ছবিঃ সংগৃহীত
বেশিদিন হবে না এক মাস আগের কথা একটা বৃদ্ধা মহিলাকে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করার একটা কাজ এসেছিলো। সন্তানদের কাছে দিয়ে না আসতে পারলেও একটা সেফ জায়গায় দিয়ে এসেছিলাম। সেটা হলো বৃদ্ধাশ্রম। অনেকের কাছে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে তার ছেলেদের থেকে বৃদ্ধাশ্রমের স্টাফরা বেশি ভালো। আর কিছু না করুক তার খেয়াল রাখবে।
' বিজয় বাংলাদেশ ' নামের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ভলান্টিয়ার ও ঢাকা জোনের সাধারণ সম্পাদক আমি। মানুষের জন্য অনেক বড় কিছু না করতে পারলেও খুব ছোট ছোট কাজ করেই অনেক বেশি শান্তির অনুভব করতে পারি। হয়তো অনেক বেশি সামর্থ্য থাকলে আরো বেশি কিছু করতাম। কিন্তু সমাজের নিয়মটাই কিছুটা অন্য রকম। কারণ এই সমাজে ধনীরা যতটা গরিবদের সাহায্য করার মনোভাব দেখায় তার চেয়ে বেশি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকই দেখায় কারণ একজন গরিবই বোঝে আরেকজন গরিবের কষ্ট।
আমরা যারা এইরকম কাজ করি তার বেশি কিছু চাই না। চাই শুধু কারো একজনার দোয়া ও একটু প্রশংসা, বাহবা। আমি কখনো ভাবিনি যে আমার সেই কাজের বাহবাটা একটা গল্প আকারে পাবো। ' বিজয় বাংলাদেশ ' সংস্থার চেয়ারম্যান মোহাসিনা আপু যখন নিম্নের ঘটনাটা ( আমি যে কাজটা করেছিলাম ) একটা গল্প আকারে প্রকাশ করলো তখন আমি পোস্টটা দেখে মনে একটা তৃপ্তি অনুভব করলাম। আমার এমনিতেই একটা জিনিস খুব পছন্দ সেটা হলো কোন ভালো কাজ করে সেটার ক্রেডিট না নেওয়া বরং সিক্রেট হিরো হয়ে থাকতে চাই। কারণ সমাজটা অনেক নোংরা লোকে ভর্তি কোটু কথা বলা লোকের অভাব নেই। আর আমি কোটু কথাকে অনেক বেশি অপছন্দ করি।
নিম্নে সম্পূর্ণ ঘটনাটি সংক্ষেপে দেওয়া হলো ----
-----চাওয়া-----
কলেজ থেকে বাসায় ফেরার জন্য বাসে উঠেছে আরিয়ান । ভাগ্যক্রমে একটা সিটও পেয়ে গেল। অবশ্য না পেলেও সমস্যা ছিল না। দাঁড়িয়ে যাওয়া আসা করতে করতে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে বরং বসলেই কেমন অস্বস্তি হয়। পাশের সিটে এক বৃদ্ধা বসে আছে। চেহারায় ক্ষুধা ও বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। ওর ব্যাগে একটা কেক আছে, টিফিনের সময় খাওয়া হয়নি কেকটা। বোতলে পানিও আছে। ইচ্ছে করছে বৃদ্ধাকে কেকটা দিয়ে দেয়। তাতে যদি সামান্য হলেও ক্ষুধা মেটে। বৃদ্ধা জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান বলল,
- খালাম্মা, আপনার মনে হয় খুব ক্ষুধা লেগেছে। এই কেকটা খেয়ে একটু পানি খান।
বৃদ্ধা কিছু না বলে কেকটা খেয়ে একটু পানি খেল।
কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে এলো।
-ভাড়া দেন খালা।
-আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নাই বাজান।
-টাকা পয়সা নাই বললেই হবে? বাসে উঠছেন ভাড়া দিবেন না?
বৃদ্ধা অসহায় দৃষ্টিতে কন্ডাক্টর এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আরিয়ান পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে বাড়িয়ে দিল। নেও মামা ওনার ভাড়াটাও রেখে দেও।
-কই নামবেন খালা?
-তা জানি না। এক জায়গায় নামায়া দিও বাবা।
আরিয়ান এবার বলল,
- আপনি কোথা থেকে এসেছেন, খালাম্মা।?
- নরসিংদী থেকে ট্রেনে উঠছিলাম। তারপর এই বাস পাইয়া উঠলাম।
-যাবেন কোথায়?
-তা তো জানি না বাবা। এখানে তো আমার কোন আত্মীয় নাই। বৃদ্ধদের থাকার তো কত জায়গা আছে শুনেছি, কোন জায়গার ঠিকানা জানো?
- আপনার বাড়ির ঠিকানা জানেন? আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব।
-না না বাবা এ কথা বলিও না। আমি আর কোনদিন বাড়িতে ফিরে যাব না।
আরিয়ানের নামার সময় হয়েছে। বৃদ্ধাকে বলল,
-চলেন আমার সাথে। আমি এখানেই নামব।
বলেই হাত ধরে বৃদ্ধাকে ধরে ধরে বাস থেকে নামাল সে।
বৃদ্ধ হলেও মহিলাটি একেবারে বৃদ্ধ নয় ,বয়সও হয়তো ৭০ এর বেশি নয়। চলাফেরা ভালোই করতে পারে। আর কথা বার্তায়ও যথেষ্ট ভদ্র-শিক্ষিত ফ্যামিলির মনে হচ্ছে।
-আমাকে একটা থাকার জায়গা খুঁজে দেও বাবা।
তোমাকে অনেক দোয়া করব।
- কিন্তু এখন তো বিকেল শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রায়। কিছুক্ষণ পর রাত নেমে আসবে। আপনার ছেলে মেয়ে কারও ফোন নাম্বার আছে?
- আমার ছেলের কথা আর বলিও না বাবা, ওদের সাথে আর কোনদিন যোগাযোগ করবো না। এতে ওরা বরং খুশিই হবে। আপদটা তো বিদায় হলো!
-আপদ? বৃদ্ধ বয়সে মা কি সন্তানের কাছে আপদ হতে পারে?
-সবার কাছে না হলেও কারো কারো কাছে হয় বাবা।
আরিয়ান মহিলাটিকে কিছুতেই বাড়ি ফিরতে রাজি করতে পারল না। উত্তরা একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে কিন্তু সেখানে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। আগামীকাল সেখানে নিয়ে যাবে ভেবে উনাকে নিয়ে বাসায় রওনা দিল। সমস্যা হচ্ছে বাসায় আম্মু আব্বু নেই, শুধু বড় আপু আছে । একটু ভয় ভয়ও করছে। অপরিচিত একজন মানুষকে এভাবে বাসায় নিয়ে রাখাটা কি ঠিক হবে? আল্লাহর উপর ভরসা করে মহিলাকে বাসায় এনে রাখল।
.
বাসায় এসে ওনাকে ভালো করে ভাত খাইয়ে বিছানা করে দিল শোবার জন্য।
আরিয়ানের মনে মনে ইচ্ছে জাগল ছেলেদের সাথে ওনার কী হয়েছে তা জানার জন্য। কিন্তু বৃদ্ধা যদি বিরক্ত হয় এই ভেবে কিছু বলল না। বিছানা করে দিলেও বৃদ্ধা শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল না। একা একা বারবার করে কী যেন বলতে লাগল আর কাঁদতে লাগল। পড়া বাদ দিয়ে আরিয়ান ওনার কথা শোনার চেষ্টা করল।
- মানুষে খালি ছেলে ছেলে করে। আমিও তো একসময় করতাম। ছেলে হয় না দেখে খুব আফসোস ছিল। আহারে বুড়াকালে কে দেখবে? ছেলে তো সেই হলো। তাও একটা না , দুই দুইটা। কত আদর যত্ন করে লেখাপড়া শিখলাম, কিন্তু মানুষ করতে পারলাম না। বাপটা তো গেল কিন্তু আমি? আমারে আল্লায় নিল না। আল্লায় আমার ছেলের শখ মিটাইব, নাহলে এই বয়সে ছেলে থাকতে এত কষ্ট দিব কেন? বিয়া করল, বৌ পাইল, ছেলে মেয়ে পাইল আর মায়রে ভুইল্লা গেল। বৌয়ের কথায় মায়রে মারতে আসে। আল্লাহ তুমি ওদের সুখে রাখো আল্লাহ!!
এর পর বৃদ্ধার স্বর ক্ষীণ হয়ে আসে। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। আরিয়ানের বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। এ কেমন ছেলে! কত কষ্ট পেলে, এই বয়সে নিজের পরিবার ছেড়ে কেউ চলে আসে বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজে?
.
সকাল বেলা উঠেই আরিয়ান দেখল আপু নাস্তা বানিয়ে রেখেছে। খেয়ে দেয়ে বৃদ্ধাকে নিয়ে রওনা দিল বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশ্যে। পথে পথে শুনল বৃদ্ধার জীবনের কাহিনী। শুনতে শুনতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল ওর। দুই ছেলে আর একটা মেয়েকে নিয়ে জীবনে কত কষ্টই না করেছেন উনি। মেয়েটা মরে গেছে আর ছেলেরা সেসব কষ্টের দিনের কথা ভুলে গেছে। হায়রে পৃথিবী! একদিন তো এই ছেলেরাও বৃদ্ধ হবে, সে কথা কেন তারা বুঝতে পারে না।
বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছে এই বৃদ্ধদের চাওয়া কী খুব বেশী? শেষ বয়সে একটুখানি শান্তিই তো চায়।
.
(কয়েকদিন আগে এক মা কে উত্তরার আপন নিবাসে রেখে এসেছে আবদুল্লাহ আল ইমরান। সেটাই লিখলাম আরকি! )
উপোরক্ত ঘটনাটি মোহাসিনা আপু খুব হাইড আমার কাজের কথা লিখেছেন। তাকে ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষা আমার কাছে নেই। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বিবেকবোদ থাকা অত্যন্ত জরুরি যেটা তার সন্তানদের মধ্যে নেই। সারাটা জীবন কত কষ্ট করে ছেলে দু'টোকে মানুষ করলো আর আজ সেই ছেলেদের কারণে ঘর ছাড়া হতো হলো অভাগিনী মা'টাকে।
এই বিষয়ে আপনার কোন মন্তব্য বা আপনি যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান তাহলে যোগাযোগ করুন এই ঠিকানায় -
• facebook.com/BijoyBangladeshOrganization
• facebook.com/we.bijoy
[ বিঃদ্রঃ মহিলাটি এখনো উত্তরার আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে আছে তার ছেলেরা তাকে ফেরত নিতে ইচ্ছুক নন ]
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৫