আজ অনেকটা ধীর গতিতে হাঁটছিলাম, সব সকাল এক রকম হয় না, সব সকালে ইচ্ছে করেনা অফিস সময়মত ধরার জন্য ছোটাছুটি করি, মাঝে মাঝে ভিন্নতা প্রয়োজন, মাঝে মাঝে প্রয়োজন মনকে শান্ত রাখা, মাঝে মাঝে প্রয়োজন কিছু অনিয়ম, মাঝে মাঝে কিছু পরোয়াহীন সময় একান্ত নিজেকে উৎসর্গ করা উচিৎ।
বাস থেকে নেমে বনানীর ঢাকা চাকা কাউণ্টারের দিকে যাচ্ছি আর খুব গভীরভাবে ভাবছি উপরের কথাগুলো, এমন সময় খুব কাছে থেকে একজন বলে উঠলো ঢাকা চাকার কাউণ্টার কি সামনে? আমি ফিরে তাকালাম, মেয়েটি দ্বিধাগ্রস্ত, কথা বলে ভুল করেছে এইরকম একটা ভীতিও চোখেমুখে ফুটে উঠেছে, আমি নিজের মতন করে যখন নিজেকে শান্তনা দেয়ার মতন লজিক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক ভাবনায় ডুবে থাকি ঐ সময় কেউ কথা বললে নাক, মুখ, চোখ জ্বলে ওঠে, সেই দৃষ্টি ভালোনা। তার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম আসেন আমার সাথে, মেয়ে আমার থেকে বেশ পিছিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমায় ফলো করতে লাগলেন। আজকাল পুরুষ মহিলা সব অনেক ভীতু হয়ে গেছেন কিংবা অচেনা পরিবেশে মানুষ একটু ভীতুই হয়।
বনানীর এই রাস্তাটা সকাল দুপুর সন্ধ্যা সারাক্ষন ব্যস্তই থাকে, বিশেষ করে গুলশান যেতে প্রচুর ভিড়। মনে আছে একদিন এইরকম গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি, গাড়ি চলছেনা, হলি আর্টজানের ঘটনায় সকল প্রকার বাস এবং রিক্সা গুলশানে প্রবেশ বন্ধ। কিছু সিএনজীর যাত্রী আনা নেয়ার অনুমতি আছে, কিন্তু তখন যেহেতু যথেষ্ট পরিবহন ক্রাইসিস কাজেই একটা সিএনজী এলে পরিমরি করে সব পুরুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন সেটায়, এই এক দৃশ্য টানা এক ঘণ্টা ধরে দেখতে দেখতে পাশে দাঁড়ানো অতিরিক্তি সুন্দরী এক মেয়েকে বললাম, সিএনজীতে এদের জন্য আজ ওঠাই যাবেনা, মেয়েটি আমার দিকে চেয়ে সৈজন্যসূচক মৃদু হেসে সামনে তাকালেন, তারপর বললাম, একেকটা এইরকম লাফ ঝাঁপ করতে গিয়ে উল্টে পড়ে হাত, পা, নাক, মুখ ভেঙ্গে রক্তারক্তি হলে দেখতে ভালো লাগতো, এই বাক্যে মেয়েটি চোখ বড় করে আতংকিত দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে দিয়ে ভীতু চোখ মুখ নিয়ে দ্রুত সরে গেলো।
কে জানি বলেছে নিজেকে জানতে হলে, মানুষকে জানতে হলে পথেঘাটে ঘুরতে হয়। কে বলেছে মনে নেই, তবে এই রকম একটা স্মরণীয় বানী কোন পুস্তকে পড়েছিলাম।
আমাদের দেশে যে সকল মানুষ হতাশ, যে সকল ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করে, ঐ আত্মহত্যার মুহূর্তে যদি টেনে হিঁচড়ে একবার নিজেকে পথে এনে ফেলে দিতে পারতো, তবে অবশ্যই অবশ্যই প্রান বেঁচে যেত।
পথের অনেক গুন।
পথ দেখতে যতটা সাধাসিধা দেখায় ততই রহস্যময়; পথ আর পথের অচেনা মানুষ যেমন বিচিত্র, তেমন কখনো কখনো অত্তাধিক আপন ও। একদিন আমি যেই বাসে ফিরছিলাম সেই বাস জসীমউদ্দিন মোড় পর্যন্ত গিয়ে টায়ার পাংচার হয়ে বন্ধ হয়ে্ যায়, ওদের কাছে ভালো টায়ার ছিল এবং ওরা যাত্রীদের বলল আপনারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন, পনেরো বিশ মিনিট সময় দেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু যাত্রীরা এইরকম সময় প্রতিবারই অনেক রুড হয়ে যান, তারা হেল্পারকে টানা হেঁচড়া করে, পুরা ভাড়া ফেরত নিয়ে নেন এবং হেল্পার ড্রাইভার কে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
সবাই নেমে যাবার পরও আমি বসে থাকলাম, আমার তাড়াহুড়া নাই তা না, ড্রাইভার হেল্পার সবগুলার বয়স সতেরো পার হয়নি, শুকনা কঙ্কাল শরীর, একে ওকে ফোন করে ওদের বিপদের কথা জানাচ্ছে, কীভাবে টায়ার রিপ্লেস করতে হয় জিজ্ঞেস করছে, ভারী চাকা উঁচু করার মতন যথেষ্ট শক্তি ওদের নাই। কাজেই ওদের বিপদে ফেলে যেতে মন চাইলো না,
বসে বসে দুই তিনটা গান শুনলাম, মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে, গান বন্ধ করে বাস থেকে নামলাম, ওরা সবাই মুখের দিকে তাকালো কিছু বলার সাহস পেলনা, একেকটা ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা, আমি সামনেই আড়ং এর শপিং মলে ঢুকলাম। দুইটা রুপার তিনটা মুক্তার ব্রেসলেট কিনে, এক জোড়া জুতা পছন্দ করলাম, সেলস গার্ল অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে মন খারাপ চেহারা করে জানালো ম্যাম ঐ সাইজ শেষ হয়ে গেছে, নতুন জয়েন করেছ? বলল হ্যাঁ, বুঝলাম এই জন্যই তার মন খারাপ দশা।
পাশের কন্টিনেন্টাল থেকে এক লিটারের একটা পানির বোতল কিনে হাঁটতে হাঁটতে সেই বাসের কাছে গেলাম, ওরা তিনজনই কাজে মগ্ন, পেছন থেকে বললাম এই কি ব্যাপার তোমাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি? তোমাদের জন্য পানি কিনে এনেছি, কার জানি মাথা ব্যথা করছে? এই নাও নাপা, অনেকক্ষণ হয় খেয়েছো নাকি কিছু খেয়ে নেবে? খালি পেটে ণাপা খাওয়ার দরকার নেই, ওরা জানালো ওরা গুলিস্থান থেকে বাস ছাড়বার আগেই খেয়েছে এবং ওদের খিদে নেই, এবং অনেকদিন পর পরিবারের লোকজনের সাথে দেখা হলে যেইভাবে আবেগতারিত হয় ওরা নিমিষেই সেই রকম করলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই বাস ঠিক হলে নতুন যাত্রীতে ভরে গেলো, কিন্তু ওরা তিনজন ওদের প্রিয় বোনের পাশে কোন বেগানা পুরুষকে বসতে দিলো না, সারাক্ষন পাশে দাঁড়িয়ে পাহারা দিলো, কোন যাত্রী বসতে উপক্রম করতে চাইলে পেছনে সীট আছে পেছনে যান বলে হাকডাক ছাড়লো। চাকা পালটানোর বিস্ময়কর এক্সপেরিয়েন্স একে অপরের সাথে দাঁত বের করে শেয়ার করতে থাকলো, যেন ওরা যুদ্ধ জয় করেছে।
এরপর ওদের বাসে আমি আরও কয়েকবার উঠেছি, আমার ভাড়া নেয়নি, চতুর্থ বার আহ্লাদী শাসন করে বুঝিয়ে ভাড়া দিয়েছি।
প্রিয় ভাইগুলা আমার, ভালো থাকিস।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৭