মাহতাবের বিস্ময়ের সীমা থাকে না। ওর কাছে এসে নিজের বড় হাতঘড়িটা ওকে দেয়। আশে পাশের উৎসুক সহপাঠীদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ও তাড়াতাড়ি ঘড়িটা বাম হাতে পড়ে নেয়, ওটা ওর হাতের কব্জিতে ঢল ঢল করে ঝুলে থাকে। শিক্ষক বাবাকে হল ছাড়তে বলেন। মাহতাবের ছোট্ট মনে প্রশ্নটা থেকেই যায়, কেমন করে উনি হাতঘড়িটার বিগড়ে যাওয়ার খবর পেলেন?
বাংলা ১ম পত্র শেষ হলো ১ টায়, ২ টায় ২য় পত্র। মাহতাবের পরীক্ষা ভালই হয়েছে। সবাই হল থেকে বেরিয়ে স্কুলের মাঠের দিকে যাচ্ছে পরম আগ্রহ নিয়ে, ওখানে ওদের জন্য খাবার নিয়ে কেউ না কেউ অপেক্ষা করছে। মাহতাবের তাড়া নেই, ছোট্ট একটা টিফিন বক্সে দু’টা রুটি আর ডিম দিয়েছে বাসা থেকে, তাই খেয়ে নেবে। অবশ্য পরীক্ষার মধ্যে ডিম খাওয়া নিয়ে বাসায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও মাহতাব ওসব কুসংস্কার মানে না। হাতঘড়িটা ওর হাতে কেমন বেখাপ্পা লাগছে, ও ঘড়িটা পকেটে নেয়।
মাঠের এক কোণে, সবার দৃষ্টি থেকে একটু দূরে সরে কুন্ঠিত মাহতাব তার সামান্য খাদ্যটা নিয়ে বসে।মাথায় একটা পরিচিত হাতের ছোঁয়া পেয়ে ও উপরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়,আনন্দে বিমূঢ় হয়ে যায়-সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পড়া বাবা, হাতে একটা ডাব। বাবা ওর মুখোমুখি বসে। জানতে চায়-
-পরীক্ষা ভাল হয়েছে?
মাহতাব কিছু একটা বলতে যেয়ে অনুভব করে গলার কাছে কি যেন একটা আটকে আছে।
বাবা আবার জিজ্ঞেস করে
-পরীক্ষা ভাল হয়নি?
কান্না মেশানো একটা হাসি দিয়ে মাহতাব জোরে জোরে মাথাটা এদিক ওদিক করে জানাতে চায় যে ওর পরীক্ষা ভালই হয়েছে।
মোঃ শামছুল ইসলাম
ঢাকা
০৬ মার্চ ২০১৬
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১:৪১