যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়েছিলাম সেই ছেলেবেলায়৷ ওই বইটা পড়ে জেনেছিলাম দিল্লী দূর আস্তের শানে নুযুল৷এটি সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহি, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার পবিত্র বাণি। চলুন যাযাবরের লেখায় জেনে আসি নিজাম উদ্দীন আউলিয়া কেন বলেছিলেন, দিল্লী বহূদূর!
........................................................................
''সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী দিল্লীর একপ্রান্তে একটি মসজিদ তৈরী করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরে একদা এক আউলিয়া এলেন সেই মসজিদে। ফকির নিজামউদ্দিন আউলিয়া। স্হানটি তাঁর পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ।
ক্রমে প্রচারিত হলো তাঁর পূণ্যখ্যাতি; অনুরাগী ভক্তসংখ্যা বেড়ে উঠল দ্রুত বেগে। স্হানীয় গ্রামের জলাভাবের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। মনস্হ করলেন খনন করবেন একটি দীঘি। যেখানে তৃষ্ণার্ত পাবে জল, গ্রামের বধুরা ভরবে ঘট, নামাজের পূর্বে অযু করে পবিত্র হয়ে মসজিদে প্রবেশ করবে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। কিন্তু সংকল্পে বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতভাবে।
উদ্দীপ্ত হলো রাজরোষ। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন এক সামান্য ফকির, নিজামউদ্দিন আউলিয়া। গিয়াসউদ্দিন তোগলকের দৃঢ়তা ছিল, শক্তি ছিল, রাজ্যশাসনের দক্ষতা ছিল। কিন্তু সে অনুপাতে তার নিস্ঠুরতাও ছিল ভয়াবহ। এই দক্ষ ও নিস্ঠুর সুলতানের প্রয়োজন পরল নতুন নগরী নির্মাণের।
বহি:শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে প্রাচীরবেস্টিত এক নতুন রাজধানী। নাম হবে তার তোগলোকাবাদ। ফকির সুলতানে সংঘর্ষ ঘটল এই নগরী নির্মাণকে কেন্দ্র করে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দীঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসউদ্দিনের নগর তৈরী করতেও মজুর আবশ্যক সহস্র সহস্র।
অথচ দিল্লীতে মজুরের সংখ্যা অত্যন্ত পরিমিত, দু'জায়গায় প্রয়োজন মিটানো অসম্ভব। সুলতান চাইলেন নজুরেরা তার কাজ আগে শেষ করবে, ততক্ষণ অপেক্ষা করুক ফকিরের খয়রাতি খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের, সেটার পরিমাপ করা যায়। ফকিরের জোর হৃদয়ের, তার সীমা নেই। মজুরেরা বিনা মজুরিতে দলে দলে কাটতে থাকলো ফকিরের দীঘি।
সুলতান হুংকার ছেড়ে বললেন, তবে রে --। কিন্তু তার হুংকার ধ্বনি আকাশে মিলাবার আগেই এত্তালা এলো আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বিদ্রোহ দমন করতে সুলতানকে ছুটতে হলো সৈন্য সামন্ত নিয়ে। শাহজাদা মোহম্মদ তোগলক রইলেন রাজধানীতে রাজ-প্রতিভূরূপে।
শাহজাদা মোহম্মদ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার অনুরাগীদের অন্যতম। তাঁর আনুকূল্যে দিবারাত্রি খননের ফলে পরহিতব্রতী আউলিয়ার জলাশয় জলে পূর্ণ হলো অনতিবিলম্বে। গিয়াসউদ্দিন তোগলকের নগরী তোগলকাবাদ রইলো অসমাপ্ত। অবশেষে নিস্ঠুর সুলতানের ফেরার সময় হলো নিকটবর্তী। প্রমাদ গণনা করলেন আউলিয়ার ভক্তরা।
তারা ফকিরকে দীল্লি ত্যাগ করে পলায়নের পরামর্শ দিল। ফকির মৃদু হাস্যে তাদের নিরস্ত করলেন, - দিল্লী দূর অস্ত। দিল্লী অনেক দূর । প্রত্যহ যোজন পথ অতিক্রম করছেন সুলতান। নিকট হতে নিকটতর হচ্ছেন রাজধানীর পথে।
প্রত্যহ ভক্তরা অনুনয় করে ফকিরকে। প্রত্যহ একই উত্তর দেন ফকির নিজামউদ্দিন আউলিয়া - দিল্লী দূর অস্ত। সুলতানের নগর প্রবেশ হলো আসন্ন, আর মাত্র একদিনের পথ বাকি। ব্যাকুল হয়ে শিষ্য প্রশিষ্যরা অনুনয় করল সন্যাসীকে, এখনও সময় আছে এইবেলা পালান। গিয়াসউদ্দিনের ক্রোধ এবং নিষ্ঠুরতা অবিদিত ছিলনা কারো কাছে, ফকিরকে হাতে পেলে কি দশা হবে তার কথা কল্পনা করে সবাই ভয়ে শিউরে উঠলো বারংবার।
স্মিতহাস্যে সেদিনও উত্তর দেন বিগতভয় সর্বত্যাগি ফকির - দিল্লী হনুজ দূর অস্ত। দিল্লী এখনও অনেক দূর । বলে হাতের তসবীহ ঘোরাতে লাগলেন নিশ্চিন্ত ঔদাসিন্যে। নগরপ্রান্তে পিতার অভ্যর্থনার জন্য পুত্র মোহম্মদ তৈরী করেছে মহার্ঘ মন্ডপ। কিংখাবের শামিয়ানা।
জরিতে, জহরতে, ঝলমল। বাদ্যভান্ড, লোকলষ্কর, আমীর-ওমরাহ মিলে সমারোহের চরমতম আয়োজন। বিশাল ভোজের ব্যবস্হা, ভোজের পরে হস্তিযুথের প্রদর্শনি প্যারেড। মন্ডপের কেন্দ্রস্হলে ঈষৎ উন্নত ভূমিতে সুলতানের আসন, তার ঠিক পাশেই তার উত্তরাধিকারীর। পরদিন গোধুলি বেলায় সুলতান প্রবেশ করলেন অভ্যর্থনা মন্ডপে।
প্রবল আনন্দোচ্ছাসের মধ্যে আসন গ্রহন করলেন সুলতান । সিংহাসনের পাশে বসালো নিজ প্রিয়তম পুত্রকে। কিন্তু সে মোহম্মদ নয়, তার অনুজ। ভোজনান্তে অতি বিনয়াবনত কন্ঠে মোহম্মদ অনুমতি প্রার্থনা করলেন সম্রাটের। জাহাঁপনার হুকুম হলে এবার হাতীর কুচকাওয়াজ শুরু হয়, হস্তিযুথ নিয়ন্ত্রন করবে মোহম্মদ নিজে।
গিয়াসউদ্দিন অনুমোদন করলেন স্মিতহাস্যে। মোহম্মদ মন্ডপ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলো ধীর শান্ত পদক্ষেপে। কড়্ কড়্ কড়র কড়াৎ। একটি হাতীর শিরসন্চালনে স্হানচ্যুত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্ত মধ্যে সশব্দে ভূপতিত হলো সমগ্র মন্ডপ ।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল অসংখ্য কাঠের থাম। চাপাপড়া মানুষের আর্তকন্ঠে বিদীর্ণ হলো অন্ধকার রাত্রির আকাশ। ধূলায় আচ্ছন্ন হলো দৃষ্টি। ভীত সচকিত ইতস্তত ধাবমান হস্তিযুথের গুরুভার পদতলে নিস্পিষ্ট হলো অগনিত হতভাগ্যের দল। এবং সে বিভ্রান্তকারি বিশৃঙ্খলার মধ্যে উদ্ধারকর্মীরা ব্যর্থ অনুসন্ধান করল বাদশাহের।
পরদিন প্রাতে ভগ্নস্তুপ সরিয়ে আবিস্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতানের মৃতদেহ। যে প্রিয়তম পুত্রকে তিনি উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন মনে মনে, তার প্রানহীন দেহের উপর দুই বাহু প্রসারিত। বোধ করি আপন দেহের বর্মে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন তাঁর স্নেহাস্পদকে। সমস্ত ঐহিক ঐশ্বর্য প্রতাপ আর মহিমা নিয়ে সপুত্র গিয়াসউদ্দিনের শোচনীয় জীবনান্ত ঘটল নগরপ্রন্তে। দিল্লী রইল চিরকালের জন্য তার জীবিত পদক্ষেপের অতীত।
দিল্লী দূর আস্ত । দিল্লী অনেক দূর!''
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৫১