সন্ধা ৭ টায় ট্রেন থেকে নেমে, ইজি বাইকে চেপে আনন্দ-উল্লাস করতে করতে বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছিল অরণ্যরা। আনন্দটা ছিল, দের ঘণ্টা দেরী করে ঢাকা থেকে ট্রেন ছাড়ার পরেও সৈয়দপুরে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর। অথচ বেশ লম্বা ১০ ঘণ্টার একটা ট্রেন ভ্রমণ ছিল! যেটা আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়না।
বিলাসকে জিজ্ঞাসা করা হল। বাস স্ট্যান্ড থেকে কতক্ষণ পরে বাস পাওয়া যাবে? ১৫-২০ মিনিট পরে, বিলাসের উত্তর। বাহ সবাই আরও উচ্ছ্বসিত হল এতে, যাক বেশিক্ষণ তবে অপেক্ষা করতে হবেনা। ব্যাস ১৫ মিনিটের মধ্যে চলে এলো ওরা সৈয়দপুর বাস স্ট্যান্ডে। যেখান থেকে ঢাকার বাস পাওয়া যাবে, ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় যাবার, যে বাসগুলো আবার ঢাকা থেকেই আসে। সুতরাং সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে অপেক্ষা করতে লাগলো ঢাকা থেকে আসা বাসের জন্য।
এভাবে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরেও যখন কোন বাসের দেখা পাওয়া যাচ্ছিলোনা, তখন একজন পরামর্শ দিল বিআরটিসি বাসের খোঁজ নিতে, যেটা রংপুর থেকে পঞ্চগড় যায়। খোঁজ নেয়া হল, তবে হতাশ হতে হল, কারণ বাস পাওয়া যাবে তবে সিট পাওয়া যাবেনা। অন্তত দুই ঘণ্টার পথ, দাড়িয়ে কি যাওয়া যায়! তার উপর ঢাকা থেকে টুরিস্ট বেশে এসেছে ওরা, হাফ প্যান্ট-টি সার্ট-ক্যাপ-কাঁধে ব্যাগ! তাই, কেমন দেখাবেনা ব্যাপারটা! সবাই কেমন আড় চোখে তাকাবে আর মিটিমিটি হাসবেনা, কি অসস্থিকর হবে সেটা! নিজেদের কাছেই নিজেদের স্ট্যাটাসের ব্যাপার-স্যাপার...!!
তাই বিআরটিসি চলবেনা। হতে হবে ভালো বাস! তবে অপেক্ষা কর, যতক্ষণ না ঢাকার বাস আসে। ঢাকার এসি বাস হলে আরও বেশী ভালো হয়! শুরু হল অপেক্ষা আর অপেক্ষা... বেশ কিছু সময়, প্রায় ২৫ মিনিট পরে একটা ঢাকার বাস এলো, কিন্তু থামলো বেশ দূরে, তাই সবাই মিলে দে দৌড়...! এক দৌড়ে বাসের কাছে গিয়ে চরম হতাশ হতে হল! কেন? কারণ এটা পঞ্চগড় যাবেনা, যাবে দিনাজপুর! সুতারং আবার সবাই ফিরে এসে বেঞ্চিতে বসে পড়লো! আবারো অপেক্ষা...
আবারো দূরে একটা ঢাকার বাস থামলো, আবারো সবাই এক দৌড়ে বাসের কাছে গিয়ে হতাশ হল, কারণ এটাও পঞ্চগড় বা ঠাকুরগাও যাবেনা, অন্যদিকে যাবে! সুতরাং আবারো পুরনো জায়গায় ফিরে গিয়ে হতাশা প্রকাশ করা। এভাবে তিন-চারবার বাসের কাছে গিয়ে ফিরে-ফিরে আসাতে ধীরে-ধীরে একটা কষ্ট আর মনোবেদনার জন্ম হল ভেতরে-ভেতরে। কেটে গেল বেশ কিছু সময় প্রায় দেড় ঘণ্টা!
বাসের দেখা নেই। পরে খোঁজ করা হল কোন মাইক্রো পাওয়া যায় কিনা, ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত। নাহ, সেও এই এতো রাতে পাওয়া যাচ্ছেনা।
শেষমেশ এই চেষ্টাও করা হল, যে কোন পিক আপ বা ট্রাকের পিছনে যদি যাওয়া যায়, তাতেও চলবে এখন! এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে একটা ঢাকার এসি বাস এসে থামলো! এবার আর সবাই হুড়মুড় করে এগিয়ে না গিয়ে, একজন এগিয়ে গিয়ে সুপারভাইজারকে ম্যানেজ করলো, সবাইকে ঠাকুরগাঁও পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য। সেই সংকেত পেতেই সবাই দে দৌড়, দে দৌড়! একজন উঠেও গেল, একসাথে ছয়জনকে দেখে ড্রাইভার আর গাড়ি থামালোনা! সুতরাং একটু সামনে গিয়ে যে উঠেছিল সেও নেমে পড়লো!
তাই আবারো অপেক্ষা......
অপেক্ষা এবার রাগ-ক্ষোভ আর ক্রোধে রূপ নিতে লাগলো! সেই সাথে এমন মন্তব্যও, কেন দেশের এতো এতো যায়গা রেখে এই উত্তর বঙ্গের মফস্বলে আসতে গেলো! কি দরকার ছিল, বাস নাই, মাইক্রো নাই, জীপ নাই, ট্যাক্সি নাই, পাহাড় নাই, সমুদ্র নাই, বীচ নাই, তার উপর নাই ভালো মানেই কোন হোটেলও, যে রাতটা এখানেই থাকা যাবে! এই রাতের বেলায় হাইওয়ের বেঞ্চিতে বসে-বসে ধুলা খাচ্ছে! ডুবে যাচ্ছে ধুলার সাগরে! ওহ কেন যে এসেছিল, কিজে হবে এখন?
অথচ রাত তখন মাত্র ৮:৩০টা! এমন আহামরি কোন বিপদেও কেউ পরেনি, তাতেই এমন অবস্থা হয়েছিল যে সারাদিনের ভ্রমণ আনন্দ আর উচ্ছাস শেষে বিষাদে রূপ নিয়েছিল! তাই বাসের জন্য অপেক্ষা করে করে ধুলোর সাগরে কাটিয়ে দেয়া সেই দুই ঘণ্টার নাম দেয়া হয়েছিল “ভ্রমণে বিষাদ!”
অবশেষে ওরা পেয়েছিল একটি ঢাকার বাস, সব খারাপ বা বিষাদের পরে যেমন আসে ভালো সময় ও আনন্দঘন মুহূর্ত ঠিক তেমনি, না তেমন নয়, ওরা পেয়েছিলো সাধারণ আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের চেয়েও বেশী, অনেক-অনেক বেশী একটা রাজকীয় অভ্যারথনা আর আপ্যায়ন! যেটা কোন রকম ভাবনার বাইরে ছিল!
কি ছিল সেই রাজকীয়তা? সেই গল্প বলবো অন্য দিন!
সেই রাতের রাজকীয় পর্বের নাম দেয়া হয়েছিল......
“ছয় প্লেট কাচ্চি! আর হাফ কেজির কালা ভুনা!!”
ছবি পোস্ট করা যাচ্ছেনা!!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১২:১৯