আচ্ছা পাহাড় কি কখনো নীল হয়? কেউ কি দেখেছেন কখনো? একটু অদ্ভুত তাইনা? কিন্তু না, পাহাড়ও নীল হয়,হ্যাঁ হয়! অন্তত কিছু সময়ের জন্য কখনো কখনো মোহময় নীল ছুঁয়ে যায় সমস্ত পাহাড়কে, সে এক অপার্থিব নীল। যে নীল চোখে লেগে থাকে, মনে গেঁথে থাকে, হৃদয়ে ছবি এঁকে রাখে। যে নীল পাহাড়ের দিক থেকে চোখ ফেরাতে মন চায়না, যা দেখার পরে চোখে বুজতে এমনকি চোখের পলক ফেলতেও দ্বিধা জাগে! ইস একটি মুহূর্তও যদি হারিয়ে যায় চোখের সামনে থেকে!
আর ঘুম? সেতো তখন অপরাধী হয়ে চোখের কাছে ক্ষমা চায়! ক্লান্তি? যেন অনুশোচনায় ভোগে! ক্ষুধা? নিজেকে অনুভূতিহীন করে চুপ করে থাকে! চেতনা? তখন বোধ লুপ্ত হয়! হ্যাঁ ঠিক এমনই ছিল সেই নীল পাহাড়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা মুহূর্ত-ক্ষণ বা সময় টুকু...... তবে শুনি সেই “নীল পাহাড়ের!” অদ্ভুত গল্পটি......
সিমলা থেকে মানালি গিয়েছিলাম হেলতে-দুলতে দুলতে! কারণ পাহাড়ের এতো এতো বিচিত্রতা কোন রকম ভাবনার বাইরে ছিল! কথা সবুজের ছোঁয়া মাখা পাহাড়, কোথাও ধূসর পাহাড়, কোথাও কালো বা কোথাও খয়েরি পাহাড়! আর একটু ওপরে তাকালেই একরাশ মুগ্ধতা ও মোহময় আকর্ষণ ছড়ান শ্বেত শুভ্র বরফে আচ্ছাদিত ঝলমলে পাহাড়! সূর্যের আলোর বিচ্ছুরণ আর মেঘে ঢেকে গিয়ে ক্ষণে ক্ষণে পাহাড়ের রঙ আর ঢঙের বদল দেখতে দেখতে যেন সুখে বিমর্ষ হয়ে পড়ছিলাম! এক এক সময় শ্বেত শুভ্র পাহাড়ের চুড়াগুলো এক এক রঙ ধারন করে চলেছে ক্ষণে ক্ষণে!
কখনো তীব্র সূর্যের আলোতে সোনালি, কখনো ক্ষীণ আলোতে আর মেঘ-ছায়াদের লুকোচুরিতে হলুদ, কখনো পুরো মেঘে ঢেকে গিয়ে আর সূর্যকে আড়াল করে ধূসর! বিকেলের হেলে পড়া সূর্যের আলোতে কখনো গোলাপি, কখনো লাল, কখনো বেগুনী! অদ্ভুত সব রঙের খেলায় মেতে উঠেছিল ওই বরফে বরফে মোড়ানো পাহাড়গুলো, সূর্যের হাসি আর ছায়াদের লুকোচুরিতে! তখনই মাথায় খেয়াল এলো পাহাড়ের এতো-এতো রঙ দেখলাম শুধু নীল ছাড়া! মনে-মনে মনকেই জিজ্ঞাসা করলাম আচ্ছা পাহাড় কি তবে নীল হয় কখনো?
শেষে সন্ধা নামলো কুলু থেকে বিপাশা নদী শেষ বারের মত পেরনোর পরে। মাথায় তখন কোন “নীল পাহাড়!” দেখার একটা অদ্ভুত স্বপ্ন বা অনাকাঙ্ক্ষিত চাওয়া! আবার নিজেকেই নিজে প্রবোধ দেয়া, ধুর পাহাড় কখনো নীল হয়না। কিভাবে হবে? তবুও কেন যেন মাথায় গেঁথে গেল একটা “নীল পাহাড়!” দেখার সুখের বাসনা। বিভোর তখন “এক নীল পাহাড়ের!” স্বপ্নে!
ঝমঝমে শব্দে লোহার ব্রিজ পেরিয়ে মানালিতে ঢুঁকে ভীষণ ক্লান্ত মন-প্রান সবকিছু। হোটেলে গিয়ে এলিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছুই নেই ভাবনাতে। তাই হল। হোটেলে গিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লাম নরম তুলতুলে বিছানায় আর জড়িয়ে নিলাম উষ্ণ আরামের কম্বল। একটু ঘুমিয়ে ক্লান্তি দূর করে নেই। ক্ষুধা দূর করতে উঠতেই হল কিছু সময় পরে। একটু ফ্রেস হয়ে বের হলাম মানালির মল রোডের দিকে যাবার জন্য।
হোটেলের নিচে নামতেই সিঁড়িতে তার দেখা পেলাম! যার জন্য এতদূর আসা। সেই বরফ। বেশ শিহরিত অনুভূতি।
এরপর দুপাশে বরফের স্তূপ আর ছোট ছোট দোতালা বাড়ির চিকন পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি, আশে-পাশে, কাছে-দূরে দাড়িয়ে কালো কালো পাইন গাছের লম্বা লম্বা দেহ। সেদিকে চোখ পড়তেই চোখ আটকে গেল। কেন? কারণ, কালো পাইনের ফাঁকে ফাঁকে নীল নীল আলোর বিচ্ছুরণ! কিছুই বুঝতে পারছিনা, কালো লম্বা পাইনের বনে কিভাবে নীলের সৃষ্টি হল? হবে হয়তো মানালির বিশেষ কিছু। যাক সে নাহয় সকালে দেখা যাবে, এখানেই তো আমাদের হোটেল। চলে গেলাম সেই পথ ধরে সামনের দিকে।
বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে দূরে তাকাতেই থমকে গেলামনা, আসলে থমকে যেতে বাধ্য হলাম...... দূরে যতদূর দৃষ্টি যায়, নীল নীল আর নীল! কিন্তু দূরে তো পাহাড়, তবে সেটা নীল হল কিভাবে? সারাদিন এতো রঙের পাহাড়ের দেখা পেলাম বা পাহাড়ের এতো এতো রঙ বদলের খেলা দেখলাম, কই নীল পাহাড়তো চোখে পড়েনি! মনে মনে কত খুঁজলাম “একটি নীল পাহাড়!” পেলামনা তখন, বেশ আক্ষেপ ছিল মনে অত রঙের পাহাড় দেখার পরে “নীল পাহাড়!” না দেখাতে, বা দেখা না পেয়ে!
তবে কি বিধাতা “নীল পাহাড়ও!” রেখেছেন দুনিয়াতে! হ্যাঁ তাই-ই। এটা “নীল পাহাড়-ই!” ধপধপে আকাশে ঝকঝকে চাঁদের রূপালি জ্যোৎস্না, বরফে-বরফে ঢেকে যাওয়া সাদা-সাদা পাহাড় গুলোতে রূপালি জ্যোৎস্নার প্রলেপ পড়ে ওরা নীল হয়েছে! সমস্ত পাহাড় যেন মুড়ে গেছে নীল-নীল রঙে! ইস কি অপার্থিব ঝকঝকে চাঁদের রূপালি জ্যোৎস্না মেখে বরফে মোড়া পাহাড়গুলো সব নীল হয়েছে!
চারিদিকে শুধু নীল নীল আর নীল পাহাড়! যেদিক থেকে চোখ ফেরানো দায়! মন সরানো অসাধ্য! আর অন্য কোন ভাবনা অসম্ভব!
সময় তখন স্থির! ক্ষণ তখন স্তব্ধ! আর ক্ষুধা তখন সুদূরের কোন স্বপ্ন! সকল পার্থিব অনুভূতি তখন অনুভূতিহীন! দেখে ও পেয়ে এই অপার্থিবতা! থমকে ছিলাম, উপেক্ষা করে হিম ঠাণ্ডা আর কনকনে শীত! ছিলাম অপলক তাকিয়ে, কতক্ষণ কে জানে....!!
দেখে....... “রূপালি জ্যোৎস্নায়, নীল পাহাড়!”