শোনা যায়, সিলেটের মেয়েরা অনেক সুন্দরী আর পর্দানশীল হয়। তার চেয়েও বড় ব্যাপার বিলাতি টাকা পয়সায় এরা ভরপুর। পর্দার মাঝে লাল টুকটুক এমনই সব পয়সাবহুল মেয়ের প্রেমে পড়ার দক্ষ কারিগর বাবা তাকসির তাই এক কথাতেই রাজী হয়ে গেল সিলেট ভ্রমণ করতে। তবে তার দিনরাত সুখ দুঃখের সঙ্গী রাকিব আমিন ছাড়া সে একপাও নড়বে না। রাকিব আমিনও তার প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধুকে একা ছাড়বে না। তাই এই দুইটাকে রাজী করাতে কোনো কষ্টই হল না আমি, সামির, অনিক আর ইফতির।
সমস্যা হল বিদ্রোহী শোভনকে নিয়ে।ফেসবুক তোলপাড় করে বেড়ানো এই বন্ধুবরকে কিছুতেই কোলছাড়া করতে রাজী নন তার আম্মু। বিদ্রোহীও বাসায় বিদ্রোহ করে বসল। যার ফলাফলে সম্পুর্ণ ঝড়টা গেল আমার উপর দিয়ে। মুখোমুখি হলাম আন্টির, শুরু হল জিজ্ঞাসাবাদ। গ্রামের বাড়ি কই এমন প্রশ্নের উত্তর যখন দেই তখন আমার বুক কেঁপে উঠল এক অজনা আশঙ্কায়। আন্টি না আমার সি,জি,পি,এ জিজ্ঞেস করে বসেন। যাই হোক ভাগ্য ছিলো ভালো, দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে সে যাত্রায় বেঁচে গেলাম। স্টুডেন্ট তথা ছাত্রীদের দ্বারা নিপীড়িত ফর্সা রিফাত নিপীড়নের কথা ভুলতে সহজেই রাজী হয়ে গেল ভ্রমণে। শুরু হল আট জনের অসামান্য ট্যুর।
রাতের ট্রেনে রওনা হলাম আমরা। রিফাত শুরু থেকেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আসছিলো। একটু পর ওর ঘুম সংক্রামক ব্যাধির মতই আর প্রায় সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে । বেশ গোছানো ছেলে সামির(যাকে বিদায় জানাতে মিরপুর থেকে এয়ারপোর্ট স্টেশনে আশার কথা ছিলো তার পরিবারের) কোকের ২ লিটারের বোতলটা বের করতেই সবাই ঘুম থেকে জেগে উঠে। কখনো খাওয়া দাওয়া কখনো আড্ডাবাজী কখনো ঘুমের ফাঁকে ফাঁকে আমরা যখন কুলাউড়া স্টেশন এসে পৌঁছাই তখন প্রায় ভোর ৪টা। একটা রেস্টুরেন্টে কোনো মতে বাকী সময়টুকু কার্ড খেলে পার করলাম, আলো ফুটতেই রওনা হলাম মাধবকুন্ডের পথে।
মাধবকুন্ডে পৌঁছে পুরাই হতাশ হলাম। ঝর্ণার নামে যে পানির ধারা দেখলাম তাকে মূত্রধারা বলে যে কেউই ভুল করতে পারে। যে জায়গায় পানি নিয়ে সবাই দাপাদাপি করে সেই জায়গাটাও সিলেটি আবর্জনায় ভরপুর।
তাও বিয়ে যখন করেছি বাসর রাতে ঢুকেই ছাড়ব। নেমে পড়লাম পানিতে। শুরু হল দাপাদাপি। মায়ের ছেলে বিদ্রোহীকে নিয়ে "রিতা আমার রিতা, তুমি আমার মিতা" টাইপ খেলা শুরু হল। দেখলাম রূপ-লাবণ্য, না না কোনো নারীর রূপ নয়। এ আমাদের ভ্রমণ সঙ্গী অনিক আর রিফাতের অমায়িক রূপ-লাবণ্য।
এরা পানিতে ভিজে সকালের সোনালি আলোয় এতটাই ফর্সা হয়ে গেল যে মনে হল আমরা কোনো মেনজ একটিভ এর শুটিং স্পটে এসে পৌঁছেছি। ইফতি তার ভূঁড়ি সমেত পানিতে ডুব দিয়ে বারবার সাঁতার কাটার ব্যর্থ চেষ্টা করল। সামির আঙ্গুল দিয়ে পানি নিয়ে এক বিশেষ খেলা দেখিয়ে আমাদের মুগ্ধ করল। চিকচিক আলোতে আমার মাথার ক্ষুদ্র টাকটি চকচক করে উঠল, মাথা পরিণত হল বন্ধুদের তবলাতে।
প্রায় এক ঘন্টা দাপাদাপি করে কাঁপতে কাঁপতে পানি থেকে উঠলাম। ফ্রেশ রুমে সবাই এক সাথে গোসল করবে কি করবে না এ নিয়ে চলল কথা কাটাকাটি। লাজুক রাকিবের প্রবল তোপের মাঝে সিঙ্গেল গোসল সেরে নিয়ে রওনা হলাম শ্রীমঙ্গলের পথে।
শ্রীমঙ্গলে পৌঁছেই আমরা সাত রঙ্গা চা পরখ করে দেখলাম। এই চা কীভাবে বানায় তা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা চলল, মনে হল এই চা সবাই প্রতি বেলায় বেলায় বানায় আর দাঁত কেলিয়ে খায়। চলল বিভিন্ন পোজের ফটোসেশন। চা পর্ব শেষে রওনা দিলাম হিডের রেস্ট হাউজে। এই রেস্ট হাউজে যাওয়ার রাস্তাটা খুব উপভোগ করলাম। নিকষ কালো অন্ধকারে সাপের মত আঁকাবাঁকা এই রাস্তার স্তব্ধতা সত্যিই যেন অনেক কিছু বলছিলো। রেস্ট হাউজে পৌঁছেই শুরু হল কার্ড খেলার আসর। সবাই যখন কলাকলিতে ব্যস্ত, খেলায় যখন টানটান উত্তেজনা তখনই হঠাত পাশের রুম থেকে তাকসির এসে ১৮+ জিনিস খোঁজা শুরু করল। সামির হয়ত তাকসিরকে শান্ত করতে পারত, কিন্তু সে ঘুমিয়ে পড়ায় অদম্য ইচ্ছাটাকে মেরে ফেলেই ঘুমাতে হল তাকসিরকে।
পরদিন গেলাম মাধবপুর লেকে। সিলেটি ইফতির স্বৈরাচারী ইচ্ছায় মরুরূপ পাহাড় ঘুরতে ঘুরতে আমরা যখন ক্লান্ত তখন ইফতি আর রিফাত গেল মধু কিনতে, শিকার হল এক অভাবনীয় প্রতারণার। মধু বিক্রেতার মধুর কথা সরল মনে মেনে নিয়ে দুইজন মিলে কিনে ফেলল প্রায় হাজার টাকার মধু। এরকম নিশ্চুপ বলাৎকার চুপি চুপি হজম করল দুইজন, আমরা হাসব না সান্তনা দিব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
দুপুরে খুব অল্প সময়েই ঘুরে ফেললাম লাউয়াছড়া। গাইড ছাড়া ঘুরতে থাকায় পথ হারিয়ে ঢুকে পড়লাম এক লেবু বাগানে। সেখানে আপন মনে লেবু ছিঁড়তে গিয়ে খেলাম ভয়ানক ঝাড়ি। বিকালের পড়ন্ত আলোয় বাস, রিকশা করে চলে আসলাম বাস স্টেশনে। এবার ফেরার পালা।
সময় থেমে থাকবে না। আর পাঁচ-দশ কিংবা পনেরটা বছর পরে যখন বউ-বাচ্চা নিয়ে সিলেট ঘুরতে যাব তখন হয়ত মনে পড়বে এ দিনগুলোর কথা, যেমনটা পড়ছে এখন।