প্রায়ই আমরা ভুল করি। কী ভুল করি?
যথেচ্ছভাবে অ-কারের উচ্চারণে ও-কার (ো) ব্যবহার করি আমরা। এ ভুল আমারও হয়ে থাকে। আমাদের ভুলে ভরা বাংলায় এ ভুল খুব অনুল্লেখই থেকে যায়। কিন্তু এ ধরনের ভুলের জন্য অনেক সময় বাক্যের অর্থও পরিবর্তন হয়ে যায়।
লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রায়ই গুরুতর এ সমস্যার সম্মুখীন আমাদের হতে হয়। এবার এ সমস্যা সমাধানের কথা তুলে ধরবো। কেননা বাংলা বানানে অ-কারের ও উচ্চারণ নির্দেশের জন্য যথেচ্ছভাবে ও-কার (ো) ব্যবহারের যে-প্রবণতা দেখা যায়, তা সঠিক নয়।
এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমী কী বলছে, দেখুন :
বাংলা অ-কারের উচ্চারণ বহুক্ষেত্রে ও-কার হয়। এই উচ্চারণকে লিখিত রূপ দেওয়ার জন্য ক্রিয়াপদের বেশ কয়েকটি রূপের এবং কিছু বিশেষণ ও অব্যয় পদের শেষে, কখনও আদিতে অনেকে যথেচ্ছভাবে ও-কার ব্যবহার করছেন। যেমন : ছিলো, করলো, বলতো, কোরছ, হোলে, যেনো, কেনো (কী জন্য), ইত্যাদি ও-কারযুক্ত বানান লেখা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া অনুরূপ ও-কার ব্যবহার করা হবে না।
বিশেষ ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে এমন অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ এবং বিশেষণ ও অব্যয় পদ বা অন্য শব্দ যার শেষে ও-কার যুক্ত না করলে অর্থ অনুধাবনে ভ্রান্তি বা বিলম্ব ঘটতে পারে। যেমন : ধরো, চড়ো, বলো, বোলো, জেনো, কেনো (ক্রয় করো), করানো, খাওয়ানো, শেখানো, করাতো, মতো, ভালো, আলো, কালো, হলো।
- বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.০৯.ও
উপরিউক্ত নিয়মগুলো বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় :
যেসব ক্ষেত্রে ও-কার বর্জন করতে হবে—
ক্রিয়াপদের শেষে: যথা—ছিলো, করলো, বলতো, করছো, শোবো, উঠবো, নেবো, লিখবো, ইত্যাদি না লিখে লিখব—ছিল, করল, বলত, করছ, শোব, উঠব, নেব, লিখব, ইত্যাদি।
ক্রিয়াপদের আদিতে : যথা—কোরছ, হোতে, ইত্যাদি না লিখে লিখব—করছ, হতে, ইত্যাদি।
বিশেষণ পদের শেষে, যথা—যেনো, যতো. এতো না লিখে লিখব—যেন, যত, এত ইত্যাদি।
অব্যয় পদের শেষে, যথা—কেনো, কতো, ততো না লিখে লিখব—কেন, কত, তত ইত্যাদি।
যেসব ক্ষেত্রে ও-কার দেওয়া হবে —
সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বোঝাতে অতিরিক্ত ও-কার যথাসম্ভব বর্জনীয়। যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত বর্ণে ও-কার দেওয়া হবে, যথা–মত, মতো; হল, হলো; ভাল, ভালো; কাল, কালো; কেন, কেনো; কোন, কোনো।
লক্ষ্য করে দেখুন ও-কার দেওয়ার পেছনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন—
১. অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদ হিসেবে (আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, অনুরোধ ইত্যাদি বোঝাতে)—
ক. বর্তমান অনুজ্ঞা : করো, দেখো, শেখো, আনো, এসো, বসো, লিখো, ইত্যাদি। উদাহরণ : কাজটি করো।
তবে তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হলে ও-কার বসবে না। যেমন—কর, দেখ, শেখ, আন, বস, লিখ, ইত্যাদি। উদাহরণ : (তুই) এই কাজটি কর।
বর্ণনা অর্থে ব্যবহৃত হলেও ও-কার বসবে না। যেমন—কর, শেখ, ইত্যাদি।
উদাহরণ : কী কর? লেখাপড়া শেখনি?
খ. ভবিষ্যত অনুজ্ঞা : কোরো, বোলো। উদাহারণ : কাজটি কোরো।
২. আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দ—
আনো প্রত্যয়ান্ত শব্দের শেষে ও-কার যুক্ত করা হবে। অর্থাৎক্রিয়া-বিশেষ্য তথা কিছু কিছু ক্রিয়াকে যখন 'আনো' প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য (noun) হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন ও-কার যুক্ত হবে। যেমন : করানো, বলানো, খাওয়ানো, পাঠানো, নামানো, শোয়ানো, ঘুম তাড়ানো, ছেলে ভোলানো। বাক্যে : শিশুকে খাওয়ানো বড় কঠিন; শেখানো আমি এখনও শিখতে পারি নি; চিঠিটি পাঠানো দরকার।
৩. অর্থের ভেদ পরিষ্কার করতে—
কাল/কালো
কাল মহিষটি জবাই করা হবে। (আগামী কাল মহিষটি জবাই করা হবে)
কালো মহিষটি জবাই করা হবে। (কালো রঙের মহিষটি জবাই করা হবে)
মত/মতো
তোমার মত কি নেই! (তোমার সায় আছে না নেই)
তোমার মতো কি নেই! (তোমার অনুরূপ আছে না নেই)
হল/হলো
এটা কি একটা সিনেমা হল? (এটা কোনো সিনেমা হল কি না)
এটা কি একটা সিনেমা হলো? (সিনেমার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে)
কেন/কেনো
এই জামাটা কেন? (এই জামাটা বেছে নিলে কেন)
এই জামাটা কেনো (এই জামাটা ক্রয় করো)
কোন/কোনো
কোনটা কিনছ? (নির্দিষ্ট অর্থে)
কোনোটা কিনছ? (অনির্দিষ্ট অর্থে)
একইভাবে, করাত/করাতো, ভাল/ভালো, হত/হতো, দেব/দেবো, হব/হবো ইত্যাদি শব্দগুলোর আলাদা আলাদা অর্থ আছে। তাই বাক্যে কোন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য রেখে ও-কার গ্রহণ বা বর্জন করতে হবে।
হয়তো, নয়তো
অনেকে তো লিখতে ভুল না করলেও হয়তো লিখছেন হয়ত, নয়তো লিখছেন নয়ত। লিখুন—তো, হয়তো, নয়তো, এ তো, পার তো, বল তো, ইত্যাদি।
অর্থাৎ হয়তো, নয়তো বাদে সকল তো আলাদা হবে। যেমন— আমি তো যাই নি, সে তো আসে নি ইত্যাদি। মূল শব্দের শেষে আলাদা তো ব্যবহারের ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য।
ও নাকি ও-কার?
আজো লিখব, না আজও লিখব?
এখনো লিখব, না এখনও লিখব?
আরো লিখব, না আরও লিখব?
প্রশ্নগুলো প্রায় সবার।
উত্তর কিন্তু তেমন কঠিন নয়। শব্দগুলো উচ্চারণ করেই দেখুন। তবুও সন্দেহ দূর না হলে অভিধান খুলে দেখুন ও অক্ষরটির ব্যাপারে কী বলা আছে সেখানে?
সেখানে লেখা আছে :
ও—সংযোজক অব্যয়। ১. পর্যন্ত (এখনও গেল না আঁধার—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ) ২. মাত্রাধিক্য বোঝাতে (আরও আঘাত সইবে আমার—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
তাই লিখুন—এখনও, আরও, আজও, ইত্যাদি।
তাহলে ভালো, মতো, করানো, মন-মাতানো, হাজারো, আধো, কোনো, ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রে কেন ও নয়, ও-কার (ো) দিতে হবে?
কারণ এসব শব্দের ও বাংলা পদান্তিক অ-স্বরের অর্ধস্ফুট উচ্চারণ জাত। অর্থাৎ এগুলোর উচ্চারণ ততটা পরিষ্কার নয়। তাই –কার চিহ্ন দিতে হবে।
ও-কার (ো) ব্যবহারের আরও কিছু নিয়ম
১. অ বা আ-কারের পর উ কিংবা ঊ-কার থাকলে উভয়ে মিলে ও-কার (ে া) হয়। ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। যেমন—
অ + উ = ও-কার; পর + উপকার = পরোপকার
অ + উ = ও-কার; সূর্য + উদয় = সূর্যোদয়
অ + ঊ = ও-কার; নব + ঊঢ়া = নবোঢ়া
আ + উ = ও-কার; কথা + উপকথন = কথোপকথন।
২. অ-কারের পরস্থিত স-জাত বিসর্গের পর স্বরবর্ণের ‘অ’ কিংবা অন্য কোনো ঘোষবর্ণ থাকলে ‘অ’ স্থলে ও-কার হয়। ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। যেমন—
মনঃ + যোগ = মনোযোগ, সরঃ + বর = সরোবর,
সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত, তপঃ + বন = তপোবন।
৩. মধ্য ও-ধ্বনি সর্বত্রই ও-কার দিয়ে’ লিখতে হবে। লক্ষ্য করে দেখুন, অন্তবর্ণে ও-কার মুক্ত করার বিধানটি বেশ যুক্তিসম্পন্ন। কিন্তু মধ্যবর্ণে ও উচ্চারণে ও-কার যুক্ত না করা হলে উচ্চারণ বিকৃতির আশঙ্কা থেকে যায়। যেমন—
পুরনো———পুরোনো
ভৌগলিক——ভৌগোলিক
৪. মূল ইংরেজি শব্দে O থাকলে সাধারণত প্রতিবর্ণে ও-কার হয়। যেমন— বোনাস (Bonus), পোলার (Polar), নোট (Note), ফোনেটিক (Phonetic) ইত্যাদি।
পূর্বের আসর
বানান আসর -১ : ই-কার না ঈ-কার, কখন কী হবেView this link
তথ্যসূত্র :
[১] বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান
অনুশীলনী
১. ক্রিয়া পদের শেষে ও-কার হবে কি না ? এ ক্ষেত্রে কোন্ শব্দগুলো শুদ্ধ : ছিলো, করলো, বলত, করছ, শোবো, উঠবো, নেব, লিখবো?
২. ক্রিয়া পদের আদিতে ও-কার হবে কি না ? কোরছ, হোতে হবে নাকি করছ,হতে হবে?
৩. বিশেষণ পদের শেষে কী হবে? এ ক্ষেত্রে কোন্ শব্দগুলো শুদ্ধ : যেনো, যত, এতো, এত ?
৪. অব্যয় পদের শেষে ও-কার হবে কি না ? কেন, কত, তত হবে নাকি কেনো, কতো, ততো হবে ?
৫. কখন করো, বলো ইত্যাদি শব্দগুলো কোরো, বোলো ইত্যাদি হবে : ক. বর্তমান অনুজ্ঞায় খ. ভবিষ্যত অনুজ্ঞায় ?
৬. অশুদ্ধ হলে শুদ্ধ করে লিখুন-
করান, বলান, খাওয়ানো, পাঠানো, নামান, শোয়ানো।
৭. কোন্ বাক্যগুলো শুদ্ধ? শুদ্ধ বাক্যগুলো একদিকে এবং অশুদ্ধ বাক্যগুলো শুদ্ধ করে অপরদিকে লিখুন-
তোমার মত কি নেই! (তোমার অনুরূপ আছে না নেই)
তোমার মত কি নেই! (তোমার সায় আছে না নেই)
এটা কি একটা সিনেমা হল? (এটা কোনো সিনেমা হল কি না)
এটা কি একটা সিনেমা হল? (সিনেমার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে)
এই জামাটা কেনো? (এই জামাটা বেছে নিলে কেন)
এই জামাটা কেনো (এই জামাটা ক্রয় করো)
কোনোটা কিনছ? (নির্দিষ্ট অর্থে)
কোনটা কিনছ? (অনির্দিষ্ট অর্থে)
৮. কোনগুলো শুদ্ধ :
তো, হয়তো, নয়ত, এ তো, পারো তো, বলো তো ?
৯. আরও, আজও, এখনও হবে নাকি আরো, আজো, এখনো হবে?
১০. কোন্ বানানগুলো সঠিক- ভাল, মতো, করান, মন-মাতান, হাজারো, আধো?
১১. কোন্ শব্দগুলো শুদ্ধ :
পরোপকার, কথপকথন, সূর্যোদয়, নবোঢ়া, মনযোগ, সরবর, সদ্যোজাত, তপোবন, পুরনো, ভৌগোলিক, বোনাস, পলার, নোট, ফনেটিক?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০১