বুদ্ধিজীবি হত্যা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই লিংকে গিয়ে বুদ্ধিজীবিদের সংখ্যা ও নামের তালিকা দেখতে পারেন। শুধু একটা প্রশ্নই মনে জাগে কতটা পাশবিকতা মানুষকে এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে প্রণোদিত করতে পারে?! পাশবিকতা শব্দটাও বোধ হয় একদমই যথার্থ নয় কারণ পশু কখনও এরকম আচরণ করে না।
২৫শে মার্চ রাত থেকেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এদেশের শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা শুরু করে। ঐরাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও ছাত্রদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর পাক সামরিক বাহিনীর সাথে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সারা দেশ জুড়েই এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। ডিসেম্বরের প্রথমদিকে যখন পাকিস্তানের পরাজয় কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তারা এদেশী দোসরদের সাথে বসে আমাদের বুদ্ধিজীবিদের তালিকা করতে শুরু করে। যে মানুষ নামক জানোয়াররা এই কাজে সহায়তা করেছে তারা তখন মুক্তিযুদ্ধের সেই শেষ দিকে এসেও কীভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এই খুনের জন্য সহযোগীতা করেছে তা আমার মনে কেবলই প্রশ্ন জাগায়। তারা জানত যে বাংলাদেশ স্বাধীন হচ্ছে এবং এই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই তাদের এদেশে বাস করতে হবে। তবুও মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশী এই জানোয়ারগুলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের সহায়তা করে যাচ্ছিল। পাক সেনাবাহিনীকে এদেশী বুদ্ধিজীবিদের নামের তালিকা প্রণয়ন করতে সাহায্য করা এবং ১৪ ডিসেম্বর পাক সেনাবাহিনীর সাথে মিলে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করার মত কোন্ যুক্তি থাকতে পারে এই জানোয়ারগুলোর মধ্যে?
যুক্তি অবশ্যই ছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে যেহেতু তারা আর রাখতেই পারছেনা তাই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে মেধাশূণ্য করা আর তাদের দোসরদের উদ্দেশ্য ছিল যে চেতনাকে ধারণ করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সূচণা সেই চেতনার ধারকদের বিনাশ করা। পরবর্তীতে যখন এই দোসরগুলো আবার সংগঠিত হল এবং সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ধর্মের নামে তাদেরকে রাজনীতিতে প্রবেশ করার সুযোগ করে দিল তখনও তারা মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনাকে বিনাশে উদ্যোগী হল এবং এখনো সক্রিয় আছে।
বুদ্ধিজীবিদের তালিকা দেখলে আমরা দেখতে পাই পাকবাহিনী এবং রাজাকার-আলবদররা সবচেয়ে বেশী হত্যা করেছে শিক্ষকদের। মোট ৯৯০ জন শিক্ষককে তারা হত্যা করেছে। শিক্ষকদের মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ছিল। উপমহাদেশের সর্বোচ্চ প্রগতিশীল শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাদের মুক্তবুদ্ধি চর্চা তথা প্রগতিশীল সাহিত্যিক, শিল্পী, কবিদের অনেকেরই বিদ্যাপিঠ ছিল এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাদে আরো যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে দেখা যায় বেছে বেছে প্রগতিশীল সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, পেশাজীবিদের নাম।
১৯৭১ এ যারা স্বাধীনতাবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল তাদের মধ্যে একটা দল ছিল নিস্ক্রিয়। কেবল চীনপ্রীতির জন্য তারা নিস্ক্রিয় থেকেছে। যদিও তাদের ভিতরে পরবর্তীতে এর পরিবর্তন দেখা যায়। বাকি ভারী দলটা যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সবধরণের সহায়তা করেছিল তাদের প্রধান পরিচয় তারাই বর্তমানে এদেশের ইসলামের ধারক-বাহক ও প্রচারক। চিরকালই প্রগতিশীলতা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে এরা প্রধান শত্রু বলে মনে করে এসেছে। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশী বাঙালীদের মধ্যে যে প্রগতিশীল, ধর্মনিরেপক্ষ চেতনার জন্ম দেয় তারই ফসল ১৯৭১। ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশী বাঙালীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। যে চেতনাকে ইসলাম তাদের ধর্মের শত্রু বলে বিবেচনা করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি অন্যতম প্রধান উপাদান ছিল ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে বুদ্ধিজীবি হত্যার মাধ্যমে রাজাকার-আলবদর-আলশামস সহ সকল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পাকিদোসরগুলো চেয়েছিল এদেশ থেকে প্রগতিশীলতা তথা মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিনাশ ঘটানো।
ধর্মগুলো সবসময়েই মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে গলাটিপে মেরে ফেলতে চাইলেও এ চর্চা থেমে থাকেনি। আমাদের মুক্তবুদ্ধি চর্চার ইতিহাস অনেক পূরাণো। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম মুক্তবুদ্ধির দর্শণ চার্বাক দর্শণ। বাঙালীদের প্রথম এ জাতীয় দর্শণের সাথে পরিচয় ঘটে গৌতম বুদ্ধের দর্শণের মাধ্যমে। তাছাড়া বাঙালীর লৌকিক ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টি ফিরালে দেখতে পাওয়া যায় পাশ্চাত্য তথা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু সংখ্যক বাঙালীর মধ্যেই যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা সীমিত থেকেছে এমন ধারণা মোটেই সত্য নয়। বরং প্রকৃতপক্ষে প্রাক-আধুনিককাল থেকেই বাংলার সাধারণ জনগন মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদিতার চর্চা করে এসেছে নানা প্রতিকূলতার চাপের মধ্যেও। কখনো কখনো সে স্রোত-ধারা ক্ষীণ বা অবদমিত হয়েছে, কখনো বা উর্ধগামীও হয়েছে; কিন্তু কখনোই সে স্রোত একেবারে রুদ্ধ বা স্তব্ধ হয়ে যায়নি।
আমাদের দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার আরেক নিদর্শণ এদেশের বাউল সমাজ। লালন ফকিরের একটি জনপ্রিয় গান তুলে দিলাম।
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।।
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।।
যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীর তবে কি হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতা প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে।।
জগত বেড়ে জাতের কথা,
লোকে গৌরব করে যথা তথা।
লালন সে জাতের ফাতা
ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে।।
জালাল উদ্দীন খাঁর লেখায় দেখতে পাই-
ধর্ম হতে এই জগতে দলাদলিই কেবল সার
ভুলে পড়ে জালাল ঘোরে মন হইল না পরিষ্কার।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডময় একের মন্দ অন্যে কয়
করে কত হিংসার উদয় ঘৃণার চক্ষে চায় আবার,
কাগজের এই বস্তা ফেলে মহাসত্যের দেশে গেলে
ভেসে যাবে সব সলিলে ধর্ম বলতে নাই কিছু আর।
কিংবা- মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ মন্ত্রণা কে দিয়াছে মানুষ ভজ
কবি দ্বিজ দাসের লেখায় ফুটে ওঠে স্পষ্ট অবিশ্বাস-
কেউ বলে আছ তুমি কেউ বলে নাই
আমি বলি থাকলে থাকুক না থাকিলে নাই।
যারে নয়নেও দেখি নাই শ্রবণেও শুনিনাই
আছ কি না আছ মেলে না প্রমাণ।
পাগল দ্বিজদাসের গান।
এদেশে এখন বাউল ভাস্কর্য ভাঙা হয়। কেন ভাঙা হয় তার উত্তর খুঁজতে দার্শণিক হতে হয় না। বাউলদের মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে ধর্ম তথা ইসলাম ভয় পায়। যেন বাউলদের ভাস্কর্য ভাঙলেই ওঁরা বোবা হয়ে যাবে। ওঁদের সাহিত্য, ওঁদের গান মানুষের মন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হুমায়ুন আজাদকে মেরে ফেলতে পারলেই যেন তাঁর সকল সাহিত্যকর্ম বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে যেমন ওরা বাঙালী জাতিকে মেধাহীন করেছিল, তেমনি এখনো এই জানোয়ারগুলোকে এতটুকু সুযোগ দিলে এরা নিশ্চিহ্ন করে দিবে বাঙালি জাতির সকল প্রগতিশীলদের।
বস্তুত হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ইত্যাদি প্রথাগত ধর্ম আমাদের সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসকদের ধর্মকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু ঐ সব ধর্মগুলোই বাঙালী লোকসমাজে প্রবেশ করে ক্রমেই তাদের শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতা হারিয়ে লৌকিক ধর্মে পরিণত হয়েছে। বাঙালীর লৌকিক ধর্মগুলো প্রথাগত শাস্ত্রধর্মের রক্ষণশীল তত্ত্ব ও বিধানকে বরাবরই প্রত্যখান করেছে এবং সে প্রত্যাখানে লোকসাধারণের কাণ্ডজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধিই নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল তার বিরাট একটা অংশ ছিল ছাত্র। তখনকার সময়ের প্রায় সকল প্রগতিশীল চিন্তার ছাত্ররাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের অনেকেই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছে। স্বল্পশিক্ষিত একটা জাতিগোষ্ঠির জন্য একসাথে এতগুলো ছাত্রের মৃত্যুই ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তার সাথে বেছে বেছে শীর্ষ বুদ্ধিজীবিদের হত্যা জাতি হিসেবে আমাদের কতখানি পিছিয়ে দিয়েছে তার নিদর্শন আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
আজ আমাদের দেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চার মানুষের বড়ই সংকট। শুধু সংকট নয়, তাদের জীবনই ঝুঁকিপূর্ণ। একজন মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী যখন খুনের হুমকি পায় তখন থানায় যেতে ভয় পায়। কারণ এখন রাষ্ট্রীয়ভাবেই এ দেশে মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে ঠেকানোর জন্য উঠে পড়ে লেগে থাকে সরকারগুলো। শুধু ক্ষমতার লোভে বি.এন.পির মত রাজনৈতিক দল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিরোধিতা করে, জামাতের মত যুদ্ধাপরাধী দলের সাথে জোট বাঁধে। আওয়ামী লীগের মত রাজনৈতিক দল মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমতুল্য ঘোষণা দেয়। বিসমিল্লাহ আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সাথে ধর্মনিরপেক্ষ নামক এক জগাখিচুরী সংবিধানের খসড়া অনুমোদন করে। ভোটের আগে আওয়ামী রাজনীতিবিদের সাথে রাজাকারের কোলাকুলির ছবি দেখতে পাই পত্রিকায়। এটা এখন আর বুঝতে বাকি নেই যে, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের দাবীকে উপেক্ষা করতে পারেনি বলেই আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী বিচারের কাজ হাত নিয়েছে, মোটেই স্বেচ্ছায় নয়।
বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা না হলে আমরা অর্থনৈতিকভাবে বর্তমানের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকতাম এরকম আমি নিশ্চিত করে বলছি না। তবে আমাদের দেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই বেহাল অবস্থা হতো না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। প্রগতিশীলতার এমন অপমৃত্যু হতো না। আমরা হতাম না এমন নৈতিকতাহীন জাতি। যে বুদ্ধিজীবিদের সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তারা একদিকে যেমন এ দেশকে আরো অনেক কিছু দিতেন, তেমনি এই পাকি শুয়োরদের সহায়তাকারী এদেশী জানোয়ারগুলোর আস্ফালনও এতখানি বৃদ্ধি পেত না। এদেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারীদের জীবন এমন বিপন্ন হতো না। বিপন্ন হতো না এ জাতির ভাগ্যাকাশ।
*লেখাটিকে কিছুটা এডিট করে নতুন করে সাজানো হলো।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:১১