সন্তান মানুষ করার ক্ষেত্রে মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মায়ের অভিভাবকত্ব শুরু হয় সন্তানকে গর্ভে ধারণের পর থেকে। নিজ সন্তানকে সুস্থভাবে জন্মদান ও জন্মগ্রহণের পর সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সাফল্যের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে মায়ের অবদান বাবার চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিভাবক হিসেবে মায়ের কোন স্বীকৃতি ছিল না এতদিন।
শিক্ষা, চাকরি বা অন্য যে কোন ক্ষেত্রে ফরম পূরণ করার সময় শুধু বাবার পরিচয় দেয়ার বিধান ছিল। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, বাবার পাশাপাশি মায়ের পরিচয়ও দিতে হবে। এরপর সংবিধান, আইন-কানুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মায়ের পরিচিতি দেয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ২৭ আগস্ট ২০০০ সালে। ফলে যে কোন ফরম পূরণ করার ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম উল্লেখও বাধ্যতামূলক করা হয়। তবে অভিভাবক হিসেবে বাবার নামের উল্লেখের বিধান বহাল থাকে।
২০০৭ সালে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ঠাকুরগাঁওয়ের সাগরিকা নামের এক শিক্ষার্থী এসএসসি ফরম পূরণ করার সময় অভিভাবকের ঘরে দায়িত্বহীন পিতার নাম লিখতে অপারগতা প্রকাশ করে। সেখানে সে তার প্রকৃত অভিভাবক মায়ের নাম উল্লেখ করায় তাকে প্রবেশপত্র দেয়া হয়নি সে সময়। অনুরূপ ঘটনা ঘটে জালাল নামের এক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও। সে কখনও অনভিপ্রেত বাবার স্বীকৃতি পায়নি। তাই অভিভাবক হিসেবে বাবার নাম লেখা তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এজন্য তার ফরম পূরণেও জটিলতা সৃষ্টি হয়।
উপরোক্ত দুটো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২ আগস্ট ২০০৯ শুধু মায়ের নাম ব্যবহার করলে কেন ফরম গ্রহণযোগ্য হবে না বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। তাদের এ আবেদনের সূত্র ধরে উপরোক্ত ঘটনা দুটোকে উদাহরণ হিসেবে গণ্য করে আদালত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অভিভাবক হিসেবে বাবার পরিবর্তে মায়ের নামও উল্লেখ করা যাবে বলে এক ঐতিহাসিক রায় দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিভাবক হিসেবে মায়ের এ স্বীকৃতি মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। হাইকোর্টের রায়ের সূত্র ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অভিনন্দনযোগ্য।
মা সারাক্ষণ তার সন্তানকে মানুষ করার জন্য সব ধরনের দুঃখ-কষ্ট হাসিমুখে বরণ করে নেন। এমনকি দায়িত্বহীন পিতার অবর্তমানে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মায়ের যোগ্যতার সঙ্গে পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালনের যথেষ্ট নজির রয়েছে। অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে মায়ের এ অবদান উপেক্ষিত ছিল এতদিন। শুধু বাবাকেই সন্তানের অভিভাবকের মূল নায়ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমাদের সমাজে এমন অনেক বাবা রয়েছেন, যে সন্তানের ভরণপোষণ দূরে থাক, খোঁজ-খবর পর্যন্ত নেন না। সেসব ক্ষেত্রে মা তার সমস্ত সুখ উপেক্ষা করে সন্তানকে মানুষ করার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন একাই। অথচ অভিভাবক হিসেবে শিক্ষা ও চাকরি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাবার পরিচয়ই যেন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়! মা থাকেন উপেক্ষিত সর্বদাই। অভিভাবক হিসেবে মায়ের সপক্ষে হাইকোর্টের এই রায় মায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে নিশ্চয়ই।
তবে শুধু এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীর ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মায়ের নাম উল্লেখ করতে পারবে বলে সরকার যে স্বীকৃতি দেয়, তা কিন্তু অসম্পূর্ণ বলে বিবেচিত হবে আপাতত। কারণ মায়ের অভিভাবকত্ব উল্লেখ করে যেসব শিক্ষার্থী এসএসসি ও এইচএসসির ফরম পূরণ করবে, তারা যখন ভবিষ্যতে উচ্চাশিক্ষা ও চাকরির জন্য ফরম পূরণ করবে তখন কিন্তু অভিভাবকের নাম নিয়ে সে অহেতুক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হবে। কেননা সে তখন নিশ্চয়ই আবার নতুন করে অভিভাবক হিসেবে মায়ের পরিবর্তে বাবার নাম উল্লেখ করবে না। বিষয়টি এখনই ভেবে দেখা দরকার। আবার নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি জরুরিভিত্তিতে সুরাহার জন্য গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এছাড়া এইচএসসি পর্যন্তই শুধু মায়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সন্তানের পরবর্তী ধাপগুলোতেও মা তার ভূমিকা পালন করে থাকেন যথাযথভাবে। সুতরাং উচ্চশিক্ষা, চাকরি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে মায়ের পরিচয় ও অভিভাবকত্ব অগ্রহণযোগ্য হবে কেন?
রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিভাবক হিসেবে মায়ের নাম গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হওয়া মায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এক বড় ধরনের সফল্য। তবে যে কোন অর্জন তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করে, যখন সামাজিকভাবে এর যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। অভিভাবক হিসেবে মায়ের পরিচয়ের স্বীকৃতি বাবার দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অস্বীকার করে না কোনভাবেই। যারা তা মনে করেন তাদের এ ধরনের ক্ষুদ্র মন-মানসিকতা পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। বাবার পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে মায়ের মর্যাদা ও অবদানও যেন সর্বত্র স্বীকৃত হয়, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে।
কৃজ্ঞতায়: শা হী ন আ রা আপা