১.০
ঐতিহাসিক জিয়া উদ্দীন বারানী তার তারিখ-ই-ফিরোজশাহী বইতে শায়েখ নিজাম উদ্দীনের প্রভাবে এই উপমহাদেশে জনজীবনে যে পরিবর্তন এসেছিল তা বর্ণনা করেছেন। তার আকর্ষণে মানুষ দলে দলে পাপ থেকে পূণ্যের পথে যোগ দিয়েছিলো। ঘুষ দুর্নীতি চুরি ডাকাতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। পূণ্যবানদের চেহারার আলোর ঝলকানিতে দূর হয়েছিল সকল অন্ধকার।
জিয়া উদ্দীন বারানী লিখেছেন, সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহি, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরবার ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। রাজ্যের চারদিক হতে লোকজন তাঁর দরবারে এসে মুরিদ হতেন ও খিরকা লাভ করতেন। সেখানে ধনী-গরীব,সম্মানি-অসম্মানী, বাদশাহ -ফকির, পণ্ডিত-মূর্খ, বাজারী-অবাজারী, শহরবাসী-গ্রামবাসী, গাজী-জাহিদ, প্রভু ও দাসের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। সবাই তাঁর কাছে তওবা করে পূণ্যজীবন লাভ করতেন। এসব লোকের অধিকাংশই যেহেতু নিজেদেরকে শায়খের মুরিদ ভেবে গৌরববোধ করতেন, সেজন্য বহু অপকাজ হতে তারা স্বেচ্ছায় দূরে থাকতেন। যদি কারও শায়খের দরবারে আসার পর কোন পদস্খলন ঘটত, তবে তিনি পুনরায় এসে নতুনভাবে তওবা করতেন। বস্তুতঃ শায়খের মুরিদ হওয়ার ফলে লজ্জাবণত অধিকাংশ লোক প্রকাশ্যে ও গোপনে কুকাজ হতে বিরত থাকতে চেষ্টা করতেন। এর ফলে সাধারণ লোকেরাও ধর্মের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।
স্ত্রী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ, মূর্খ-বাজারী, গোলাম-চাকর ও বালক-যুবার মধ্যে নামাজের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। এদের বেশিরভাগই 'এশরাক' ও 'চাশতের নামাজেরও ভক্ত হয়ে পড়েন। সমান্ত ও দয়াশীল লোকজন শহর হতে গিয়াসপুর পর্যন্ত পথের পাশে স্থানে স্থানে চত্বর তৈরি করে তার উপর চাল দিয়া নামাজের জায়গা করে দিয়েছিলেন। এগুলির পাশে পানিভর্তি মটকা, লোটা ও চাটাইর ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রতিটি চত্তরে একজন করে খেদমতগার থাকতেন ; যাতে শায়খের দরবারে আসার পথে লোকজন নামাজ পড়ার সময় অজুর পানি পেতে পারেন। সম্ভবতঃ এসব চত্বরে অনেক মুসল্লীর ভীড় হতো।
এভাবে একদিকে যেমন মুসল্লীদের মধ্যে নফল নামাজের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়, তেমনই বাজে কথা বলার অভ্যাসও তাদের মধ্যে লোপ পায়। বেশিরভাগ লোকের মধ্যে যে প্রকার কথাবার্তা হতো, তা বস্তুতঃ এশরাক, চাশত, আওয়াবীন, তাহাজ্জুদ প্রভৃতি নফল নামাজের রাকাত ও ওয়াক্ত নিয়েই হতো। এসব নামাজের কোনটি কোন নামাজের পরে কয় রাকাত পড়তে হয়, প্রতিটি রাকাতে কোরানের কোন কোন সুরা পড়া ভালো, নামাজ আদায়ের পর কিরূপ দোয়া করা উচিত ইত্যাদি বিষয়ে তারা একে অন্যের সাহায্য গ্রহণ করতেন। শায়খের দরবারে এসে নতুন আগন্তকরা পুরাতন মুরিদদের কাছে দরবারে রাতে কয় রাকাত নামাজ পড়তে হয়, প্রতি রাকাতে কি সুরা পড়তে হয় এবং হজরত মোস্তফা (দঃ) এর ওপর কয়বার দরুদ পাঠ করতে হয়, তা জেনে নিতে চেষ্টা করতেন। তাদের জিজ্ঞাসার বিষয় ছিল, শায়খ ফরিদ ও শায়খ বখতিয়ার করবার দরুদ পড়তেন এবং কয়বার পুরা অজিফা পাঠ করতেন। তারা নামাজ রোজা, নফল এবাদত ও নিয়ে আগ্রহ দেখাতেন। কম করে খাবার খাওয়ার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে উৎসুক্য প্রকাশ করতেন। ওই সময়ে বেশিরভাগ লোকের মধ্যে কোরান শরীফ হেফজ করিবার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নতুন মুরিদরা সবসময়ই জ্ঞানলাভে সচেষ্ট ছিলেন। নতুন মুরিদরা সবসময় পুরাতন মুবিদদের সাহচর্যে থাকতে চেষ্টা করতেন। পুরাতনরাও নানারকম এবাদত, নির্জনে বসা, মারেফতের কিতাব পাঠ, পীর পয়গম্বরদের নীতিকাহিনী আলোচনা করতেন। এগুলো ছাড়া তাঁদের অন্যকোনো কাজ ছিল না। দুনিয়াদারীর কোন কথা ও দুনিয়াপারের কোন বার্তা তাঁরা মুখে নিতেন না। দুনিয়ার প্রতি তাকিয়ে দেখা, এ বিষয়ে আলোচনা করা এবং দুনিয়াদারদের সাথে মেলামেশা করাকে তাঁরা সব ধরনের পাপ কর্মের অন্তর্গত বলে মনে করতেন ।
এসব মুরিদানের কল্যাণে নফল ধর্ম কর্মেও এমন নিষ্ঠা দেখা গিয়েছিল যে, স্বয়ং সুলতানের সভাসদদের মধ্য হতে বহু আমীর, সেলাহদার, সেলাহদার নবীশ, লশকরি, চাকর-নফর যারা শায়েখের মুরিদ হয়েছিলেন, তারাও চাশত ও এশরাকের নফল নামাজ পড়তেন এবং 'আইয়ানবিন' ও আগুরার রোজা রাখতেন। যখনই সুযোগ হতো বিশ দিন একমাস পরে পুণ্যাত্মাদের মজলিস হতো ও সুফি সাধকদের জিকিরের মহফিল অনুষ্ঠিত হতো এবং এসব মহফিলে কান্নাকাটি ও জজবার এক নতুন জগৎ দেখা দিতো। শায়েখের মুরিদদের অনেকেই মসজিদে উপস্থিত হয়ে ও নিজ ঘরে বসে তরাহবির নামাজে কোরান খতম করতেন। তাদের মধ্যে যাদের সামর্থ ছিল, তারা রমজান মাস, জুমা ও অন্য উপলক্ষের রাতগুলো জেগে কাটাতেন এবং ভোর পর্যন্ত তাদের চোখের পাতা এক হতো না। এমন অনেক বুজর্গ ছিলেন, যারা সারা বছর রাতের দুই-তৃতীয়াংশ তিন-চতুর্থাংশ জেগে এবাদত করতেন এবং অনেক সাধক শ্রেণীর লোক শয়নকালীন অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করতেন। আমি এমন অনেককে জানি, যারা শায়েখের স্নেহদৃষ্টির ফলে দিব্যদৃষ্টি ও অলৌকিক শক্তির অধিকারী হয়েছিলেন। শায়েখের পূণ্য অস্তিত্ব, তাঁর পূণ্য প্রভাব ও তাঁর নেক দোয়ার বরকতে এই এলাকার অধিকাংশ মুসলমান এবাদতে মারেফতে, নির্জন বাসে, ধর্ম-কর্মে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর পূণ্য ইচ্ছাপূরণে একান্ত অনুরাগী হয়ে পড়েছিলেন। সুলতান আলাউদ্দিন নিজেও সপরিবারে শায়খ নিজামের অনুগত হয়ে গেছিলেন।
এর ফলে বিশেষ ও সাধারণ সব শ্রেণীর লোকের মনে পূণ্য কাজ করার ইচ্ছা জাগ্রত।হয়। আলাই শাসনের শেষ কয়েক বছরে মানুষ দুর্নীতি, দুষ্কর্ম, সমকামিতা, ব্যাভিচার ইত্যাদির নাম মুখেও আনে নি। অধিকাংশ লোকের কাছে এই প্রকার গর্হিত পাপের সবই কুফুরির সমান বলে গণ্য হতো। মুসলমানরা লজ্জায় সুদ ও মজুতদারীর কথা মুখেও আনতে পারতেন না৷ বাজারীরাও ভয়ে ও লজ্জায় সব ধরনের প্রতারণা, ওজনে কম দেওয়া, ভেজাল করা, জাল করা, অজ্ঞদের আস্কারা দেওয়ার ব্যাপার হতে বিরত ছিল। শাযেখের দরবারের সাথে যুক্ত অধিকাংশ আলেম, শরীফ ও বুজুর্গ মারেফতের বই পড়া ও এর বিভিন্ন বিভিন্ন তরিকা সম্পর্কে জ্ঞানলাভে ব্যস্ত ছিলেন।
'কুয়তুল কুলুব' 'এহিয়াউল উলুম', এহিয়াউল উলুমের অনুবাদ, ‘আওয়ারেফ', 'কাশফুল মাহজুব', 'শরহে তাআররুফ', 'রেসালা কুশাইরী', 'মেরসাদুল এবাদ', 'মাকতুবাতে আইন কুজাত কাজী হামিদ উদ্দীন নাগুরীর লাওয়ায়েহ ও 'লাওয়ামেহ', আমীর হাসানের 'ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ'সহ বিভিন্ন বই শায়েখের নির্দেশে সবাই কিনতের। বই বিক্রেতাদের কাছে মানুষ মারেফতের বই সম্পর্কে নানাভাবে প্রশ্ন করতেন। পাগড়ীর সাথে দাঁতন ও চিরুনী না থাকলে তা কেউ গ্রহণ করতেন না। সুফী সাধকদের ব্যবহৃত লোটা ও চামড়ার চিলুচীর চাহিদা বেশি হওয়ায় সেগুলোর দাম বেড়ে যায়।
মোটামুটিভাবে একথা বলা যায় যে, আল্লাহতায়ালা এই আখেরী জামানায় শায়েখ নিজামকে শায়েখ জুনায়েদ ও শায়েখ বায়েজীদের মতো মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর মধ্যে খোদায়ী এশকের জজবা যে পরিমাণে দিয়েছিলেন, তা সাধারণ মানুষের ধারণায় আসা সম্ভব নয় । মনে হয়, তাঁর মধ্যেই সৎপীরের গুণাবলী ও হেদায়াতের সব প্রয়োজনীয় বিষয় প্রকাশ করে যেন মোহর মেরে তিয়েছেন। কৰি বলেছেন,
"এই মহান উদ্দোশ্য পূর্ণ বিষয়ের সমূদয় কিছু
নিজাম উদ্দিনের মধ্যে এসে শেষ হয়ে গেছে।"
মোহাররম মাসের পাঁচ তারিখে, যে দিন শায়খুল ইসলাম শেখ ফরিদ উদ্দিন রহঃ এর ওরস অনুষ্ঠিত হতো, সে দিন শায়েখের দরবারে শহর ও হিন্দুস্তানের বিভিন্ন দিক হতে এত বেশি পরিমাণ লোকের সমাগম হতো এবং জিকিরের মহফিল বসতো যে, এর পরে কেউ আর এর মতো অন্য কিছু স্মরণ করিতে পারেনা। বস্তুতঃ শায়খ নিজাম উদ্দিনের কালটি ছিল এক অদ্ভুত ও আশ্চর্য সময়।
আলাই শাসন আমলে অযোধ্যায় শেখ ফরিদ উদ্দিনের পৌত্র শায়খ আলাউদ্দিন তাঁর সাজ্জাদানশীন হিসাবে স্থলাভিষিক্ত ছিলেন। আল্লাহতায়ালা শেখ ফরিদ উদ্দিনের প্রৌত্র শায়েখ আলাউদ্দিনকে সাক্ষাৎ পূণ্যময় ও এবাদতকারী হিসেবে সৃষ্টি করেছিলেন। এসব বুজর্গ ব্যক্তি ও তাঁদের সন্তান-সন্তস্তি রাতদিন সারাক্ষণ একমাত্র আল্লাহতায়ালার এবাদতে কাটাতেন। এক মুহূর্তও তাঁরা নামাজ ও জিকির আজকার ছাড়া থাকতে পারতেন না । আল্লাহর প্রেম এসব শরীফের পুত্র শরীফের মধ্যে এমনভাবে স্থান করে নেয় যে, তাঁরা কায়মনে সবসময় সেই প্রেমেই মগ্ন থাকতে চাইতেন। তাফসিরে যেমন এসেছে যে, পবিত্র ফেরেশতাদের মধ্যে এমন অনেক ফেরেশতা রয়েছেন, যারা শুধু আল্লাহর এবাদত করার জন্যই সৃষ্ট হয়েছেন এবং জন্মের দিন হতে তাঁরা এই কাজেই মগ্ন হযন। শায়েখ আলাউদ্দিনকে মনে হয় এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট করা হয়েছিল।
২.০
টিকাটুলি জামে মসজিদে গত জুমায় (১৪ জুন) ইমাম সাহেবের বক্তব্য শুনলাম। তিনি পীরদের নিয়ে একটি গল্প বলেছেন। এক মুরিদ তার পীরের কাছে গিয়ে গত রাতে তার দেখা স্বপ্ন সম্পর্কে বলার অনুমতি চান। পীর সাহেব তাকে নির্ভয়ে বলার অনুমতি দেন। মুরিদ বলেন, হুজুর গত রাতে স্বপ্নে দেখেছি আপনার আঙ্গুল থেকে মধু বের হচ্ছে। হুজুর শুনে খুশী হলেন। বললেন, আল্লাহর ওলীদের হাতের আঙ্গুল থেকে মধুই তো বের হবে। মুরিদ বললেন, এদিকে আরো দেখলাম আমার হাত থেকে মল বের হচ্ছে। পীর সাহেব বললেন, পাপীর আঙ্গুল থেকে মল ছাড়া কিছুই বের হয়না। যা দেখেছো সব সঠিক দেখেছো। এবার মুরিদ স্বপ্নের পরবর্তী অংশ বলার জন্য অভয় চান। পীর তাকে অভয় দেন। মুরিদ বললেন, দেখলাম আমি আপনার আঙ্গুল চুষছিলাম। আর আপনি আমার আঙ্গুল চুষছিলেন।
তার গল্প শুনে অবাক হইনি। বর্তমানে দেশের মসজিদে মসজিদে পীর মুরিদী সম্পর্কে এমন বাজে কাহিনী শুনানো হচ্ছে। পীর মুরিদী সম্পর্কে এ রকম আরো বাজে গল্প বানানো হয়েছে। এদেশে বদআকীদার লোকজনের প্রচারণায় ইসলামের মুলধারা পীর মুরিদি, সুফিবাদ, ওরশ, শবে বরাতের মতো ইসলামিক সংস্কৃতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। শুধু জুমার নামাজের পূর্বে বক্তব্য নয়; ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা ঈদে মিলাদুন্নবী, ওরশ, আশুরা, শবে বারাতসহ বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ দিন উদযাপনের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। সাধারণ মুসলমানদের মনে পীরদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে দেয়া হয়েছে। মাজারের বিরুদ্ধে শিরিক আওয়াজ তুলেছে। ওদিকে হাক্কানী পীর মাশায়েখরা ইন্টারনেট কমই ব্যবহার করেন। ফলে মানুষ জানতে পারছেনা। এছাড়াও কিছু পীর তরিকার নামে ভন্ডামি করছেন। তাদের অপকর্মের ভিডিওতে অনলাইন সয়লাব করেছে বিরোধীরা। মুলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উগ্র জঙ্গীবাদে সামিল হচ্ছে প্রজন্ম। গোড়ামিকেই তারা খালেস ইসলাম মনে করছে। পীর মুরিদীর আসল রূপই তারা জানেনা। জানানোও হয়না।
এ অবস্থায় সুফিজম ও পীর মুরিদী বাঁচাতে এ মুহূর্তে আরেকজন নিজাম উদ্দীন আউলিয়া দরকার।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৫:৪০