একটা সময় ছিল যখন একেবারে হাতেগোনা কিছু মানুষই ফটোগ্রাফি করত। কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লবের জোয়ারে এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। চাইলেই এখন যে কেউ পুরোপুরি পেশাদার না হলেও সিরিয়াস ফটোগ্রাফি করতে পারে। আর এসব ফটোগ্রাফারদের অধিকাংশের মূল অস্ত্র হচ্ছে একটা পয়েন্ট এন্ড শুট কম্প্যাক্ট ডিজিটাল ক্যামেরা। ছোট স্মার্ট এবং ইন্টেলিজেন্ট ক্যামেরাটি পকেটে করে যত্রতত্র নেয়া যায়। এছাড়া এসব ক্যামেরা দিয়ে ফটোগ্রাফি জ্ঞান তেমন না নিয়েও সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা যায়। ডিজিটাল ক্যামেরার দাম কমে আসায় এই শ্রেণীর ফটোগ্রাফারদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সোজা কথায় ডিজিটাল ক্যামেরা ফটোগ্রাফির কাজটাকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ করে দিয়েছে।
একদিকে দিন দিন ক্যামেরার দাম যেমন কমে আসছে তেমনি অভিনব সব সহায়ক ফিচার যুক্ত হচ্ছে ক্যামেরায়। অনেক ক্যামেরাতেই এখন থাকছে ফেইস রিকগনিশন সফটওয়্যার, এলসিডি টাচস্ক্রিন, এমনকি স্মাইল ডিটেকশন পর্যন্ত। কিন্তু এতকিছুর পরও নতুন একজনের পক্ষে কেনার জন্য ক্যামেরা নির্বাচন এখনও ধাঁধায় পড়ার মতো একটা বিষয়। চলুন দেখা যাক একটা ক্যামেরা কেনার আগে আমাদের কি কি বিষয় দেখা প্রয়োজন।
লেন্স
লোকজন প্রায়ই জুমলেন্স জুমলেন্স করে মাথা খারাপ করে ফেলে। কিন্তু তারা যতটা মনে করে ততটা জুম কিন্তু তারা আসলে ব্যবহার করে না। খুব বেশি জুম না খুঁজে বরং আরও বেশি পরিসর ধারণ করে (ওয়াইড এঙ্গেল) এমন লেন্স নিলেই সুবিধা বেশি। লেন্স ওয়াইড এঙ্গেল হলে প্রতি স্ন্যাপে আরো বেশি কিছু আপনার ছবিতে চলে আসে। ল্যান্ডস্কেপ, গ্রুপ ফটো বা ঘরের ভিতরের ছবির জন্য এটা বেশ ভালো কাজ দেবে। লম্বা জুম লেন্স বাচ্চাদের ছবি তোলার জন্য বেশ সহায়ক। ওয়াইল্ড লাইফ কিংবা খেলাধুলার ছবির জন্যও এটা প্রয়োজন হয়। তাই ভেবেচিন্তে স্থির করুন আপনার জন্য উপযোগী কোনটি।
জুম টাইপ
ক্যামেরা স্পেসিফিকেশনে দুটি জুমএর এবং কথা উল্লেখ থাকে। একটি ডিজিটাল অন্যটি অপটিক্যাল, দুটির চরিত্র কিন্তু পরিষ্কারভাবেই আলাদা। ডিজিটাল জুম কেবল ইমেজ ম্যাগনিফাই করে সিলেক্টেড অংশ সেভ করে। তাই এতে করে ইমেজে ডেটার পরিমাণ কমে যায় এবং ইমেজের মান নিম্নগামী হয়। অন্যদিকে অপটিক্যাল জুম হলো লেন্সের এমন একটা সমন্বয় যা অবজেক্টকে অপটিক্যালি কাছে নিয়ে আসবে। তবে খুব বেশি অপটিক্যাল জুম (১২ এক্স বা তার বেশি) থাকলে ফুল জুমে ছবি অনেক সময়ই ভালো হয় না। অবশ্য উজ্জ্বল সূর্যালোকে অর্থাৎ আলো পর্যাপ্ত থাকলে সমস্যাটা হবে না। যখন আলো একটু কমে আসবে (যেমন ইনডোরে বা সূর্যাস্তের সময়) তখনই সমস্যাটা দেখা যাবে। সাধারণভাবে ৪ থেকে ১০এক্স এর মধ্যে অপটিক্যাল জুম নেয়া যেতে পারে। যাদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন আছে তাদেরও ২০এক্স এর বেশি অপটিক্যাল জুম না নেয়াই ভালো।
এলসিডি স্ক্রিন
এলসিডি স্ক্রিনের আকারটা খুব বড় বিষয় নয়। লক্ষ্য করুন এর ঔজ্জ্বল্য, রঙের গভীরতা এবং শার্পনেস। একটু কোণাকুনি অবস্থান থেকে এটা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় কিনা এবং এর অ্যান্টি রিফেকটিভ কোটিং কতটা ভালো সেটাও দেখার বিষয়। এখনকার দিনে কিছু কিছু ক্যামেরায় টাচস্ক্রিন সন্নিবেশিত আছে। কিন্তু মানসম্মত টাচস্ক্রিন সমেত ক্যামেরা কিনলে কেবল টাচস্ক্রিনের জন্যই ক্যামেরার দামটা অনেক বেড়ে যায়। তাই বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ভিউ ফাইন্ডার
অনেকে এলসিডি স্ক্রিনের প্রিভিউ নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। যারা অনেকদিন ধরে ছবি তোলে এবং ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে অভ্যস্ত কিংবা যাদের দৃষ্টিশক্তি অতটা ভাল নয় তাদের জন্য ব্যাপারটা বেশি গুরুত্বপূর্ন। অনেক সময় উজ্জ্বল সূর্যালোকেও এলসিডি দেখতে অসুবিধা হয়। তো যেসব ক্রেতাদের এ জাতীয় সীমাবদ্ধতা আছে তারা ভিউ ফাইন্ডারসহ একটি ক্যামেরা কিনুন। অবশ্য আজকাল অনেক মডেলেই ভিউ ফাইন্ডার নেই এটাও সত্য।
ইমেজ স্ট্যাবিলাইজেশন
শুটিংয়ের সময় ক্যামেরা একেবারে স্থির রাখা খুব কঠিন। একমাত্র ট্রাইপড ব্যবহার করলে হয়তো কম্পনটা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা যায়। কিন্তু অন্যসব অবস্থাতেই কিছুটা কম্পন বহাল থাকে। আলো পর্যাপ্ত থাকলে শাটার স্পিড অনেক বাড়িয়ে এটাকে ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু আলো পর্যাপ্ত না থাকলে কাজটা মোটেও সহজ নয়। কারন তখন এক্সপোজার টাইম অনেক বাড়িয়ে ছবি তুলতে হয়। ক্যামেরায় ইমেজ স্ট্যাবিলাইজার প্রযুক্তি থাকলে এটা কম্পনের ফলে ইমেজের স্বাভাবিক বিচ্যুতি অনেকটাই কমিয়ে আনে। স্বল্প আলোতে ছবি তুলতে এটা অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। বড় জুমলেন্স ব্যবহার করে ছবি তোলার ক্ষেত্রেও এটা ভালো ফল দেয়।
আইএসও সীমা
আইএসও পরিবর্তন করলে ক্যামেরার সেন্সরের আলোকে সংবেদনশীলতা (সেনসিটিভিটি) পরিবর্তিত হয়। যেমন উজ্জ্বল সূর্যালোকে আইএসও-এর মান ১০০-ই যথেষ্ট হতে পারে। আবার সূর্যাস্তের সময় দৃশ্যমান ছবি পেতে চাইলে এটা ২০০ বা ৩০০ বা তারও বেশি করা প্রয়োজন হতে পারে। এখনকার অনেক ক্যামেরাই ১৬০০ পর্যন্ত আইএসও সুবিধা দেয়। স্বল্প আলোয় ফাশ ছাড়া ছবি তুললে বেশি আইএসও ছাড়া উপায় নেই। তবে মনে রাখবেন, আইএসও বাড়ালে ছবিতে গ্রেইন বেশি আসে।
ব্যাটারির ধরন
কম দামের ক্যামেরাগুলোতে সাধারণত অঅ সাইজের ব্যাটারি দেখতে পাওয়া যায়। এর সুবিধা হচ্ছে এটা যত্রতত্র পাওয়া যায়। রিচার্জেবল নিকেল-ক্যাডমিয়াম বা মেটাল-হাইড্রাইড ব্যাটারি চার্জারসহ কিনলে বারবার চার্জ করেও ব্যবহার সম্ভব। অঅ অ্যালক্যালাইন ব্যাটারিও ব্যবহার করা যায়। এগুলো তুলনামুলকভাবে বেশি সময় চলবে কিন্তু রিচার্জ করা যাবে না। এছাড়া অঅ ব্যাটারি থাকলে ক্যামেরার ওজনও একটু বেড়ে যায়। যারা বেশি ছবি তোলেন, তারা বারবার চার্জ করা বা ব্যাটারি পরিবর্তনের ঝক্কিটা নিতে চাইবেন না। তাদের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি যুক্ত ক্যামেরা কেনাই ভাল। এ জাতীয় ব্যাটারি অনেক বেশি সময় ধরে চার্জ সরবরাহ করবে। ফলে একবার চার্জ করলেই কয়েকশ ছবি তোলা যাবে। এখনকার দিনে ১০ হাজার টাকার ওপরে প্রায় সব ক্যামেরাতেই লিথিয়াম ব্যাটারি পাওয়া যায়।
মেগা পিক্সেল
লোকে যতটা বলে মেগাপিক্সেল আসলে ক্যামেরার স্পেসিফিকেশনের ক্ষেত্রে ততটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। বর্তমানে অধিকাংশ ক্যামেরা যত পিক্সেলে ছবি ধারণ করে তা অবলীলায় অ৩ সাইজে প্রিন্ট করার মতো। ক্যামেরার সেন্সরের আকার বরং মেগাপিক্সেলের চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। সাধারণভাবে ইমেজ কোয়ালিটি সেন্সরের আকারের ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। অধিকাংশ কম্প্যাক্ট ক্যামেরাতেই সেন্সরের আকার খুবই ছোট। আর আকার বড় হতে হলে ক্যামেরার আকারও একটু বড় হতে হয়। তাই শুধু সিøমের পেছনে না ছুটে সেন্সরের আকার লক্ষ্য করুন।
ম্যানুয়াল কন্ট্রোল
এমন অনেক ক্ষেত্র থাকে যখন শুটিংয়ের কোন প্যারামিটার ম্যানুয়ালি সেট করে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। যেমন আইএসও বা অ্যাপারচার। কিন্তু প্রায়ই কম্প্যাক্ট ক্যামেরাগুলোতে ওয়ানটাচ কন্ট্রোল অপশন থাকে না। মেনু-সাবমেনুর ভিতরে গিয়ে সাধারণ ব্যবহারকারীরা আর এসব করতে উৎসাহী হয় না। তবে কিছু ক্যামেরা রয়েছে যেখানে এগুলো পরিবর্তনের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় দুটি হুইল বসানো থাকে। আর এর সাহায্যে ঝটপট এটা প্রয়োজনমতো কম-বেশি করে নেয়া যায়।
শাটারের বিলম্ব
এমন অনেক ক্যামেরা আছে যেগুলোতে বাটন প্রেস করার পরও বেশ কিছুক্ষণ পর শাটার ওপেন হয়। এছাড়া দুটি শুটের মধ্যবর্তী বিরতিও অনেক বেশি হয়। মেমোরিতে সেভ করার জন্য অত্যাধিক সময় নিলে এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ক্যামেরা কেনার সময় দোকানেই এটা পরখ করে নেয়া যেতে পারে।
ভিডিও ক্যাপচার
আজকের দিনে অধিকাংশ ক্যামেরাতেই ভিডিও ধারণ করার সুবিধা রয়েছে। সবচেয়ে ভালো ভিডিও পাওয়া যাবে যদি এইচডি ভিডিও সমেত একটা ক্যামেরা বাছাই করেন। আর এজন্য শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের (ক্যানন, নাইকন, অলিম্পাস, সনি, প্যানাসনিক) ক্যামেরাই সবচেয়ে ভালো ফল দেবে। তবে এ ধরনের ক্যামেরার দাম অন্যান্য কম্প্যাক্ট ক্যামেরার চেয়ে একটু বেশি হবে।
ইন্টেলিজেন্ট অটো
এই ইন্টেলিজেন্ট সফটওয়্যার ফিচারটি নির্ণয় করে যে আপনি ঠিক কোন ধরনের অবজেক্টের ছবি তুলছেন। সে অনুযায়ী এটা ইমেজ প্যারামিটারগুলো সেট করে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য এটা খুবই সহায়ক একটি ফিচার এমনকি ক্যামেরার প্রযুক্তি মানুষের হাসি পর্যন্ত শনাক্ত করে স্ন্যাপ নিতে পারে।
ফেইস ডিটেকশন
এখন অনেক ক্যামেরাতেই এটা দেখা যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে এটা বেশ সহায়ক। ক্যামেরা যখন কোন মানুষের মুখ আলাদা করে চিনতে পারে তখন সে এর জন্য উপযোগী ফোকাস, এক্সপোজার এবং কালার নিশ্চিত করতে পারে। অন্যথায় এর কোনটি হয়তো ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ধারণকৃত হতো।
ব্লিংক ডিটেকশন
অনেকেই ছবি তোলার সময় চোখের পলক ফেলে দেন। ফলে চোখ বন্ধ অবস্থায় ছবি পাওয়া যায়। ব্লিংক ডিটেকশন প্রযুক্তি ফটোগ্রাফারকে জানাবে যে স্ন্যাপের সময় কেউ পলক ফেলেছে এবং আরও একটি স্ন্যাপ নেওয়া প্রয়োজন। যারা ঘন ঘন পলক ফেলেন, তাদের ছবি তোলার জন্য এটা আসলেই দরকার।
** লেখাটি গত সপ্তাহে একটি বাংলা দৈনিকে ছাপা হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১১ দুপুর ২:৩২