১১ রবিউস সানী পবিত্র ফাতেহায়ে ইয়াজ দহম পালন করা হয়। এই দিনেই হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা. ইন্তেকাল করেন। আবদুল কাদের জিলানী রা. কে এই উপমহাদেশে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। মুসলমানরা তার নাম জানেন। এক সময় ওয়াজ মাহফিলে তার কারামত শুনতে অভ্যস্থ ছিলেন এঅঞ্চলের মানুষ। সুন্নী মুসলমানরা গলা ছেড়ে কাসিদায়ে গাউসিয়া পড়েন- আসসালাম আয় নূরে চশমে আম্বিয়া, আসসালাম আয় বাদশাহে আউলিয়া। আবদুল কাদের জিলানী রা. হলেন আউলিয়াদের বাদশাহ ।
ফাতেহায়ে ইয়াজ দাহম ফার্সি শব্দ। ইয়াজ দাহম এর অর্থ এগারো তারিখ। ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম অর্থ এগারো তারিখের ফাতেহা শরীফ। সুন্নী সুফী মুসলিমরা সাধারণত এই দিনগত রাতে হামদ, তাসবিহ, ক্বিরাত, ধর্মীয় সভা, না'ত পাঠ করে থাকেন। এছাড়াও পরিবারে ও অন্যান্য সামাজিক জমায়াত করেন। রাস্তাঘাট ও বাড়ির সাজসজ্জার মাধ্যমে উদযাপন করে থাকেন। তারা গেয়ারভী শরীফ পড়ে থাকেন। খতেমে গাউসিয়া পড়ে থাকেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা. এর অনেক উপাধি ছিল। গাউসূল আজম, বড় পীর, মাহবুবে সোবহানী, মহিউস সুন্নাহ, কুতুবে রাব্বানী, ইমামুল আউলিয়া, সৈয়দ, মীর, মহিউদ্দিন, কামিউল বিদায়াত, নূরে হক্কানী, পীরানে পীর, দস্তগিরসহ অনেক নামেই তাকে ডাকা হয়। আমরা তাকে গাউসুল আজম দস্তগীর নামেই জানি।
গাউসুল আজম অর্থ বড় সাহায্যকারী। এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেন, সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী হলেন আল্লাহ। সেখানে তাকে কীভাবে গাউসুল আজম ডাকতে পারি। আমি একটা কথাই বলি, যেভাবে হযরত আবু বকর রা. সিদ্দীকে আকবর; হযরত ওমর ফারুক রা. ফারুকে আজম; হযরত ওসমান রা. গনী সেভাবেই হযরত আবদুল কাদের রা. গাউসুল আজম। তাছাড়া আল্লাহর নিরানব্বইটা নামের যত গুণ রয়েছে, সেগুলো তো প্রতিদিন আমরা মানুষকে বলে থাকি। যেমন তুমি আমাকে সাহায্য করেছো। তুমি দেখেছো। আনতা বাসির। তুমি শ্রোতা। আনতা সামী। এ কারণেই আল্লাহর সাথে সবকিছুতে তুলনা করা ঠিক নয়। তাহলে কারো প্রশংসাও করতে পারবোনা।
যাই হোক ফাতেহায়ে ইয়াজ দাহমের দিবসটি বাংলাদেশে ঐচ্ছিক ছুটি। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকে। আল্লাহর নবীর পর চার খলিফার কোনো জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী সরকারিভাবে পালন করা না হলেও হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রা. এর ওফাত দিবস সরকারিভাবে উদযাপনের কারণ রয়েছে। এদেশে যে ইসলাম এসেছে তা সুফিবাদের ইসলাম। তরিকতের ইসলাম। এদেশের মানুষ মোটামুটিভাবে কাদেরিয়া তরিকা, চিশতিয়া তরিকা, নকশবন্দিয়া তরিকা, মোজাদ্দেদিয়া তরিকা ও সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার অনুসারী। হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা. ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার প্রবর্তক। আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ দ. হতে এই আধ্যাত্মিক সিলসিলার উদ্ভব হয়েছে। তারপর হযরত আলী রা.-হাসান ইবনে আলী রা.-হোসাইন ইবনে আলী রা.- আলী ইবনে হোসেন জয়নুল আবিদীন রা.-মুহম্মদ আল-বাকির রা.- জাফর আস-সাদিক রা. হয়ে হযরত আবদুল কাদির জিলানী রা. পর্যন্ত পৌঁছেছে। এদের মধ্যে জাফর আস সাদিক রা. শিয়াদের বারো ইমামের একজন ইমাম। তাকে শিয়ারাও মান্য করে। সুন্নীরাও মান্য করে। তিনি হযরত ইমাম আবু হানীফা রা, এর শিক্ষক ছিলেন। তবে প্রতিটি তরিকাই হযরত আলী রা. হয়ে হযরত মুহাম্মদ দ. পর্যন্ত পৌঁছেছে।
যাই হোক কাদেরিয়া তরিকা সম্পর্কে একটু ধারণা দেই। হযরত মুহাম্মদ দ. হতে শুরু করে তরিকাতে খেলাফত প্রাপ্ত ১৮ তম আধ্যাত্মিক খলিফা হলেন গাউসুল আজম হজরত বড়পীর আবদুল কাদির জিলানী রা.। আমরা যে কালেমা পাঠ ও বিশ্বাস করে সে অনুযায়ী আমল করে মুসলমান হই- সেটি কালেমা তাইয়্যেবা। কালিমার একটি অংশ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এই কালিমার নোক্তাবিহীন এই ১২টি বর্ণ নিয়ে কাদেরিয়া তরিকায় খাস তালিম দেয়া হয়। এই নোক্তাবিহীন ১২টি হরফের মধ্যে পৃথিবীর যত রহস্য। এই ১২টি হরফই বিশ্ব জগতের মূল কারণ ও উৎস। তৌহিদের প্রকৃত রূপও এই কালেমা। নোক্তাশূন্য বর্ণ দিয়ে কালেমার সৃষ্টির রহস্য জানার চেষ্টা করতে হয়। এই কালেমাকে জানলে, চিনলে ও সঠিকভাবে গবেষণা করে পড়লে তার নিকট সকল রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়ে যায়। এই কালেমা বিশ্ব মহীরুহের মূল ও নূরে মুহাম্মদীর মূল উৎস। কালেমার পরের অংশ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এখানেও নুক্তা ছাড়া ১২টি হরফ। সমান সমান। কী এক রহস্য এই কালেমায় লুকিয়ে রয়েছে! এই তালিম না পাওয়া পর্যন্ত কেউ কাদেরিয়া তরিকার সুফি-সাধক ও পীর হওয়ার যোগ্য হন না। যিনি এই কালেমার রহস্য জানেন তিনি আরেফ বিল্লাহ ও অলিয়ে কামেল-এর মর্যাদায় আসীন হন। এই কালেমা প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত। এর এক ভাগ ফানা ও এক ভাগ বাকা। ফানাকে নুজুল (অবরোহ) ও বাকাকে উরুজ (আরোহ)ও বলা হয়। কীভাবে এই কালেমার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে— তা সুফি-সাধক ও পীর- মুরশিদরা শিক্ষা দিতে পারেন। এদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে- ‘মান কলা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুখলিছান দাখালাল জান্নাত’। ‘যে মুখলিসান বা পরিশুদ্ধভাবে কালেমা পাঠ করেছে, সে জান্নাতে প্রবেশ করেছে।’
হজরত মুহাম্মদ দ. এই কলেমার বিশেষ তালিম হজরত আলী (রা.) কে দিয়েছিলেন। তারপর সিনা থেকে সিনা হয়ে গাউসুল আজম হজরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর কাছে আসে। তিনিই এই তালিমকে কাদেরিয়া তরিকায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে সুবিন্যস্ত করে লিখিত আকারে এ কালেমার রহস্য তাঁর মুরিদানকে সবক দিয়েছেন। এসব বিষয়ে হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা. সিরর আল-আসরার ওয়া মাযহার আল-আনওয়ার বা রহস্যের গোপন বই এবং আলোর প্রকাশ, ফুতহুল গায়েব বা অদৃশ্যের রহস্য, গুনিয়াতুত তালেবীন বা অন্বেষকদের ধন, ক্বসীদায়ে গাউসিয়া বা গাউসিয়ার কবিতা, আল-ফুয়ুদাত আল-রব্বানিয়া বা আল্লাহর অনুগ্রহের প্রকাশ, খামসাতা আশারা মাকতুবান বা পনেরোটি চিঠি ও আল-ফাতহ আর-রব্বানীসহ বিভিন্ন বই লিখে গেছেন।
তরিকার নিয়মানুসারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে অজিফা পাঠ, বিশেষ দরুদ শরিফ, নফি-এসবাতের জিকির ও মোশাহাদা করতে হয়। এ তরিকায় জিকিরে জলি (উচ্চস্বরে জিকির) বা জিকিরে খফি (গোপনে জিকির) উভয় প্রকার জিকির করার নিয়ম রয়েছে। কাদেরিয়া তরিকাভুক্ত অনেক উপ-তরিকা রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান ও আদি নয়টি উপ-তরিকা রয়েছে- যথা: হাবিবিয়া, তারফুরিয়া, কারখিয়া, সকতিয়া, জুনায়দিয়া, গাজর দিদিনিয়া, তুরতুসিয়া, কারতুসিয়া ও সোহরাওয়ার্দিয়া। হযরত শাহজালাল রা. সোহরাওয়ার্দীয়া তারিকার অনুসারী ছিলেন। একারণে এই অঞ্চলে কাদেরিয়া সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার বিস্তার ঘটে। হযরত শাহ জালাল রা. এই সুন্নী ইসলামই এদেশে প্রচার করেছেন। ফলে তাদের মুরশিদ হিসেবে হযরত আবদুল কাদের রা. এ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার আধ্যাত্মিক শিক্ষায় মানুষ আলোকিত হয়ে যায়। তার বংশধরদের অনেকেই বাগদাদে হালাকু খানের আক্রমনের পর এই অঞ্চলে এসেছেন। ইসলাম প্রচার করেছেন। তার নাতি হযরত শাহ মাখদুম রহঃ রাজশাহীর মাটিতে শুয়ে আছেন। আব্দুল কাদের জিলানী রা. এই অঞ্চলের পীরেরও পীর।
এবার চলুন কীভাবে গেয়ারভী শরীফ পাঠ করতে হয় তা জেনে নেই। প্রথমে দুরূদে তাজ পাঠ করতে হবে। তারপর প্রত্যেক তসবীহ ১১বার করে পড়তে হবে- ১। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম (তাসমিয়াহ), ২। আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাযী লা- ইলাহা ইল্লা হুয়াল্ হাইয়্যুল ক্বাইয়্যুম্ ওয়া আতূবু ইলাইহি, ৩। দরূদ শরীফ, ৪। সূরা ফাতিহা, ৫। সূরা ইখলাছ, ৬। আস্-সলাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা সাইয়্যিদী ইয়া রাসূলাল্লাহ্, ৭।আস্-সলাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা সাইয়্যিদী ইয়া হাবীবাল্লাহ্, ৮। আল্লাহু, ৯। আল্লাহ্।
এই তাসবিহ ১০০ বার করে পাঠ করতে হয়।
১০। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, ১১। সুবহানাল্লাহ, ১২। আলহামদুলিল্লাহ, ১৩। আল্লাহু আকবর।
পরবর্তীতে এই দোয়াগুলো ১১ বার করে পড়তে হয়।
১৪। আল্লাহু লা- ইলাহা ইল্লাহু, ১৫। আঁল লা- ইলাহা ইল্লাহু, ১৬। আন্তাল্ হাদী আনতাল্ হাক্ক, লাইসাল্ হাদী ইল্লাহু, ১৭। হাসবী রাব্বী জাল্লাল্লাহ্, ১৮। মা-ফী ক্বলবী গাইরুল্লাহ্, ১৯। নূর মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহ্, ২০। লা-মাবূদা ইল্লাল্লাহ, ২১। লা মাওজুদা ইল্লাল্লাহ্, ২২। লা মাক্বসূদা ইল্লাল্লাহ্, ২৩। হুওয়াল্ মছাওউয়িরুল্ মহীত্বো আল্লাহ্, ২৪। ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুম, ২৫। আস্-সালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা সাইয়্যাদী ইয়া রাসুলাল্লাহ্, ২৬। আস্-সালাতু ওয়াস্ সালামু আলাইকা সাইয়্যাদী ইয়া হাবীবাল্লাহ, ২৭। ইয়া শায়খ্ সুলতান সৈয়্যদ আবদুল কাদের জীলানী শাইআঁল্লিল্লাহ্, ২৮। দুরুদ শরীফ, ২৯। ক্বসীদায়ে গাউসিয়া শরীফ।
এরপর ৩০। মিলাদ শরীফ পড়তে হবে। পরবর্তীতে এই ৩১। যিকর শরীফ ১০০ বার করে পড়তে হবে। (ক) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, (খ) সুবহানাল্লাহ, (গ) আলহামদুলিল্লাহ, (ঘ) আল্লাহু আকবর
এরপর মুনাজাত করে শেষ করতে পারেন গেয়ারভী শরীফ। চলুন একটু কাসিদায়ে গাউসিয়ার কিছু অংশ পড়ে আসি। জানি, কবিতায় কী লিখে গেছেন হযরত আবদুল কাদের জিলানী রা.-
সাক্বানিল্ হুব্বু কা’সাতিল্ বিসালী
ফাকুল্ত‚ লিখাম্রাতী নাহ্ভী তা’আলী।
চা‘আত্ ওয়া মাশাত্ লি নাহ্ভী ফি কুউসিন,
ফাহিম্তু বি সুক্রাতী বাইনাল্ মাওয়ালী।
ফাকুল্তু লিসায়িরিল্ আক্বত্বাবি লুম্মূ,
বিহালী ওয়াদ্খুলূ আন্তুম্ রিজ্বালী।
ওয়া হাম্মূ ওয়াশ্রাবূ আন্তুম্ জুনুদী
ফাসাক্বীল্ কাওমি বিল্ ওয়াফিল্ মালালী।
আমি অনুবাদ করলাম এভাবে-
ভালোবাসার পাত্র ভরা মিলন সুধা করছি পান
সব মদিরা আমার দিকে করেছি আমি আহ্বান।
মদিরা জুটছে অনেক, ছুটে আসছে আমার পানে
নেশার ঘোরে ঘুরছি শুধু সব বন্ধুদের মধ্যখানে।
বলছি তাদের যত কুতুব আছো তোমরা এই ভবে
সবাই খুব দ্রুত এসো মিলনের এই মহোৎসবে।
সৈনিকেরা সাহস রাখো পান করে যাও বাকী
পাত্র আমার সুরায় ভরা, ঢেলেছেন মহান সাকী।
---------------------কাসিদায়ে গাউসিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৯