সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির শাসনামলে সুলতান-উল-মাশায়েখ, মেহবুব-এ-ইলাহি, শেখ খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন আউলিয়া দিল্লিতে আসেন। দিল্লিতে তার খানকায় আধ্যাতিকতার শিক্ষা পেতে লোকজনের ভীড় জমে যায়। সুলতান আলাউদ্দীন খিলজি যেমন ছিলেন নৃশংস তেমনি প্রখর বুদ্ধির মানুষ। তিনি নিজাম উদ্দীন আউলিযার আধ্যাতিকতার প্রমাণ পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিক জিয়া উদ্দীন বরানী তার তারিখ-ই-ফিরোজশাহী বইতে এরকমেরই একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
সুলতান আলাউদ্দিন কোথাও সেনাবাহিনী অভিযানে বের হলে একটি নিয়ম চালু করেছিলেন। দিল্লী হতে প্রথম মঞ্জিল হয়ে যে স্থানে গিয়ে সেনাবাহিনী পৌঁছাতো, সম্ভব হুলে সেখানেই থানা স্থাপন করতেন। প্রতি মঞ্জিলের সংবাদ পাঠানোর জন্য অশ্বারোহী কাসেদ নিয়োগ দিতেন। এভাবে রাস্তার আধাক্রোশ পোষাক্রোশ দূরে দূরে হরকরা নিযুক্ত হতো। যে সব গ্রাম বা শহরের ওপর দিয়ে অশ্বারোহী কাসেদ যাতায়াত করত, সেখানে পদস্থ কর্মচারী ও বিবরণ লেখক থাকতেন। তারা একদিন, দু'দিন কিংবা তিন দিনের সংবাদ একত্র করে সুলতানের কাছে পাঠাতেন । বর্তমানে সেনাবাহিনী কোথায় কি করছে, সুলতান তা জানতে পারতেন এবং সুলতানের আদেশ নিষেধ জানাতে পারতেন। এর ফলে দিল্লীর শহরে সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোন গুজব হতো না। এভাবে সেনাবাহিনী ও সুলতানের মধ্যে যোগাযোগের ফলে অভিযানগুলো সফল হতো।
কিন্তু একবার মালিক নায়েব অরণ্যকুল দূর্গ জয় করতে গিয়ে তেলেঙ্গার পথে বিপদে পড়েন। এই রাস্তার কতগুলো ঘাঁটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে চল্লিশ দিনের বেশি অতিবাহিত হলেও সেনাবাহিনীর কোনো সংবাদ সুলতান আলাউদ্দিনের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এজন্য সুলতান খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং শহরের গণ্যমান্য সকল ব্যক্তির মনে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠে যে, সেনাবাহিনীতে অবশ্যই কোন বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যার ফলে সংবাদ আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে ।
চিন্তিত সুলতান আলাউদ্দিন মানিক বেগ ও কাজী মুগিস উদ্দিন বয়ানকে শায়খ নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার কাছে পাঠান । তাদেরকে শায়েখের খেদমতে সালাম জানিয়ে এ কথা আরজ করতে নির্দেশ দিলেন যে, সুলতান সেনাবাহিনীর সংবাদ জানতে খুবই উদগ্রীব হয়ে আছেন । যেহেতু ইসলামী সেনাদলের জন্য সুলতান অপেক্ষা শায়খের দরদ অনেক বেশি সেজন্য তিনি যেন তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে সৈন্যদলের সংবাদ জেনে সুলতানকে আশ্বস্ত করেন । তাদেরকে সুলতান আরও বললেন যে, একথা শায়েখের কাছে উপস্থাপনের পর তার কাছ থেকে যে সব কথা ও মন্তব্য শুনবেন, তা যেন যথাযথভাবে সুলতানকে জানান এবং কোনপ্রকার ব্যতিক্রম না করেন। তারা দুজনে শায়েখের খেদমতে পৌঁছে সুলতানের কালাম ও পয়গাম জানান। শায়েখ নিজাম উদ্দিন আউলিয়া তাঁদের বক্তব্য শুনলেন। পরে সুলতানের বিজয়ের সংবাদ দেন৷
বললেন, এই বিজয় তেমন কিছুই নয়; তিনি এর চেয়ে বড় বিজয়ের আশা পোষণ করেন। এ কথা শুনার পর মালীক বেগ ও কাজী মুগিস আনন্দিত হয়ে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির দরবারে হাজির হয়ে শায়েখের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সুলতান আলাউদ্দিন শায়খের কথা শুনে খুশী হলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। অরণ্যকুল দুর্গ বিজিত হয়েছে। তিনি তাঁর পাগড়ীর লেজ টেনে গিঁট দিলেন এবং বললেন, আমি শায়েখের এই শুভ সংবাদ শুভ চিহ্ন হিসেবে গ্রহণ করলাম। কারণ আমি মনে করি, শায়েখের মুখ হতে কোন কথা অনর্থক বের হয় না। বাস্তবে অরণ্যকুল বিজয় সমাপ্ত হয়েছে এবং আমি অনুরূপ আরও বহু বিজয় সংবাদ অচিরেই শুনতে পাবো।
নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার মুখ নিসৃত বাণীর সত্যতা মেলে। খোদার ইচ্ছায় ঐ দিনই জোহরের নামাজের সময় মালীক নায়েবের কাছ হতে সংবাদসহ অশ্বারোহী কাসেদ সুলতানের কাছে পৌঁছায় এবং অরণ্যকুলের বিজয় সুসংবাদ জানায় । জুমার দিনে এই বিজয় সংবাদ সব মসজিদের মিম্বার হতে ঘোষণা করা হয়। শহরের সবখানে আনন্দবাদ্য বাজতে থাকে। সবাই আনন্দ প্রকাশ করে। আর এদিকে শায়েখ নিজাম উদ্দিনের কেরামত সম্পর্কে সুলতানের ধারণা ও বিশ্বাস দৃঢ় হয়।
সুলতান আলাউদ্দিনের সাথে নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার কোন দিন সাক্ষাত হয় নি। তারপরেও তাঁর রাজত্বকালে শায়েখ সম্পর্কে তিনি এমন কোন কথা বলেন নি, যাতে শায়েখের মনে কষ্ট হতে পারে।
জিয়া উদ্দীন বারানী লিখেছেন, খিলজির রাজ দরবারে শায়েখের অনেক হিংসুক ও শত্রু ছিল। তারা শায়েখের ব্যাপারে সুলতানের কান ভারি করতেন। শায়েখ এত দান কেথা থেকে করেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ তার ভক্ত। সাধারণ মানুষের কাছে সুলতানের চেয়েও তার সম্মান বেশি- এসব ছিল তাদের বক্তব্য। তবে সুলতান শত্রুদের এই সব কথা কখনো কানে তুলতেন না। তাঁর রাজত্বের শেষের দিকে তিনি শায়খের একান্ত ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন । এরপরেও তাঁদের মধ্যে সাক্ষাত হয় নি।
আলাউদ্দিন খিলজি তার নিজের চাচা ও শ্বশুড় জালাল উদ্দীন খিলজিকে হত্যা করে দিল্লীর সিংহাসন দখল করেছিলেন। সম্ভবত সেই অপরাধবোধের কারণে তিনি নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার সামনে মুখ দেখান নি। পরে একইভাবে আলাউদ্দীন খিলজিও হত্যার শিকার হয়েছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৮