সরকারি চাকরিতে পেনশন পেতে চাকরিকাল বিবেচনা করা হয়। ৫ বছর চাকরি করলে ২১% পেনশন পাওয়া যায়। ৬ বছর চাকরি করলে ২৪%, ৭ বছর চাকরি করলে ২৭%, ৮ বছর চাকরি করলে, ৩০%, ৯ বছর চাকরি করলে ৩৩%, ১০ বছর চাকরি করলে ৩৬%, ১১ বছর চাকরি করলে ৩৯%, ১২ বছর চাকরি করলে ৪৩%, ১৩ বছর চাকরি করলে ৪৭%, ১৪ বছর চাকরি করলে ৫১%, ১৫ বছর চাকরি করলে ৫৪%, ১৬ বছর চাকরি করলে ৫৭%, ১৭ বছর চাকরি করলে ৬৩%, ১৮ বছর চাকরি করলে ৬৫%, ১৯ বছর চাকরি করলে ৬৯%, ২০ বছর চাকরি করলে ৭২%, ২১ বছর চাকরি করলে ৭৫%, ২২ বছর চাকরি করলে ৭৯%, ২৩ বছর চাকরি করলে ৮৩%, ২৪ বছর চাকরি করলে ৮৭% এবং ২৫ বছর বা তদূর্ধ্ব চাকরি করলে ৯০% বা বেশি পেনশন পাওয়া যায়। উপরের চাকরিকালের ৫ -২৪ বছরের যে হিসাবটা দেয়া হয়েছে তা স্থায়ীভাবে অক্ষম ও মৃত্যুর কারণে ওই পরিমাণ পেনশন পাবেন।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সাধারণত সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩০ বছর। আর অবসরে যাওয়ার বয়সসীমা ৫৯ বছর। একজন চাকরিজীবী ৩০ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকলে ২৫ বছরের বেশি সময় চাকরি করতে পারেন। সরকারি চাকরিতে মেয়াদকাল সাধারণত ২৫-৩০ বছর স্টান্ডার্ড ধরা হয়। এই মেয়াদে চাকরি করলে তিনি ১০০ ভাগ পেনশন পাবেন। অক্ষম বা মৃত্যু না হলে বা ২৫ বছর চাকরি না করলে তিনি শতভাগ পেনশন পাবেন না।
এখন প্রশ্ন হলো সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৩৫ বছর করা হলে আর অবসরে যাওয়ার সময় যদি ৫৯ বছর থাকে তাহলে কী হবে। আবেদনের যোগ্যতার সর্বশেষ বয়স ৩৫ হলে তার চাকরিতে যোগদান করতে গিয়ে ৪০ বছর বয়স হবে। তাতে তিনি ১৯/২০ বছর চাকরি করার সুযোগ পাবেন। ১৯ বছর চাকরি করলে তিনি সর্বোচ্চ ৬৯ ভাগ পেনশন পাবেন। বাকী জীবন চলবেন কীভাবে! এতে চাকরিজীবীদের জন্য স্থায়ী বৈষম্য সৃষ্টি হবে।
যদি মনে করেন একটা আদেশ দিয়ে বাড়িয়ে দিলেই সমাধান- ব্যাপারটা তা নয়। প্রত্যেকের পেনশনের বিপরীতে জটিল পদ্ধতিতে টাকার সংস্থান করা হয়। একবার লিয়েনে গিয়ে এই টাকাটা আমার নিজের পকেট থেকে দিতে হয়েছিল বলে বিষয়টি জানি। একারণে ২০ বছর চাকরি হলেই শতভাগ পেনশন দিতে গেলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা দেখা দেবে।
জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারকে আধুনিক আমলাতন্ত্রের জনক ধরা হয়। তিনি আমলাতন্ত্রের ৬টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্যারিয়ারিজম। আমলাতন্ত্রে ক্যারিয়ার থাকতে হবে। যে পদে যোগদান করবেন সে পদ থেকে ধীরে ধীরে শীর্ষ পদে আসীন হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর্থিক সুবিধা থাকতে হবে। এ সকল ব্যবস্থা না থাকলে যোগ্য প্রার্থীরা কখনোই সরকারি চাকরিতে আসবেন না। যাদের অন্য কোনো গতি নেই সে ধরণের প্রার্থীরা সরকারি চাকরিতে ঢুকবেন। এতে প্রশাসনের মান কমবে। সেবার মান কমবে। আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য রাখতে হলে অবশ্যই চাকরিজীবীকে আর্থিক ও পদোন্নতির সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। একদিকে পুরা পেনশনের সুযোগ দিতে গেলে চাকরিতে বয়স বাড়াতে হবে। অন্যদিকে শীর্ষপদে পদোন্নতির সুযোগ দিতে গেলেও চাকরির মেয়াদ বাড়াতে হবে। যারা এর বিরোধীতা করছেন তাদের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নেই। আমলাতন্ত্র পুনর্বাসন কেন্দ্র হলে তার বিরূপ ফল দেশের মানুষের ভোগ করতে হয়।
এ কারণে দেখা যাচ্ছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা ৩৫ করতে হলে তার অবসরের সময়সীমা কমপক্ষে ৫-৬ বছর বাড়াতে হবে। না হলে তিনি পূর্ণ পেনশন পাবেন না। শীর্ষ পদেও যেতে পারবেননা। এই সুযোগ না থাকলে ৩৫ বছরের যোগ্য প্রার্থীরাও সরকারি চাকরিতে আসতে চাইবেননা। একারণে আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে গেলে অবসরের সময়সীমা বাড়ানো বিকল্প নেই।
এবার আসি অবসরের বয়স বাড়ালে কী হবে! অবসরের বয়স বাড়ালে যারা বর্তমানে চাকরিতে রয়েছেন তারা আরো ৫/৬ বছর চাকরির সুযোগ পাবেন। আমার জন্য ভালো হবে। যারা ৩৫ বছর বয়সের জন্য আন্দোলন করছেন তাদের জন্যও ভালো। তাহলে ক্ষতিটা করা জন্য!
বর্তমানে দেশে ৫৮ টি সরকারি ও ২০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীভুক্ত অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পরিচালনাকারী কলেজ রয়েছে দুই হাজার ২৫৪টি। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা ব্যক্তির সংখ্যা কমপক্ষে ১০ লাখ। শুধু বিসিএসএর হিসাবটাই দেই। প্রতি বিসিএসে মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার জনের চাকরি হয়। অথচ ৪০তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন প্রায় ৫ লাখ প্রার্থী। তবে ৪৬তম বিসিএসে এসে এ সংখ্যা কমে গেছে। এতে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০৮টি আবেদন জমা পড়েছে। বয়স পয়ত্রিশ করা হলে লেফট আউটরাও এবার বিসিএস দেয়ার সুযোগ পাবে। তাতে আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হলে নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করতে সময়ও বাড়বে। চাকরির বাজারে নতুনদেরকেই চাকরি দেয়া যাচ্ছেনা, লেফট আউটদের চিন্তা করলে তা আত্মঘাতি ছাড়া কিছুই হবেনা!
সবকিছু বিশ্লেষণ করে সহজেই বলে দেয়া যায়, চাকরিতে নিয়োগের বয়সসীমা ৩৫ করা হলে প্রতিবছর নতুন যে দশ লাখ চাকরিপ্রার্থী চাকরির বাজারে আসছেন তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। আর প্রবেশের বয়সসীমা বাড়লে অবসরের বয়সসীমা বাড়বে। অবসর না হলে পদশূন্য হবে কোথা থেকে! ফলে আগামী ৫-৬ বছর বিসিএসসহ সরকারি চাকরিতে নিয়োগই ধীরগতি হয়ে যাবে।
৩৫ দাবি চলমান মব জাস্টিসের অংশ বলা যায়। সবকিছু পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটিতে পাঠানো যেতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৪