ছবিঃ গুগল
একটানা পাঁচদিন ধরে রিনরিনে, ঝড়ো গতিতে কখনো খানিকটা থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছেই, একাধারে বৃষ্টি হওয়ায় ঢাকার প্রধান সড়কসহ অলিগলি ডুবে জুবুথুবু অবস্থা।
ঢাকা শহরে পানি নিস্কাশনের অবস্থা ধ্বংস প্রায় বলেই চারদিকে জলাবদ্ধতার থৈ থৈ পানি, বৃষ্টি হলেই ঢাকার অলি গলি হাঁটু থেকে কোমর পানি জমে যায়।
সোশ্যাল সাইটে এই নিয়ে একেকজনের ফানি স্ট্যাটাস সেদিন একজন নটরডেম কলেজের সামনে বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় জমে থাকা পানির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে পোস্ট দিয়েছেন তাতে লিখেছেন যারা সময় এবং টাকা পয়সার অভাবে এখনো কক্সবাজার যেতে পারেননি তারা দ্রুত চলে আসুন ঢাকার আবহমান মিনি কক্সবাজারে, একদম ফ্রি এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দ্রুত চলে আসুন দেরি করলেই ফুরিয়ে যাবে পানি!
আরেকজন আবার লিখেছেন গুলিস্থান এসেছি এখন বাড়ি যাব, রিক্সা ঘাটেই বাঁধা।
ঢাকার এই অচল অবস্থায় ঘরে বসে নেই নগরবাসী। উনারা এই অচল ঢাকায় সচল থাকতেই অভ্যস্ত!
তারা যে যার মতন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন, বেশিরভাগ হাতে ছাতা,প্যান্ট টেনে হাঁটুর উপরে তোলা, মেয়েরা তাদের শাড়ি সেলোয়ার লেগিংস যে যা পরেছেন টেনে ধরে অন্য হাতে বাকী সব প্রয়োজনীয় জিনিস। সময় মত অফিস কলেজ ইউনিভার্সিটি ধরতেই হবে, দ্রুত ছুটছেন সবাই।
হাজার হাজার প্রাইভেট কার এবং পাবলিক বাস জট লেগে থেমে আছে এর ভেতর। ইহকালে এই জট খুলবে কিনা সন্দেহ! একি রকম মার প্যাঁচ গিট্টু প্রধান প্রধান সড়কসহ সড়কের শাখা প্রশাখা সবখানে। বড় ধরনের পলিথিনে পেঁচিয়ে পত্রিকা বিক্রি করছে এক হকার সে রবির গাড়ির কাছে আসতেই ১০ টাকা দিয়ে একটা পত্রিকা কিনে নেয়। মেলে ধরতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সূর্যের দিকে কপালে হাত দিয়ে
সূর্যগ্রহণ দেখার হাস্যকর ছবি, উনি খালি চোখে ভুলে একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছেন আর এই নিয়া হই হই রই রই !! ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকেই উনাকে নিয়ে মার্কিনীদের হাস্য কৌতুকের অন্ত নেই, এই যেমন ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বার বার টুইটে বানান ভুল একদিন টুইটে লিখেছিলেন—UNPRESIDENTED। পরে সেই ভুল শুধরে করেন—UNPRECEDENTED।
(HONORED) কে লিখেছিলেন (HONERED)!
শেষবার টুইটে HEAL লিখতে গিয়ে HEEL লিখে বসেছেন ট্রাম্প।
তাবৎ দুনিয়াতে কত ঘটনাই ঘটছে, ইয়েমেনে ছোট ছোট শিশুরা না খেয়ে অনাহারে মরে যাচ্ছে, ঐ দেশে ২০১৫ সালের মার্চে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত আট হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে, অভিবাসীরা দেশ ছেড়ে নৌপথে পালাতে পালাতে ডুবে মরছে, আই এস কিছু দিন পরপর এখানে সেখানে হামলা করছে, ধরে ধরে গলা জবাই করছে, সেই ছবি আবার নেট এ ভাইরাল করছে, এত সবকিছু ফেলে মানুষ পড়ে আছে ট্রামকে নিয়ে! হায়রে মানব সম্প্রদায়!
পত্রিকা রেখে বিরক্ত চোখে বাইরে দেখে রবি, ঢাকা শহরে গত কয়দিন রঙিন ছাতার মেলা। রাশি রাশি ছাতা এবং বাসের জন্য অপেক্ষমান ধৈর্যশীল যাত্রীরা।
ও একটা প্রাইভেট ফার্মের ট্রেইনি ইঞ্জিনিয়ার, চাকরীতে ঢুকেছে আজই তার ছয় মাস পূর্ণ হবে, এইজন্য তার মন আজ একটু খুশি খুশি।
সে ধীর গতিতে গাড়ি ড্রাইভ করছেন যাচ্ছেন রুনার ইউনিভার্সিটির দিকে।
রুনা হচ্ছে কচুপাতার মতন ফ্যাঁকাসে বর্ণের ফর্সা উঁচু নাক উঁচু কপাল আর গালে একটি কালো জন্ম দাগ সমেত মিষ্টি চেহারার মাঝে মাঝে খানিকটা অহংকারী মেয়ে,
তবু তাকেই রবি ভালবাসে। কি করবে! ভালোবাসা তো বুঝে শুনে প্লান করে হয়নি, ভালোবাসা এমনি এমনি হয়ে যায়।
রুনা রবির জীবনে একমাত্র বন্ধু, অত্যন্ত প্রিয়জন এবং প্রেমিকা।
সমস্ত জ্যাম বাঁধা বিগ্নকে অতিক্রম করে ও অবশেষে রুনার ইউনিভার্সিটির প্রধান সড়কে পৌঁছায়, যেখান থেকে রুনার ভার্সিটির গেট সোজাসুজি দেখা যায়, মাঝে মাঝে অফিসে যাওয়ার আগে রুনাকে দেখে যাওয়ার জন্যই রবি এই কাজ করে, কখনো রুনা কাছে এসে কিছুক্ষন কথা বলে, তবে বেশিরভাগ হাই হ্যালো করে চলে যায়। মেয়েটাকে গত চার বছরে চিনতে চিনতেও যেন চেনা হলনা।
মাঝে মাঝে মনে হয় ওকে আদৌ ভালবাসে তো রুনা!
প্রায়ই ওকে কেমন যেন লাগে! কখন কি করে ঠিক নেই! ইদানীং মনেহয় ওদের এটা যেন একটা ঠুনকো সম্পর্ক যেকোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে!
গেটের কাছাকাছি যেতেই রবি রুনাকে দেখে, সে একা একা একটা ছাই রঙের ছাতা খোলার চেষ্টা করতে করতে পা পিছলে পরে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়েছে, ছাতার এক কোনা কি করে যেন ভেঙ্গে গেছে সেটি হাত দিয়ে সোজা করে ধরে রাখতে রাখতে হাঁটার জন্য পা বাড়িয়েছে আবার। আশ্চর্য রবি কে কি দেখেনি!! এখান থেকে ইউনিভার্সিটির গেট মাত্র চার গজ দূরে!
হর্ন দেয় ও।
রবিদের বাড়ি থেকে দুটা ব্লক পড়েই রুনারা থাকে। ওর বাবা সরকারী কর্মকর্তা। দুই ভাই আর দুই বোন বাবা মা নিয়ে ওদের সংসার।
যাই হোক বোঝা যাচ্ছে রুনা ওকে দেখে না দেখার ভান করে আছে!
বোঝা যাচ্ছে কারন সে একটিবার গাড়ির দিকে তাকাচ্ছেই না অথচ ফাঁকা রাস্তা, একটা গাড়ি চোখের সামনে অথচ চোখই পড়বেইনা!!
এ কেমন কথা!
কোত্থেকে যেন ওর কিছু ক্লাসমেট এসে জুটেছে, এখন তাদের সাথেই কুশল বিনিময় ব্যস্ত। নিষ্ঠুর নারী! কিচ্ছু করার নেই এই নিষ্ঠুর নারীকেই ভালবেসে বসে আছে! সহ্য তো করতেই হবে।।
রবি অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করতে করতে বৃষ্টি দেখে, ছোট বেলায় যখন খুব বৃষ্টি হত,ওর বাবার সাথে স্কুলে যেতে যেতে গাড়ির গ্লাস ধুম করে খুলে ফেলত, সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিত ওকে, তখন স্কুল ইউনিফর্ম ভেজার কারনে আর স্কুলে যাওয়া হতোনা। আব্বু গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে যেত। কি যে আনন্দ হত সেই দিনটায়।
ভাবতে ভাবতে ছেলেমানুষি পেয়ে বসে, গ্লাস খুলে চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ায় বাইরে, তখনি এসে হাতটা ধরে ফেলে রুনা, কি হচ্ছে কি? কিছুনা! হাত সরায় রবি! জাস্ট ছেলেমানুষি। মুচকি হাসে রুনা।
- কেমন আছ?
- ভালো
- অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
- তাতে তোমার কি কিচ্ছু আসে যায়?
- আমার আসবে যাবে কেন? অফিস কি আমার? চাকরী তো আমি করিনা।
- সবিই তো বোঝো তুমি। বাদ দাও।
- দিলাম বাদ, শোন আমি তোমাকে কিছু কথা বলবো,
- কি কথা? একটু ভয় লাগে রবির! কদিন ধরেই রুনা কেমন অবহেলা করছে! ওকে নেগেটিভ কিছু বলবে নাতো!
কি বলবে আমার তোমাকে আর ভাললাগছে না, তুমি আমার ইউনিভার্সিটির সামনে আসো কেন?
ওর ইউনিভার্সিটির সামনে আসাটা রুনা যে তেমন পছন্দ করেনা, সেটা ওর ব্যবহারে বোঝা যায়।
রুনা বলছি, বলেই খুব সিরিয়াস চোখ মুখ করে ঝিম মেরে বসে।
- বল আমি শুনছি,
একটু দিধাগ্রস্থ চেহারা নিয়ে রুনা বলে;
- আমি খুব শিগ্রই তোমার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি।
- কি!!
যা ভাবছিল তাই বলল রুনা, ব্রেকআপ! চাকরিটায় আজ ছয় মাস পূর্ণ হল আর আজ কিনা ওর ভালোবাসা কে হারাবে! অথচ রুনাকে ছাড়া ওর জীবন অসম্পূর্ণ!
নানা তুচ্ছ ঘটনায় আজকাল বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে, কেউ হাঁটার সময় স্বামীর চেয়ে এগিয়ে যাওয়ায়, খাবারের টেবিলে বন্ধুকে ভেড়ার মাথা পরিবেশন না করায় মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে পছন্দের অলংকার পায়ে পরার মতো তুচ্ছ ঘটনায় বিবাহ বিচ্ছেদ। পান থেকে চুন খসলেই বিচ্ছেদ। বাস্তবতা জেনে বুঝেও কষ্ট লাগে রবির ওদের তো বিয়েই হয়নি, ওদের বিচ্ছেদ আরও সহজ।
গলা শুকিয়ে আসে ওর। চার বছরের সম্পর্ক, এই চার বছরে রুনা ছাড়া আর কিছু কল্পনাতেই আনেনি, এমন কি রুনার ফাইনাল এক্সাম হয়ে গেলেই বাবা মাকে ওদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে পাঠাবে বলে ঠিক ও করে রেখেছিল, ফাইনাল পরীক্ষার বেশি বাকী ও নেই রুনার, সেই রুনা! বলছে দূরে চলে যাবে!!
চারদিকে ঝাপসা চোখে তাকায়। পৃথিবীর রঙ এখন ধুসর সবকিছু ধুসর, রুনাকে দেখে মনে হচ্ছে ও এখন একটা যন্ত্র মানবী। ধুসর যন্ত্র মানবী! বোতল খুলে পানি মুখে দেয়; খানিকটা খায়; পানির স্বাদ তেঁতো।।
- কি হয়েছে এমন করছ কেন?
রবি চুপ! কথা বলার শক্তি নেই! নিষ্ঠুরের সাথে সাথে রুনা কি একটা ন্যাকা মেয়েতে ও রুপান্তর হয়েছে নাকি! আগে তো ছিলনা! কবে এত সব চেঞ্জ হল রুনার মধ্যে! দূরে যাওয়ার কথা বলে বলছে কি হয়েছে!
- তুমি না বললা আমার কাছ থেকে দূরে যাবা?
- হ্যাঁ তো কি হয়েছে??
দূরত্ব তো মাত্র তো ৪৫০ কিলোমিটারের, বলে শব্দ করে হাসে।
- তুমি কি ভেবেছিলে?
- মানে?
- বাবার বদলি হয়েছে কক্সবাজার! ৪৫০ কিলোমিটার দূর! বুঝলে!!
ধুসর থেকে ধীরে ধীরে রঙিন হয় রবির পৃথিবী। স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করে; বলে,
- তোমার স্টাডির কি হবে!?
-ওটা একটু প্রবলেম বাবা বলেছে ফাইনাল পর্যন্ত ফুফুর ওখানে থাকতে।
তারপরই হঠাৎ ঝংকারের মত রুনা বলে রবির কাঙ্ক্ষিত কথাগুলো,
-তুমি আমায় বিয়ে করে ফেলোনা, বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও এর বাসায় ওর বাসায় থাকার চাইতে নিজের বাসায় থাকা ভালো, কি বলো?? আমায় তোমার পছন্দ তো??
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে চারপাশে, রবি গাড়ির সব কয়টা গ্লাস খুলে দিয়েছে, বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ভিজিয়ে দিচ্ছে সব।।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০১৮ দুপুর ২:৪৪