১
১৯৯৩ সাল । তখন দাবা বলতে মানুষ কাসপরভকেই বুঝতো । ফিদে’র (দাবার বিশ্বসংস্থা) আয় রোজগারও বেশিরভাগ আসতো কাসপরভের অংশ নেওয়া টুর্নামেন্ট থেকেই । আর তার ব্যক্তিগত স্পন্সরেরও অভাব ছিলো না । বোধহয় সে কারনেই হঠকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি । সেবারের বিশ্বদাবা চ্যাম্পিয়নশিপে কাসপরভের মুখোমুখি হওয়ার কথা ববি ফিশারের । ফিদে তাদের নিয়মনীতির ব্যাতয় ঘটিয়ে তড়িঘড়ি চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করলো ম্যানচেস্টারে । অপ্রস্তুত ববি ফিশার যোগাযোগ করলেন কাসপরভের সাথে । অর্থকড়ি নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আগে থেকেই ফিদের উপরে ক্ষিপ্ত কাসপরভ ঘোষণা দিলেন ফিদে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার । নিজের তৈরি পিসিএ’র অধীনে ববি ফিশারের সঙ্গে আয়োজন করলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ । ফিদেও কেড়ে নিলো তাদের সদস্যপদ, রেটিং পয়েন্ট ।
২
ডালমিয়া আইসিসির প্রধান হন ১৯৯৭ সালে । মূলত তার প্রচেষ্টাতেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায় সত্যি কিন্তু এর পেছনে তার ক্রিকেট বিশ্বায়ন নামের সুন্দর চেতনার আড়ালে যে অর্থকড়ির সংস্থানের ধুরন্ধর মস্তিস্কটি ছিলো তা চিরতরে বদলে দিলো ক্রিকেটকে । স্পন্সরশিপ, বাজার অর্থনীতি দিয়ে ভারত হয়ে গেলো সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড আর বদলে যেতে শুরু করলো ক্ষমতার সমীকরণ । ক্রিকেটে ব্যবসা যেমন এনে দিয়েছে পেশাদারিত্ব তেমনি কেড়ে নিয়েছে নীতিবোধ । খুব স্বাভাবিকভাবেই অর্থের ছড়াছড়ি প্যান্ডরার বাক্স ভেঙ্গে বের করে এনেছে লোভ । আর সেই লোভকে পুজি করে জুয়াড়িরা পকেটে ভরছে বিশ্বাসযোগ্যতা আর বিসিসিআই চাইছে এককেন্দ্রিক ক্ষমতা । আইপিএলে যত হাজার কোটি টাকার জুয়ায় লেনদেন হয় সেটা জানার পর এটাতে আর কোনও সন্দেহই থাকেনা যে, বিসিআই আইসসিসির পুরো ক্ষমতা পেলে ক্রিকেট খেলাটা আসলে নিয়ন্ত্রিত হবে জুয়াড়িদের লাভক্ষতির হিসেব নিকেশে ।
৩
ক্ষমতার নেশায় বিসিআই এখন আলাদা হয়ে যাওয়ার হুমকি দিতেও পিছু হটছে না । কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছে তারা ক্রিকেট খেলাটার উর্ধে না । ক্রিকেটের জন্য বিসিসিআই , বিসিআই এর জন্য ক্রিকেট না । আজ তারা স্পন্সরদের ঘাড়ে পা রেখে ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যখন শুধু তিন দেশের মধ্যে তাদের খেলা সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে তখন স্পন্সরাও কি সেটা ভালো ভাবে নেবে?? কে দেখতে চাইবে ঘুরে ফিরে তিন দেশের খেলা ?? কাসপরভ ফিদে থেকে আলাদা হয়ে দুই বছর কোনোওক্রমে পিসিএ চালানোর পর আবার ফিদের সাথে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং পরে তিনি স্বীকার করেন, ফিদেকে ছেড়ে যাওয়া তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো ! কারণ, ওই নির্দিষ্ট কয়েকজন প্রতিযোগীর সাথে ঘুরে ফিরে কাসপরভের খেলা কারোরই বেশিদিন আগ্রহের কেন্দ্রে থাকেনি।
আমরা মানতে যতই ঘৃণা করিনা কেনও সত্যি কথাটা হলো, ক্রিকেট অর্থনীতি ভারতের বাজারের উপর অনেক অংশেই নির্ভর । সেই বাজার হারিয়ে ফেললে, ক্রিকেটারদের আর্থিক সচ্ছলতা কমবে তবে এই চরম স্বার্থপরতার যুগে ক্রিকেটের মূল চেতনা ফিরে আসবে বলে যারা আশা করছেন তা নিতান্তই দুরাশা । বরং দুই দিকে দুইরকম আর্থিক পরিস্থিতি এক চরম অরাজক অর্থনৈতিক অসাম্যের জন্ম দিবে । একসময় এটিই এই খেলা থেকে দর্শক, স্পন্সর সবাইকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করবে । মৃত্যু হবে খেলাটির । যেমন, কাসপরভ চলে যাওয়ার পর ফিদের উপর অসন্তুষ্ট স্পন্সরদের কারনে, ফিদের আবার নতুন করে গুছিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছিলো ।
৪
সব মিলিয়ে ক্রিকেট এখন এক কঠিন সঙ্কটে । ভারতের অসম্ভব প্রস্তাব মেনে নেওয়া যায়না , একদিন না একদিন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতই । আবার ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে অন্যান্য ক্রিকেটাররা আর সেসব জায়গায় খেলতে পারবে না এটা মেনে নেওয়াও কঠিন , কারণ কে জানে একজন ক্রিকেটারের ক্রিকেট সামর্থ্যের বড় পরীক্ষাটাই হয় অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে ।
যদিও আমার আবেগে টইটুম্বুর মন, বারবার বলছে, যাক বিসিসিআই জাহান্নামে ! তারপর একটা শিক্ষা হোক তাদের । কিন্তু সমস্যা হলো, তাতে ক্রিকেটেরই ক্ষতি। তাই প্রার্থনা, বর্তমানে যেমন আছে তেমনই থাক ক্রিকেট । ক্রিকেটের বড় ভাইরা বুঝুক, গৃহবিবাদে কারও লাভ হয়না । কেউ তাদের বোঝাক, জমিদারী প্রথা কিংবা দুই মেরুর ক্রিকেট বিশ্ব দুটোই চরম ক্ষতিকর ক্রিকেট খেলাটির জন্য ।
কিন্তু প্রশ্ন একটাই, এই সঙ্কটে থার্ড আম্পায়ারের ভূমিকা নিবে কে??
( পোষ্ট উৎসর্গ মাহমুদ ভাইকে । সামুর সমস্যার কারনে আমি সামুতে ঢুকতেই পারিনা যখন, মাহমুদ ভাইকে বলি, উনি সামুকে কষে ধমক দেন আর আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঢুকতে পারি ।

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:১৬